ইস্ট ওয়েস্ট সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত

অধ্যাপক . মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য। ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে। ইস্ট ওয়েস্টের গড়ে ওঠা, পথচলা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তা সঙ্গে

ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রার গল্প শুনতে চাই...

দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে ১৯৯৬ সালে আমি জাতিসংঘ থেকে আগাম অবসর নিই, দেশের জন্য কিছু করব বলে। আসার পর পরিকল্পনা ছিল গ্রামে মেয়েদের জন্য স্কুল গড়ে তুলব। কিন্তু সবাই মিলে বিশেষ করে তৎকালীন শিক্ষা সচিব ইউজিসির নীতিনির্ধারকরা একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পরামর্শ দিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার জন্য কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করতে হতো। অর্থ চেয়ে পরিচিত অনেককেই চিঠি লিখলাম। প্রস্তাবে সাড়া দেয়া প্রথম ১৪ জন আমি ১৫ জনের উদ্যোগে ইস্ট ওয়েস্ট প্রতিষ্ঠা করলাম। আমরা প্রত্যেকে লাখ করে দিয়ে ৭৫ লাখ টাকা দিলাম। আর ২৫ লাখ টাকার একটি তহবিল ছিল। এভাবেই ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির গোড়াপত্তন। মঞ্জুর এলাহী ট্রেজারার, নওশের আলী রেজিস্ট্রার, আর আমি উপাচার্যআমরা তিনজনই ছিলাম অবৈতনিক।

প্রতিষ্ঠার পর নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছিলেন?

শুরুর গুল্পটাও রোমাঞ্চকর। মহাখালীর সেকেন্ড লেনের একটি ভবন নিলাম। যাওয়ার রাস্তা ছিল ভাঙাচোরা। মাদকসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসের উৎপাত ছিল ওই এলাকায়। হানিফ সাহেব তখন মেয়র। তিনি রাস্তাটা ঠিক করে দিলেন। স্থানীয় সংসদ সদস্য সন্ত্রাসীদের সরিয়ে দিলেন। এভাবে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হলো। প্রথমে ২০ জন ছাত্রছাত্রী ভর্তি হলো। প্রত্যেকেই হয় নিম্নমধ্যবিত্ত না হয় মধ্যবিত্ত। কাজেই ২০ জন ছাত্রের বেতনেই ভবনের খরচ চলে যেত। পাঁচজন শিক্ষক, তিনজন কর্মকর্তা-কর্মচারী আর ২০ জন ছাত্র নিয়ে শুরু। প্রথম সেমিস্টার পারলাম না। সেকেন্ড সেমিস্টার থেকে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া শুরু করলাম। যেদিন ভর্তি পরীক্ষা নিতাম, সেদিন রাতেই রেজাল্ট দিতাম। যাতে কেউ ইনফ্লুয়েন্স করতে না পারে। আজও কেউ তা করতে পারে না। শিক্ষকমণ্ডলী খাতা দেখে যে মার্কস দেবেন, তা কেউ কখনো পরিবর্তন করেনি। করতে পারে না।

বিশ্ববিদ্যালয়টির অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা বিষয়ে জানতে চাই।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি সততার সঙ্গে পরিচালনা করেছি। পেছনে তাকাতে হয়নি। নিজেদের টাকা দিয়ে এবং শিক্ষার্থীদের বেতনের সঞ্চিত অর্থে জমি কিনেছি। দৃষ্টিনন্দন ভবন গড়ে তুলেছি। শহীদ মিনার করেছি। আলোর মিনার করেছি, যা একটু ব্যতিক্রমধর্মী। আমরা একটি স্টেট অব দ্য আর্ট অডিটোরিয়াম করেছি, যেখানে বিন্দুমাত্র প্রতিধ্বনি হয় না। আড়াই হাজার ছাত্রছাত্রীর ধারণক্ষমতার একটা কনকর্ড আছে। সব মিলিয়ে ইস্ট ওয়েস্ট এখন সমৃদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

ইস্ট ওয়েস্টের উচ্চশিক্ষা গবেষণা কার্যক্রম নিয়ে কিছু বলুন...

আমাদের নীতি হলো সবার ওপরে শিক্ষার মান। বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। তার পরও ইংরেজির ওপর আমরা বিশেষ জোর দিই। আমাদের অনেক শিক্ষার্থী গ্রাম থেকে আসে। তাই আমরা একটু বিশেষ চেষ্টা দিয়ে তাদের ইংরেজি শেখাই। মান নিশ্চিত করার কারণে শিক্ষার্থীরা আমাদের এখানে ভর্তি হতে বেশ আগ্রহী। সর্বশেষ সেমিস্টারে অ্যাপ্লিকেশন ছিল তিন হাজার, ভর্তি করেছি হাজার ২০০। আইনে মাত্র ৫০টা আসনের বিপরীতে প্রায় ৪০০ আবেদন জমা পড়ে। ফার্মেসিও খুবই সমৃদ্ধ বিভাগ। এখানে ১০০ আসনের জন্য ৪০০-৫০০ আবেদন পাওয়া যায়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক বলেছে, চাকরির ক্ষেত্রে ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয়। আমাদের এখন ৩০ জন অধ্যাপক রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কমিটিতে শিক্ষকমণ্ডলীই প্রধান থাকে। আমাদের এখানে ৩৫০ জন পূর্ণকালীন শিক্ষক আছেন, তাদের মধ্যে ১০০ জনই পিএইচডিধারী। বছরের শেষে গিয়ে ১২০ জনে উন্নীত করব। পিএইচডি শিক্ষক না হলে ছাত্রছাত্রীদের মনেও একটু খেদ থাকে। আবার অভিভাবকরাও চান পিএইচডি শিক্ষকে ভরা থাকুক।

আমরা কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনোভাবে কম নই; এটা স্বীকারও করে সবাই। কিন্তু আমাদের কোনো পিএইচডি থিসিস গাইড করতে দেয়া হয় না। এটা নিয়ে আমরা একটা প্রস্তাব দিয়েছি যে মার্চ ভাষণের ওপর একটা পিএইচডি থিসিস হোক; আমরা করব। আমরা একজন স্কলার নিয়োগ দেব। ইউজিসি বরাবর প্রস্তাব দিয়েছি। তারা অনুমোদন দেয়নি। তারা বলছে, আমরা যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে গিয়ে করি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ আমার সমকক্ষ হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাকিগুলো কী! তো কাজেই আমরা সেটাতে রাজি হব না। দিলে দিল না হলে নেই।

ইস্ট ওয়েস্ট কেন অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা?

করোনার কারণে ভর্তিচ্ছুদের ২০ শতাংশ ছাড় দিয়েছি, যা এখনো চলছে। কিন্তু শিক্ষকমণ্ডলী বা অন্য কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরি যায়নি। কারো বেতনও কমেনি। আমি প্রকাশ্য একটা চ্যালেঞ্জ দিই যে এভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় চালাতে পারবে না। আমরা পারছি কারণ আমাদের সদিচ্ছা আছে। অভিভাবক শিক্ষার্থী থেকে ব্যাপক সাড়া পাই। আমাদের এখানে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, নকল ইত্যাদির ব্যাপারে জিরো টলারেন্স। শক্ত আইন এর বাস্তবায়ন হয়। হাইকোর্টের নির্দেশ আছে। খুব শক্তিশালী একটা কমিটি আছে। আমরা চেষ্টা করি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য সকাল-সন্ধ্যা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা। আমরা আগামী সপ্তাহে ডে কেয়ার সেন্টার চালু করব। আমাদের অনেক মা শিক্ষক শিক্ষার্থী আছেন। সবার জন্য ইন্স্যুরেন্সের ব্যবস্থা আছে। ম্যাটার্নাল লিভের ব্যবস্থা আছে। আমরা নিয়মিত সমাবর্তন করি। কোনো সমাবর্তন বাদ দিইনি। অনেকে বলে, একটা সমাবর্তন না করা মানে কোটি টাকা সেভ হওয়া, কিন্তু আমরা সেটা মনে করি না। সমাবর্তন একজন ছাত্রের জীবনের অনেক বড় পাওয়া। তা থেকে আমরা তাদের বঞ্চিত করি না। সব সমাবর্তন আমরা আয়োজন করেছি। সমাবর্তনের সময় বার্ষিক একটা রিপোর্ট বের করি। ওখানে সব টাকা-পয়সার হিসাব থাকে। প্রতি বছর বাইরের অডিটর দিয়ে হিসাব করা হয়। আমাদের সাত কাঠা জায়গা আছে। ওটাকে ইনডোর গেমসের জন্য প্রস্তুত করছি। আপ্রাণ চেষ্টা করছি, আমাদের যে সাত বিঘা জমি কেনার চেষ্টা করছি, তাতে যেন আমরা আউটডোর খেলার মাঠ করতে পারি।

 

অনুলিখন: আনিসুর রহমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন