বীমা কোম্পানিগুলোকে তাদের কার্যক্রমে স্বচ্ছ হতে হবে

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের আর্থিক খাতে ব্যাংকের যে প্রবৃদ্ধি এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বীমা খাতেরও বড় হওয়ার কথা ছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে বীমা খাতের অবদান বেশি হওয়ার কথা ছিল। অথচ বর্তমানে দেশের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান মাত্র শূন্য দশমিক ৫৭ শতাংশ। বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৮১টি হলেও, বীমা কাভারেজ রেশিও বিবেচনা করলে আমাদের অবস্থান বিশ্বের মধ্যে একেবারে নিচের দিকে। যদিও আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে, জিডিপি বেড়েছে, মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মানুষের আয় বাড়ার পাশাপাশি ব্যয়ের প্রবণতাও বেড়েছে। এক্ষেত্রে বীমা কোম্পানিগুলো কিন্তু মানুষের স্বাস্থ্য বীমা, শিক্ষা বীমা কৃষি বীমা যেটা মাইক্রো ইন্স্যুরেন্স আমরা বলি সেগুলোকে খুব সহজেই আয়ত্তে নিতে পারত। কিন্তু সেভাবে কোনো পরিকল্পনা অনুসারে আমাদের বীমা খাতটি উন্নয়ন না হওয়ার কারণে এটি অনেক পিছিয়ে আছে। আমরা যখন দেশের উন্নয়নের গল্প প্রচার করি কিংবা উন্নয়নের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলতে বলতে একেবারে চূড়ার দিকে চলে যাই তখন কিন্তু বীমা খাতের দিকে তাকালে দেখা যায় যে এটি একেবারেই অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো বীমার আওতার বাইরে রয়েছে। তাই বীমা খাতের অনেক সম্ভাবনা তো রয়েছে।

দেশের কৃষি খাতের সঙ্গে অনেক মানুষ জড়িত আছে। কৃষি আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করে এবং এখানে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি রয়েছে। সেই জায়গায় বীমা খাতের সবার আগে যাওয়া উচিত ছিল। যদিও কেউ কেউ শস্য বীমা করছে কিন্তু এটি ব্যাপক পরিসরে করা হচ্ছে না। কৃষকরাও বোঝেন না যে তারা শস্য বীমা দিয়ে কী করবেন। অন্যদিকে যখন বীমা পণ্য ডিজাইন করা হয় সেটি ত্রুটিপূর্ণ থেকে যায়। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো কৃষকের চাহিদার বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করে পণ্য ডিজাইন করতে পারে। কিংবা অন্যান্য দেশে যেখানে শস্য বীমা রয়েছে তাদের পণ্যগুলো পর্যালোচনা করে সেটি যদি আমাদের জন্য উপযুক্ত হয় তাহলে সেটিও চালু করা যেতে পারে। এখানে উদ্দেশ্যটাই মূল বিষয়। আইডিআরএ কিন্তু নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি বীমা খাতের উন্নয়নের জন্যও কাজ করে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কিন্তু প্রচেষ্টাই আমাদের এখানে নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে বীমা কোম্পানির উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের অনেকেরই খাত নিয়ে সেভাবে কোনো ভিশন নেই। বা ১০ বছর কিংবা ২০ বছর পরে বীমা খাতকে কোথায় দেখতে চান তাদের সে লক্ষ্যমাত্রা নেই। তারা স্বল্প মেয়াদের ব্যবসা নিয়ে চিন্তা করেন। অনেক সময় প্রশ্ন জাগে যে আইডিআরএ কি বীমা খাতকে চালায় নাকি কোম্পানিগুলো বীমা খাতকে চালায়। আইডিআরএতে নিয়োগকে শাস্তিমূলক বদলি হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে। ফলে যিনি এখানে চেয়ারম্যান হয়ে আসেন তিনি কোনোমতে সময়টা পার করে দেন। অবস্থা হলে তো তিনি বীমা খাতের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবেন না। আইডিআরএর নিজেদেরও জনবলের ঘাটতি আছে। তাদের এখানে স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা অনেক কম। তাদের কিছু ভালো কর্মী রয়েছেন কিন্তু তারা অস্থায়ী হওয়ার কারণে খাতটির উন্নয়নে অবদান রাখার ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত বোধ করেন। বীমা পলিসি যেসব এজেন্ট বিক্রি করেন তারা কিন্তু গ্রাহককে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেন না। কারিগরি বিষয় হওয়ার কারণে গ্রাহকেরা বীমা পলিসির খুঁটিনাটি সেভাবে বোঝেন না। এটি সবচেয়ে ভালো বোঝার কথা এজেন্টদের। বীমা দাবি নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দেখা যায় যে গ্রাহক দুর্বল হলে অনেক সময় তার অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে কোম্পানি গড়িমসি করে। পলিসি নেয়ার পর সেবার ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা যায়। বীমা করার জন্য যে প্রতিষ্ঠান বাছাই করব কোনটা ভালো কোনটা মন্দ সেটা কীভাবে বুঝব। এর একটা উপায় আছে ক্রেডিট রেটিং যাচাই করা। তবে রেটিংয়ের ক্ষেত্রে এর বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বীমা সম্পর্কে মানুষের সচেতনতারও ঘাটতি রয়েছে। তাই মানুষের সচেতনতা বাড়ানোর জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য প্রচার-প্রচারণা দরকার। বীমা খাতে গবেষণা হয় না বললেই চলে। গবেষণার মাধ্যমে সমস্যাগুলো অনুধাবন করে পলিসি ডিজাইন করলে ভালো হতো।

আমাদের বীমা কোম্পানিগুলো শহরকেন্দ্রিক। অথচ গ্রামাঞ্চলের মানুষের ঝুঁকি বেশি থাকে। যাদের ঝুঁকি বেশি তারাই বীমার বাইরে থাকছেন। জনগণের মধ্যে ব্যাপক হারে বীমা করাতে পারলে কোম্পানিগুলো ভালো মুনাফা করতে পারবে এবং ভালো বেতনে ভালো কর্মী নিতে পারবে। অন্যদিকে বীমা খাতে ভালো কর্মীরও সংকট রয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে বীমার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। যাতে মানুষ ছোট থেকেই বীমা সম্পর্কে জানতে পারে। আমাদের এখানে কার্ডভিত্তিক স্বাস্থ্যবীমা প্রচলন করা যেতে পারে। বীমা কোম্পানির নৈতিকতার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নজরদারির পাশাপাশি নতুন নতুন পণ্য চালু করতে কোম্পানিগুলোকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সুশাসনের বিষয়টিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। শক্ত ভিত্তির ওপর বীমা কোম্পানিগুলো যে দাঁড়াবে সেই লক্ষণ কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। প্রথমে কোম্পানিকে নিজেদের স্বচ্ছ হতে হবে। আইডিআরএ একটা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেবে যে আগামী পাঁচ বছরে এত সংখ্যক মানুষকে বীমার আওতায় আনতে হবে। এজন্য প্রচার-প্রচারণাসহ যা প্রয়োজন করতে হবে। তারপর যদি বীমা কোম্পানি মানুষকে ভালোভাবে সেবা দিতে পারে তাহলে মানুষের মধ্যে বীমার বিষয়টি জনপ্রিয়তা পাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন