বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর সিদ্ধান্তে রাষ্ট্র ও সমাজ অগ্রসর হয়েছে

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

১৯৯২ সালে বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষা নেয়ার পদক্ষেপ ছিল চিরাচরিত নিয়মের বাইরে। যেমনটি হয়েছিল ৮৩-এর স্বাস্থ্যনীতির ক্ষেত্রে। দুটি নীতি দেশের শিক্ষা স্বাস্থ্য খাতে অনেক বড় পরিবর্তন এনেছে। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কেন বেসরকারি খাতে উচ্চশিক্ষা চালু করা হলো? জবাব হচ্ছে, আশির দশকে রাজনৈতিক হট্টগোল ছিল অনেক বেশি। শিক্ষা ক্ষেত্রে ছিল চরম নৈরাজ্য। ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলনে লেখাপড়ার মান একদম তলানিতে চলে যায়। হাতে গোনা কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। সেগুলোয় সব মিলিয়ে মাত্র ১৫ থেকে ১৮ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেত। আর ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাও তীব্র সেশনজটের কারণে সঠিক সময়ে চাকরির বাজারে প্রবেশের সুযোগ পেত না। অন্যদিকে নব্বইয়ের দশকে দেশের বেসরকারি খাতে বিপুল সম্প্রসারণ ঘটে। খাতে গড়ে ওঠে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন বড় বড় করপোরেট। একই সময়ে প্রসার ঘটে তৈরি পোশাক খাতেও। বেসরকারি খাতের উত্থানে ব্যাপক জনবল চাহিদা তৈরি হয়।

ঠিক ওই সময় নর্থ সাউথের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক মুসলেহ উদ্দিন, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) প্রতিষ্ঠাতা এম আলিমউল্যা মিয়ান ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চট্টগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা ডা. নুরুল ইসলামতিনজনই সরকারের কাছে বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তৎকালীন সরকারও বেসরকারি খাতবান্ধব ছিল। দ্রুত আইন অনুমোদন দেয়া হলো। যাত্রা হলো বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালুর সিদ্ধান্তে সমাজ, রাষ্ট্র সর্বোপরি জাতীয় অর্থনীতি উপকৃত হয়েছে।

শুরুর দিকে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি; ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, আইইউবিএটিসহ বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া হলো। তারাই বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার পথ দেখিয়েছে। এর মধ্যে দেশের বেসরকারি খাতের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে নর্থ সাউথের অনেক বেশি অবদান রয়েছে। তারা সফলতার সঙ্গে গুণগত উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত করতে পেরেছে, যা অন্যদের জন্য অনুকরণীয় ছিল। প্রথম দিককার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কার্যক্রম শুরুর পর পরই অনেক ছাত্রছাত্রী ভর্তি হওয়া শুরু করল। শুরুর দিকের প্রতিষ্ঠানগুলো মানসম্মত উপায়েই বেড়ে উঠেছে। এতে গোটা উচ্চশিক্ষা খাতই উপকৃত হয়েছে। শিক্ষার মান বেড়েছে। পরবর্তী সময়ে ধাপে ধাপে নতুন নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে থাকে। দ্বিতীয় তৃতীয় ধাপে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোরও বেশির ভাগই ভালো করেছে। তবে আমার মতে, বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের ধারা একটা পর্যায়ে গিয়ে লাগামহীন হয়ে পড়ে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যাচ্ছেতাই উপায়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হলো। কেন এত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দেয়া হলো, এটা আমার বোধগম্য হয় না। যদি আইন উচ্চশিক্ষার  মৌলিক মানদণ্ডগুলো অনুসরণের কথা বলা হয়, অনেকগুলো বন্ধ হয়ে যাবে। এটা এমন জিনিস নয় যে বন্ধ করা যাবে না। প্রয়োজনে ক্রাইটেরিয়া মিট না করলে কিন্তু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে মানসম্মত কোনো শিক্ষক তো নেই। ১০৯টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য যে-সংখ্যক শিক্ষক দরকার তা আমাদের দেশে নেই।

উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে বেশকিছু সংস্কার চলছে ভালো-মন্দ মিলিয়ে। আমি কয়েকটা বিষয় সামনে আনতে চাই। একটা হলো আউটকাম বেজড এডুকেশন। এটা চমৎকার। কিন্তু কিছু সংস্কার বিষয়ে আমরা তীব্রভাবে আপত্তি করেছি। একটা হলো ক্রেডিট সংখ্যা বিষয়ে। ক্রেডিট সংখ্যা ছিল ১২০; এটাকে হঠাৎ করে ১৪০ করা হলো। এতে সময় বেশি লাগবে। টাকা খরচ বেশি হবে। এটা করলে তো মান বাড়বে না। ১২০ ক্রেডিট বা ১২৫ ক্রেডিটের জায়গায় ১৪০ করলেই মান বাড়বে এমন কিন্তু নয়। একমাত্র হার্ভার্ডে ১২৮ অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যা ইচ্ছা, উচ্চশিক্ষাটা মধ্যবিত্তের হাতের নাগালে যাক। ওইটা কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে। ক্রেডিটযুক্তরাষ্ট্রের বাকি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২০-১২৫ ক্রেডিট। তারা যদি পারে আমরা কেন পারব না।

আরেকটা হলো তিন সেমিস্টারের জায়গায় দুই সেমিস্টার করা। তিন সেমিস্টার আমরা কেন করলাম? যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা সব জায়গাতেই তিন সেমিস্টার আছে। আমাদের অনেক অভিভাবক ধান-চাল বিক্রি করে, জমি বন্ধক দিয়ে টিউশন ফি দেন। তো তারা যদি তিনবারে দিতে পারেন, অনেক সুবিধা হয়। দুবারে দিলে বোঝাটা বড় হয়ে যায়, অনেক বেশি পড়া একসঙ্গে পড়তে হবে। কিন্তু কাউকে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা না করে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেন রাজা রাজদণ্ড দিয়ে দিলেন। কত চেষ্টা করলাম কিন্তু কাজ হলো না। এখন তো নির্বাচনের বছর। যখন কথাগুলো আসবে তখন এমন আন্দোলন হবে। কখনো এটা বাস্তবায়ন করতে পারবে না। আর তিন সেমিস্টার হলে আমরা কোনো ক্ষতি বৃদ্ধি দেখছি না।

 

অধ্যাপক . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন