সৃষ্টিতে চিরন্তন

বেঁচে থাকা, বাঁচিয়ে রাখা

আহমেদ দীন রুমি

ফ্রিদা কাহলো ছবি: ফ্রিদাকাহলোডটওআরজি

(পূর্ব প্রকাশের পর)

অথচ ফ্রিদার প্রতিকৃতির পেছনে প্রাণপূর্ণ প্রকৃতি। বৈপরীত্যকে হাজির করেছেন তিনি। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে রিভেরাকে ভালোবেসে কষ্ট পাওয়া ফ্রিদা নিজেকে তুলে ধরেছেন নিপুণ আঁচড়ে। হূদয়ের অবিরাম অভিব্যক্তিকে প্রকাশ করার জন্য প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা থাকে। ফ্রিদার ভাষা পেইন্টিং।

কমিউনিস্ট নেতা লিয়ন ট্রটস্কি রিভেরার বন্ধু। স্তালিনের দ্বারা নির্বাসিত হয়ে ট্রটস্কি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রত্যাশী ছিলেন। সরকারকে বুঝিয়ে রিভেরা তাকে মেক্সিকোয় নিয়ে আসেন। ট্রটস্কি বাস করতে লাগলেন ফ্রিদার পিতা গিয়ের্মোর বাড়িতেই। সেখানে রাশিয়ান নেতার সঙ্গে ফ্রিদার নাতিদীর্ঘ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৩৭ সালে ট্রটস্কিকে একটা সেলফ পোর্ট্রেট উপহার দেন তিনি। এক হাতে চিরকুট অন্য হাতে ফুল। ট্রটস্কি অফিস কক্ষেই সাজিয়ে রাখতেন চিত্রকর্মটি। একদিন সেটা নজরে পড়ে আন্দ্রে ব্রেতোর। পরাবাস্তববাদের তাত্ত্বিক হিসেবে এরই মধ্যে সমাদৃত ব্রেতো। চিত্রকর্মটি তাকে আগ্রহী করে তোলে ফ্রিদার চিন্তাধারা সম্পর্কে। ফ্রিদাও ক্রমে পুরোদস্তুর আঁকাআঁকিতে মনোনিবেশ করতে থাকেন। ১৯৩৮ সালে তার চিত্রকর্ম নিয়ে আমেরিকায় প্রদর্শনী হয়। পরের বছর পাড়ি জমান প্যারিসে, প্রদর্শনীর খাতিরেই। সেখানে তার সৃষ্টিকর্মে মুগ্ধ হন পাবলো পিকাসো। রিভেরা তখনো ছিলেন ফ্রিদার সঙ্গে। আসলে রিভেরা আর ফ্রিদার সম্পর্ক ছিল অদ্ভুত। কেউ কাউকে নিয়েও থাকতে পারছেন না আবার কেউ কাউকে ছাড়াও থাকতে পারছেন না। ১৯৩৯ সালে তাদের ডিভোর্স হয়। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানেই ফের বিয়ে করেন দুজন। অবশ্য তখন থেকে পিতা গিয়ের্মোর সঙ্গে কাসা আজুলে বসবাস করতে শুরু করেন ফ্রিদা। ১৯৪১ সালে মারা যান গিয়ের্মো। স্রোতের পর স্রোতের মতো এতগুলো ঘটনা তাকে ভেতর থেকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। নিঃসঙ্গতা, ব্যথা অভিমান নিয়ে সেটুকুই তিনি তুলে আনলেন দ্য টু ফ্রিদাস, দ্য ওউন্ডেড টেবিল, সেলফ পোর্ট্রেট উইথ থর্নি নেকলেস দ্য ব্রোকেন কলাম চিত্রকর্মে। মূলত সময়টা ফ্রিদার সৃজনশীলতার স্বর্ণযুগ। প্রতিটা চিত্রকর্মেই তার ভেতরে মেক্সিকান সংস্কৃতি আদি ইন্ডিয়ান উপাদানের প্রতি ঝোঁক প্রমাণিত হয়। ১৯৪৩ সালে আঁকা রুটস সময়ের অন্যতম উদাহরণ। চিত্রকর্মে হাতের ওপর ভর দিয়ে মরুভূমিতে শুয়ে আছেন ফ্রিদা। বুকের পাঁজর খুলে আছে জানালার মতো। তা থেকে বের হয়ে আসছে সবুজ গাছ। ফ্রিদা যেন মরুভূমিতে প্রাণের উৎস। যেন ক্যাথলিক বিশ্বাসে যিশুর প্রতিকৃতি। প্রসঙ্গক্রমে মাত্র কয়েক বছর আগে আঁকা মাই নার্স অ্যান্ড আই-এর কথা আনা যেতে পারে। চিত্রকর্মে শিশু ফ্রিদা এক স্থানীয় মেক্সিকান নারীর বুকের দুধপান করছেন। দুটি চিত্র পরস্পর বিপরীত। ভাঙতে থাকা শরীর মনকে চিত্রিত করেছেন দ্য ব্রোকেন কলাম-তে।  

শরীরটা আর কথা শুনছিল না। প্রতিদিন বেড়ে চলছিল অসুস্থতা। অবশ্য ভাঙা শরীরের চেয়ে ভাঙা মন তাকে ক্লান্ত করেছিল বেশি। টাইম ম্যাগাজিনের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমি অসুস্থ নই, চূর্ণ-বিচূর্ণ। তবে যতদিন আঁকতে পারি, ততদিন বেঁচে থাকলেই খুশি। ১৯৫৩ সালে পরিস্থিতির অবনতি ঘটলে ডান পা কেটে ফেলতে হয়। ফ্রিদা বলেছিলেন, পায়ের কী প্রয়োজন! যখন ওড়ার জন্য আমার ডানা রয়েছে। উক্তিতে তার মানসিক শক্তি সম্পর্কে আঁচ করা যায়। তবে সে ডানাটুকুকেও টিকতে দেয়নি নিয়তি। ১৯৫৪ সালের জুলাই ফ্রিদার ৪৭তম জন্মদিন। তার ঠিক সাতদিন পর বৃষ্টিমুখর দিনে পৃথিবীকে বিদায় জানান ফ্রিদা।

ফ্রিদার বিচিত্র জীবনই তাকে পরিণত করেছে বিচিত্র শিল্পীতে। বর্তমানে ফ্রিদা কাহলো দিয়েগো রিভেরা মেক্সিকান রেনেসাঁর পথিকৃৎ হিসেবে পরিগণিত। নারীর ব্যথা হতাশাকেও যে বোধ্য উপায়ে প্রকাশ করা যায়, তা প্রমাণ করে গেছেন ফ্রিদা। বর্ণবৈষম্য লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে নিরন্তর প্রচেষ্টা চালানো মানুষের জন্য ফ্রিদা অনুপ্রেরণা। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সরব কণ্ঠস্বরদের জন্য ফ্রিদা আদর্শ। আর্ট ফ্যাশনে তার প্রভাব পরিচিত ফ্রিদাম্যানিয়া পরিভাষায়। জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় হিসেবে ফ্রিদার সঙ্গে কাটানো দিনগুলোকে রিভেরা স্মরণ করেছেন আত্মজীবনী মাই আর্ট, মাই লাইফ: অ্যান অটোবায়োগ্রাফি-তে। আসলে ফ্রিদা শুধু রিভেরার জীবনকেই সুন্দর করেননি, বাঁচতে শিখিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মকে।

আজ কিংবা আজ থেকে বহু বছর পর কেউ একজন বিধ্বস্ত হূদয় নিয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়াতে শিখবে তার গল্প শুনে। সাহস পাবে ফ্রিদার কণ্ঠস্বরে, দিনশেষে আমরা অনেক বেশি সহ্য করতে পারি। যতটা না ভাবি, তার চেয়ে

বেশি। প্রিয়জনদের প্রায়ই আত্মপ্রতিকৃতি উপহার দিতেন ফ্রিদা। তিনি না থাকলেও তার প্রতিকৃতি যেন তাকে চিরন্তন উপস্থিত বানিয়ে রাখে। সেটাই হয়েছে। ফ্রিদা বেঁচে রয়েছেন তার সৃষ্টির ভাঁজে। (শেষ)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন