সাক্ষাৎকার

পাহাড় থেকে সমতলের জার্নিটা সহজ ছিল না

শিল্পী কনকচাঁপা চাকমা ছবি: সালাহউদ্দিন পলাশ

আদিবাসী সংস্কৃতি, পাহাড়ি নিসর্গ, যাপিত জীবন ভেসে ওঠে তার ক্যানভাসে। এর মধ্যেই বিচ্ছুরিত হয় অশান্ত পাহাড়, জাতিগত অস্তিত্বের লড়াই আর সত্তার বৈরিতার স্পষ্ট টানাপড়েন। উজ্জ্বল লাল-হলুদ-নীল রঙ, মোটা রেখা, সাবলীল দেহভঙ্গিমার মাধ্যমে চিত্রশিল্পের জমিনে তিনি বুনে যান নিজস্ব জীবনের গল্প। কয়েক বছরের ব্যবধানে তার কাজের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো চোখে পড়ে। বিমূর্ত থেকে রিয়ালিস্টিক, সেমি-রিয়ালিস্টিক কিংবা মিশ্র মাধ্যমে করা কাজগুলোয় কখনো রঙ, কখনো ফর্ম, কখনো ফিগারের ভাংচুর, যা দেখে বোঝা যায় এগুলো শিল্পী কনকচাঁপা চাকমার কাজসাক্ষাৎকার গ্রহণে রুহিনা ফেরদৌস

শিল্পকলায় অবদানের জন্য একুশে পদকপ্রাপ্তিতে আপনাকে অভিনন্দন।

রাষ্ট্রীয় সম্মাননাপ্রাপ্তিতে আমি ভীষণ আনন্দিত। আমার ৩৫ বছরের জার্নি। তবে পাহাড় থেকে সমতলে এসে ছবি আঁকার জার্নিটা সহজ ছিল না। জীবনের এত পদচারণা, এত লড়াই, এত কর্মময়তা, সবকিছুর ফলে পদকপ্রাপ্তি। আমার কাজ, পরিশ্রমের সম্মান দেয়া হলো, এজন্য আমি কৃতজ্ঞ।

পাহাড় থেকে সমতলের জার্নিটা কেমন ছিল?

অত্যন্ত চ্যালেঞ্জের। প্রত্যন্ত একটি পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এসে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা, অন্য শিল্পীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজ করাটা কঠিন। প্রত্যেক শিল্পীর জীবনে লড়াই থাকবেই। তাছাড়া আমি যে কর্মময় জীবনের মধ্যে আছি, আমার যে সম্ভাবনা কাজের পরিধি, এখানে অনেক প্রতিযোগিতা বিদ্যমান। সমসাময়িক শিল্পী থেকে শুরু করে ছোট-বড় সবার সঙ্গে কাজের জায়গাটা আমাকে ভাগ করে নিতে হয়েছে। কেউ কাউকে আসলে জায়গা দেয় না, নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়। কাজেই আমার চলার পথে অনেক সাধনা কাজ জড়িয়ে আছে।

আপনার চিত্রকর্মে আদিবাসী উপকরণ, সংস্কৃতি, বিশেষ করে আদিবাসী নারীকে দেখতে পাই। ছবির বিষয়বস্তু কীভাবে নির্ধারণ করেন?

আমার মা শরৎ মালা চাকমা একজন বুননশিল্পী। শৈশবে আমার চারপাশে বিভিন্ন রঙিন সুতা, উপকরণ, চরকায় তুলা কেটে সুতা তৈরি করতে দেখেছি মাকে, যা আমার ক্যানভাসে স্থানান্তরিত হয়েছে। আমাদের আদিবাসী নারীরা পুরুষের তুলনায় বেশি কাজ করে। মাকে দেখতাম সংসারের সব কাজ করে তারপর বুনন শিল্পের কাজ করতে। পরিস্থিতির পরিবর্তন হচ্ছে। নারীদের নিজের পায়ে দাঁড়ানো দরকার। আত্মমর্যাদা নিয়ে যদি সে বাঁচতে পারে, তা সবচেয়ে সম্মানজনক। আমার ক্যানভাসে নারীদের আমি সৌন্দর্যের জন্য নিয়ে আসি না। নারী শক্তিময়ী, যাকে দুর্গার সঙ্গে আমরা তুলনা করতে পারি। নারীর বাহ্যিক ছন্দময় দিকটির সঙ্গে তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে আনার চেষ্টা করি, যার কারণে আমার ছবিতে নারীর প্রাধান্য বেশি। আমার ছবিতে পুরুষ, পাহাড়, নদী, সমুদ্র সবকিছু আসে, কিন্তু মূল অবজেক্ট থাকে নারী। আমি চাই আমার ক্যানভাসের নারীরা নারীর চাওয়া, না পাওয়ার গল্পগুলো বলুক। আমার রঙের মাধ্যমে তারা ফুটে উঠুক।

নারীর গল্প ফুটিয়ে তুলতে কী ধরনের রঙ ব্যবহার করেন?

সব রঙের মধ্যে নিজস্ব ভাষা থাকে। যেমন লাল রঙটা আমি সবসময় ব্যবহার করেছি নারীর শক্তি, ক্ষোভ প্রকাশের রঙ হিসেবে। আনন্দ, হাসিখুশিতে হলুদ, কমলা রঙ চলে আসে। দুঃখকে নীল দিয়ে প্রকাশের চেষ্টা করেছি। এগুলো মূলত একজন শিল্পীর ওপর নির্ভর করবে, সে তার সাবজেক্টকে কীভাবে উপস্থাপন করবে।

মূলধারার সঙ্গে পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতা, চারপাশের অস্থিরতা, সংঘাতএগুলোর প্রতিফলন আপনার ক্যানভাসে কীভাবে পড়ে?

একজন শিল্পীর কাজে অনেক ভাংচুর থাকে। শিল্পীকে অনেক রকম ফর্মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমি একই ধরনের কাজ সবসময় করব না। চার-পাঁচ বছরের ব্যবধানে আমার কাজের সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো ধরা যায়। রঙে, ফর্মে, ফিগারের অনেক পরিবর্তন আছে। সংগ্রামের প্রতিফলন আছে। অনেক বেদনার ছবি আছে। নারীদের তো অনেক বঞ্চনা আছে। শুধু পাহাড় বা সমতল নয়, আমাদের দেশ দেশের বাইরের নারীরাও বিভিন্ন সহিংসতার মুখোমুখি হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। বিষয়গুলো আমাকে অনেক পীড়িত করে, তাড়িত করে। এই পীড়ন থেকেই আমি অপেক্ষা, ধূসর অ্যালবাম সিরিজের কাজগুলো করেছি, যেখানে ৪০-৪৫টি ছবি রয়েছে। ছবিতে দেখা যায়, মেয়েদের মুখটা নাক পর্যন্ত ঢাকা, কিন্তু চিবুকের নিচের দিকে একটু আলো। এর মানে সুদিন একদিন আসবেই। আমি আশাবাদী মানুষ।

এথনিক আর্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ নামে আপনার একটি উদ্যোগ রয়েছে। এটি পাহাড়ের শিল্পীদের কী ধরনের সহযোগিতা দেয়?

আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অনেক আগে থেকেই আমার কাজের চিন্তা ছিল। তাদের কাজের পরিবেশ তৈরি করে দেয়া, যাতে ওরা নিজেদের প্রতিভা মেধাকে বিকশিত করতে পারে। আদিবাসী ছেলে-মেয়েদের এককভাবে কাজের প্রদর্শনী বা আর্ট ক্যাম্প করার সক্ষমতা নেই। তাদের সহযোগিতা করার চিন্তা থেকেই এথনিক আর্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ। আমাদের ফাউন্ডেশনের মূল লক্ষ্য আর্ট ক্যাম্প চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা। তাছাড়া আমরা সামাজিকভাবেও বিভিন্ন কাজ করতে আগ্রহী। ছবি আঁকার পাশাপাশি যারা সিনেমা নির্মাণ, আলোকচিত্র, কবিতা গল্প লিখতে চায়, সৃজনশীলতার পর্যায়ে আমরা তাদের সহযোগিতা করতে চাই। ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই আমরা তাদের মেধার বিচ্ছুরণ ঘটাতে চাই। যারা কোনো সুযোগ পাচ্ছে না তারা যেন ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সুযোগ পায়, নিজেকে একজন শিল্পী হিসেবে তৈরি করতে পারে, আমরা সে সহযোগিতা করতে চাই।

প্রিয় মানুষের আকস্মিক চলে যাওয়া আপনার জীবন কাজকে কতটা প্রভাবিত করেছে?

আমাদের চারজনের জীবন একটা প্লাটফর্মে বাঁধা ছিল। যেমন একটা টেবিলের চারটা পা থাকে। একটা পা যদি চলে যায়, তাহলে সবকিছুই ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। মিঠু (চিত্রশিল্পী নির্মাতা খালিদ মাহমুদ মিঠু) চলে যাওয়ার পর আমার দুই সন্তান (ছেলে আর্য শ্রেষ্ঠ, মেয়ে শিরোপা পূর্ণা), আমরা তিনজন একে অন্যের কাছে অশ্রু গোপন করেছি, আর পরস্পরকে সাহস দিয়েছি। মিঠু চাইত আমি অনেক বেশি কাজ করি, ছবি আঁকি। আমি আমার মনটাকে সেভাবে গুছিয়ে নিয়েছি। মিঠুর স্বপ্নকে ধরে রাখার জন্য শক্তিশালী হয়ে উঠেছি। কাজের মধ্যেই ডুবে থেকেছি। কষ্টটাকে কখনো বাইরে প্রকাশ হতে দিইনি। বিয়ের পর মিঠু আমি মিলে রাস্তা থেকে অসহায় বিড়াল-কুকুর উদ্ধার করতাম। আমার বাসায় এখন ১১টা বিড়াল আছে। আমার কাজ আর ওরাই আমাকে অনেক ব্যস্ত রাখে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন