স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য বীমা সুরক্ষা

বাংলাদেশে বীমা শিল্পের উন্নয়ন সুরক্ষার সীমাহীন সম্ভাবনা রয়েছে। বীমার মৌলিক বিষয় হলো ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দেশের বৃদ্ধি-সমৃদ্ধির জন্য অর্থনীতিকে রক্ষা করা। বর্তমানে বাংলাদেশে ৮১টি বীমা কোম্পানি তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর মধ্যে ৩৫টি জীবন বীমা এবং ৪৬টি সাধারণ বীমা কোম্পানি। বাংলাদেশের জিডিপিতে বীমা কোম্পানিগুলোর অবদান শতাংশেরও কম (বর্তমানে প্রায় শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ) তবে অর্থনীতিতে ইন্স্যুরেন্স পেনিট্রেশনের হার বাড়লে তা সুরক্ষার পরিমাণ বাড়াবে, নতুন সুবিধা সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশে ইন্স্যুরেন্স পেনিট্রেশনের হার শতাংশ বৃদ্ধি করা গেলেও বীমাবিহীন ক্ষতি কমিয়ে জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা সম্ভব।

বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র চারজনের জীবন বীমা পলিসি রয়েছে, যা বিশ্বের সর্বনিম্ন দেশগুলোর মধ্যে একটি। এমনকি সাধারণ বীমার ক্ষেত্রেও খুব সামান্য অবদান রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার বীমা ব্যবসার সমূহ সম্ভাবনার ওপর জোর দিয়েছে। আমরাও আশাবাদী হয়েছি। কারণ দেখতে পেয়েছি যে সরকার খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। যেমন বীমা শিল্পের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে বীমাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে এসেছে এবং জাতীয় সংসদে বীমা আইন, ২০১০ পাস করেছে। পরবর্তী সময়ে আইনের অধীনে ২০১১ সালে বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) গঠন করা হয়েছে। জাতীয় বীমা নীতি-২০১৪ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বীমা শিল্পের জন্য পদ্ধতিগত উন্নয়ন এবং প্রবিধানের জন্য কাজ চলছে। অগ্রাধিকারের অংশ হিসেবে সরকার প্রতি বছরের মার্চ জাতীয় বীমা দিবস উদযাপনের ঘোষণা দিয়েছে।

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে প্রযুক্তি সক্ষম, স্মার্ট এবং আরো টেকসই দেশ হিসেবে গড়ার জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো সব নাগরিকের জীবনযাত্রার মান উন্নত করা, নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তিকে কাজে লাগানো। ২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের মাধ্যমে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সোসাইটি এবং স্মার্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করাও উদ্যোগের লক্ষ্য।

সম্প্রতি প্রকাশিত স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন ২০৪১: অল ইউ নিড টু এক্সপ্লোর শীর্ষক গবেষণাপত্রে স্মার্ট বাংলাদেশের উদ্যোগের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, স্মার্ট বাংলাদেশ মানুষের জীবন এবং দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং উদ্ভাবনী পদ্ধতির ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ডেটা অ্যানালিটিকস হলো সমাজের বিভিন্ন দিক যেমন স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবহন এবং শাসন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য মূল রূপান্তর। ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির জন্য বীমা সুরক্ষা উপেক্ষা করা যায় না।

এটি ব্যাখ্যা করলে বোঝা যায় যে বাংলাদেশে অনেকগুলো উদ্যোগ এবং প্রকল্প চলছে যেগুলোর লক্ষ্য উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার জন্য প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের ব্যবহারের কথা প্রচার করা। এর মধ্যে রয়েছে -গভর্নেন্স, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা পরিবহনের ক্ষেত্রে নানা উদ্যোগ। প্রযুক্তি এবং উদ্ভাবনের শক্তিকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ অদূরভবিষ্যতে নেতৃত্বের ভূমিকা রাখতে পারে এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন অগ্রগতির জন্য অন্যান্য দেশের কাছে একটি রোল মডেল হয়ে উঠতে পারে। উদ্যোগগুলো হলো সাশ্রয়ী মূল্যের এবং নির্ভরযোগ্য ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের প্রবেশাধিকার সম্প্রসারণ; প্রযুক্তির ব্যবহারিক জ্ঞান এবং দক্ষতা উন্নয়ন; বিভিন্ন খাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে উৎসাহিত করা; স্মার্ট শহর স্মার্ট গ্রাম নির্মাণ; একটি ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন, উদ্ভাবন এবং উদ্যোগগুলোর প্রচার।

স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে সরকার। ডিজিটাল ইকোসিস্টেম বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি এবং নাগরিকদের ডিজিটাল পরিষেবা প্রযুক্তি উন্নয়নে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বৃদ্ধি এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগের বিষয়েও সরকার দায়িত্বশীল। স্মার্ট বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আশাব্যঞ্জক। একটি বিস্তৃত ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের সঙ্গে দেশটি ডিজিটাল পরিমণ্ডলে একক নেতৃত্ব অর্জন করতে পারে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করাসহ প্রযুক্তির সুবিধা গ্রহণেও প্রস্তুত। বেসরকারি খাতের কোম্পানি এবং নাগরিকদের প্রচেষ্টার সমন্বয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের রূপকল্পের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি দেশটিকে বৈশ্বিক পরিবারে প্রযুক্তিগতভাবে একটি উন্নত সচেতন জাতিতে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করবে। প্রচেষ্টাগুলো বীমার সুরক্ষা ছাড়া অসম্পূর্ণ হবে, যা উন্নত দেশগুলোয় মৌলিক বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আধুনিক যুগে মানুষ বীমা পণ্য ব্যবহার করে। এর মধ্যে রয়েছে যানবাহন বীমা, ভ্রমণ বীমা, সম্পত্তি বীমা, চিকিৎসা বীমা এবং জীবন বীমা পরিকল্পনার অধীনে বিভিন্ন সুরক্ষা বীমা। সব জীবন বীমা এবং সাধারণ বীমা পরিকল্পনায় সাধারণত সম্পত্তি, জীবন স্বাস্থ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করে মানুষ। সব ধরনের বীমা ঝুঁকি এবং ক্ষতি থেকে মানুষকে রক্ষা করে। জিডিপি বৃদ্ধিতে বীমা খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বীমা কোম্পানি দ্বারা অর্জিত সব প্রিমিয়াম অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে। পাশাপাশি এটি অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান বাড়ায় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করে। এসব কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে বীমার ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং এটি সেবা খাতের নির্ভরযোগ্য ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত। বীমা অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি মৌলিক সুরক্ষা ভূমিকা পালন করে, যা বীমাযোগ্য ঝুঁকির বিরুদ্ধে জীবন সম্পত্তি রক্ষা করে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে সক্ষমভাবে চালনা করতে পারে। বর্তমানে এগুলো বেশির ভাগই অরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়।

প্রবৃদ্ধির গতিতে বাংলাদেশের বীমা কোম্পানিগুলোকে ব্যক্তি এবং দেশের মূল্যবান সম্পদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করার জন্য অদৃশ্য শক্তি হিসেবে কাজ করতে হবে। কোম্পানিগুলোকে প্রতিকূল ঘটনা এবং ঝুঁকির বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করতে হবে। স্মার্ট বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতিকে সমর্থন করে বীমা কোম্পানিগুলো প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারে এবং স্মার্ট পরিষেবাগুলোর মাইলফলক স্থাপনের জন্য ব্যবসায়িক প্রক্রিয়া পরিবর্তন করতে পারে। এটি নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর সঙ্গে দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক সুরক্ষা হিসেবে গ্রাহককেন্দ্রিক স্মার্ট পদ্ধতির সঙ্গে প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে সক্রিয় উদ্যোগ নিতে পারে। বিষয়গুলো হলো আইটি অবকাঠামোর উন্নয়ন, নতুন আইটি সিস্টেমের অভিযোজন, চলমান ডিজিটাল প্লাটফর্ম, অ্যাপস, কাস্টমাইজড ওয়েব পেজ সমাধান প্রস্তুত করা, ডিজিটাল বিক্রয় বা বীমা পরিকল্পনার তালিকাভুক্তি, ডিজিটাল ঝুঁকি মূল্যায়ন, আন্ডাররাইটিং ডিজিটাল পরিবেশন, দাবি জমা, ডিজিটাল সেটেলমেন্ট, ডিজিটাল চ্যানেল/ বিএফটিএনের (অনলাইন ফান্ড ট্রান্সফার) মাধ্যমে পেমেন্ট, এজেন্ট বা আর্থিক সহযোগীদের জন্য ডিজিটাল মার্কেটিং কৌশল এবং প্রশিক্ষণ উন্নয়ন, বাংলাদেশকে সর্বদা অনিশ্চয়তা বা দুর্যোগের দেশ হিসেবে দেখা হয়, যা অর্থনৈতিক সংকট থেকে শুরু করে জলবায়ু পরিবর্তন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পত্তি বা জীবনের ক্ষতি, জনগণ অর্থনীতির জন্য দুর্বলতা তৈরি করে এবং যেখানে আমরা সম্পূর্ণভাবে সরকারি সহায়তা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল।

অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে পুনরুদ্ধারের একমাত্র উপায় বীমা। যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অনেকাংশে অনুপস্থিত এবং তা দুর্বল বীমা সুরক্ষা ব্যবস্থার কারণেই। সরকার এবং বীমা কোম্পানির মধ্যে স্মার্ট পদ্ধতির সমন্বয়ে বাংলাদেশ তার নাগরিক, অর্থনীতি, সমাজ সরকারের বীমা সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। বীমা কোম্পানিগুলো এখন ডিজিটালাইজেশনের সহায়তায় এর প্রবৃদ্ধির জন্য যথেষ্ট সুযোগের পূর্বাভাস দেয় এবং জনগণ অর্থনীতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। আমরা উপলব্ধি করতে পারি, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের দেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছে। বর্তমানে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ তৈরির দিকে মনোনিবেশ করছে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে। স্মার্ট পদ্ধতিতে বাংলাদেশ নতুন প্রযুক্তি এবং অবকাঠামো, শিক্ষা প্রশিক্ষণের উন্নতি এবং উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে বিনিয়োগ করছে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠী এবং সীমিত সম্পদের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতির জন্য বীমা সুরক্ষার পাশাপাশি সুরক্ষা বহর নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ তার জনগণ এবং অবকাঠামোর জন্য বীমা সুরক্ষায় বিনিয়োগ করে বিশ্বের দরবারে একটি উদীয়মান দেশ হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন