
অধ্যাপক ড. সহিদ আকতার হুসাইন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের এ অধ্যাপক এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি ছিলেন। এছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন, বিভাগীয় প্রধান, প্রভোস্ট, শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। সম্প্রতি ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে
ইস্টার্ন
ইউনিভার্সিটির যাত্রা
ও পথচলার
গল্প দিয়ে
শুরু করতে
চাই।
ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। চারটি অনুষদের অধীন পাঁচটি বিভাগ নিয়ে
ধানমন্ডিতে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে সরকারের নির্দেশনার আলোকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম স্থানান্তর হয়। সরকার ও কমিশনের নির্দেশনার আলোকে আশুলিয়ায় ১৭ বিঘা জমির ওপর স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হয়েছে। এ ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের জন্য খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বিনোদন কেন্দ্র সব ধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই, যেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষাগ্রহণের পাশাপাশি মানসিকভাবেও সতেজ ও সুস্থ থাকে। যারা এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা, তারা সবাই সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তারা এ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোনো সুবিধা নেন না। তারা চান এ বিশ্ববিদ্যালয় ধীরে ধীরে একটি আদর্শ বিদ্যাপীঠ হিসেবে গড়ে উঠুক।
একাডেমিক দিক থেকে মানসম্মত শিক্ষকরাই আমাদের শক্তির জায়গা। কারণ ইস্টার্নে শিক্ষক নিয়োগে কখনো মানে ছাড় দেয়া হয় না। আমরা টিচার নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো কম্প্রোমাইজ করি না। এক্ষেত্রে প্রথমে রিটেন পরীক্ষা, পরে ভাইভা এবং সবশেষে ডেমো ক্লাস হয়। এ তিনটা মিলিয়ে ‘বেস্ট অব দ্য বেস্ট’ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। আমরা মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান অনেকাংশেই শিক্ষকের ওপর নির্ভর করে। ভালো শিক্ষক ছাড়া ভালো গ্র্যাজুয়েট তৈরি সম্ভব নয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মোটো হচ্ছে—স্মার্ট ও দেশপ্রেমিক গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা।
আমাদের অন্যতম সেরা বিভাগের মধ্যে রয়েছে আইন, ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইংরেজি। আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক প্রতিযোগিতায় ভালো অবস্থান অর্জন করছে। জাতীয় কিছু প্রতিযোগিতায় অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কেও পেছনে ফেলছে। আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা কর্মবাজারে ভালো করছে। আমাদের একজন অ্যালামনাই গুগলে কাজের সুযোগ পেয়েছে। অন্য একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ থাকায় জয়েন করতে পারছে না। আইনের গ্র্যাজুয়েটরা জুটিশিয়াল সার্ভিস ও আইন পেশায় ভালো করছে। এ রকম ব্যাংক, করপোরেটসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ভালো ভালো অবস্থানে তারা রয়েছে।
ইস্টার্নের
অর্জনের ঝুড়িতে
গত ২০
বছরে কী
যুক্ত হলো?
অর্জন যদি বলি, ১৯ বছরে ছয়টি সমাবর্তনে ১২ হাজার গ্র্যাজুয়েট আমরা তৈরি করেছি, যারা নিজ দক্ষতায় দেশ ও বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে আমরা দক্ষ জনশক্তি সরবারহ করছি। ২০ বছরের জার্নিতে, পাঁচটা বিষয় নিয়ে শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এটা অনেক বড় অর্জন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় ৮-১০ বছরে এখনো শুরুই করতে পারেনি। সেখানে আমরা ছয়টা সমার্বতন করেছি; সপ্তম সমাবর্তনও আসন্ন। এটা একটা বড় অর্জন মনে করছি। আমি নিজেদের ভবনে আসতে পেরেছি; নিজস্ব জায়গায়। সেটা একটা অর্জন। খুশি হতাম যদি ডেভেলপমেন্ট পার্টটা আরেকটু শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়াতে পারতাম।
উপাচার্য
হিসেবে কোন
বিষয়টিকে গুরুত্ব
ও অগ্রাধিকার
দিয়ে কাজ
করছেন?
আমার গুরুত্বের বিষয়টি হলো শিক্ষার মান, ভালো শিক্ষক ও শিক্ষা পরিবেশের ওপর। আমি সবসময় শিক্ষার্থীদের বলি, তোমাদের প্রধান কাজ হলো পড়াশোনা ও ভালো রেজাল্ট করা। আমি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষণা ও শিক্ষকতার আগ্রহ রয়েছে কিনা সেটা দেখি। যেহেতু আমি বিজ্ঞানের লোক এবং এখনো আমি গবেষণা করি। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিগুলোকে এখনো গবেষণা করার অনুমতি দেয়া হয়নি। আমি মনে করি,
যেসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সক্ষমতা আছে, তাদের পিএইচডি ও এমফিল করার অনুমতি দেয়া উচিত। উচ্চশিক্ষার দ্বার কখনো বন্ধ করা যাবে না। আবারো বলি, আমার প্রধান কথা হচ্ছে আমি শিক্ষক। ভালো মানের শিক্ষক দিয়ে শিক্ষা দিতে চাই। এটাই হচ্ছে আমার প্রধান উদ্দেশ্য।
ইস্টার্নের
কোন বিভাগগুলো
শিক্ষার্থীরা বেশি
পছন্দ করছে?
পড়তে চায়?
একটা ভালো প্রশ্ন করেছেন। আমাদের এখানে আইন বেশি পড়তে চায়। তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়গুলো। যেমন—সিএসই, ইইই। ব্যবসায় শিক্ষারও চাহিদা রয়েছে। আরেকটা দুঃখজনক কথা হলো ইংরেজি বিষয় নিয়ে কেউ পড়তে চায় না। ছাত্রদের আমি কী করে বোঝাব জানি না। ইংরেজি এমন একটা সাবজেক্ট যেটা দিয়ে সব জায়গায় যাওয়া যায়। সেই ইংরেজি সাহিত্যে উদাসীনতা। আমাদের মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে তো এ সংস্কৃতিটা নেই। সাহিত্যের কালচারটা একটু কম। তাছাড়া আমাদের ছেলেমেয়েরা যেহেতু মফস্বল থেকে আসে সেহেতু তাদের ইংরেজিতে একটু দুর্বলতা থাকে। কিন্তু তারা ইংরেজির সম্ভাবনা বুঝতে চায় না। আরেকটা বিষয় হলো ইংরেজি সাহিত্য সাধারণত একটু এলিট শ্রেণির ছেলেমেয়েরা পড়তে পছন্দ করে। কিন্তু মধ্যবিত্তরা কেন পড়ে না, জানি না। ইংরেজি, অর্থনীতি, ইতিহাসে আগে যারা পড়াশোনা করত তারা ভালো করত। বিসিএসে আগে কিন্তু এরা ভালো করত। এখন আমাদের মধ্যবিত্তরা চায় কুইক জব। তারা মনে করে, সাহিত্যের মতো বিলাসী সাবজেক্ট দিয়ে কী করব! কিন্তু ইংরেজি পড়ে যে অনেক কিছু করা যায়, সেটা অনেকেই জানে না। একমাত্র ইংরেজিই আছে যার সারা দেশে চাহিদা রয়েছে। প্রতিটি কলেজে ইংরেজি আছে। হাজার হাজার শত শত স্কুল-কলেজে ইংরেজির শিক্ষক প্রয়োজন। কিন্তু সেই মনমানসিকতা তো আমার নেই। আমাদের এ জেনারেশনের মনমানসিকতা হলো স্কুলে-কলেজে চাকরির চেয়ে করপোরেট জব করব। স্কুল টিচাররা নাকি ভালো একটা বিয়েও করতে পারে না। অর্থাৎ তাদের স্ট্যাটাস নেই। এ জিনিসটাই দুঃখ যে সমাজে টিচার অথচ তাদের সামাজিক মর্যাদা নেই। এমনকি সরকারি স্কুলের শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদাটা অনেক নিচে। অথচ তারা কিন্তু আমাদের ভিত্তি। আমার ভিত্তিটা যদি ভালো না হয়, তাহলে তো চলবে না।
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় একটা সুযোগ হয়েছে। তা হলো আমি যে সাবজেক্ট পড়তে চাই, সেটাতেই পড়তে পারব। পাবলিকে সে সুযোগ নেই। আমি পড়তে চেয়েছিলাম ফার্মেসি, কিন্তু পেয়েছি বোটানি বা জুওলজি।
শিক্ষার্থীদের
আপনারা শ্রেণীকক্ষের
পাঠদানের বাইরে
আর কী
ধরনের সুযোগ-সুবিধা
দিয়ে থাকেন?
আমাদের প্রত্যেকটা ল্যাব অনেক উচ্চমানের ও ব্যয়বহুল। সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার রয়েছে। রিডিং রুম আছে। মেডিকেল সেন্টার আছে, যেখানে সার্বক্ষণিক নার্স। মানসিক স্বাস্থ্যসেবায় কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। ডে-কেয়ার সেন্টারও রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ২১টি ক্লাব বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম চালাচ্ছে, যেখানে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা দিই। রোভার স্কাউট আছে। অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন আছে। খেলাধুলার সুন্দর ব্যবস্থা। যাতায়াতের জন্য বাস। সব মিলিয়ে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সুবিধা আমরা দিচ্ছি।
গবেষণার
ক্ষেত্রে কী
ধরনের উদ্যোগ
নিচ্ছেন?
গবেষণা খাত নিয়ে চিন্তায় আছি। আমাদের ফান্ড আছে, কিন্তু তা ইউটিলাইজ হয় না। আমার শিক্ষকদের একটু অনীহা আছে রিসার্চের ব্যাপারে। এজন্য একটা পলিসি নেব যে যার পাবলিকেশন নেই, তার প্রমোশন হবে না। একটু কঠোর হতে হয়। আমার ফান্ড না থাকলে না হয় কথা ছিল। আমার ফান্ড ইউটিলাইজ করতে চাই। গবেষণায় জোর দিতে চাই।
বিশ্ববিদ্যালয়
নিয়ে আপনার
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কী?
অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা রয়েছে। আরো স্পেস দরকার। আমি থাকাকালীন এটাকে আরো সুন্দর করতে চাই। একটা গেট দরকার। নতুন সাবজেক্ট করতে গেলে স্পেস লাগবে। একটা অডিটরিয়াম দরকার। আরো ভালো ভালো ফ্যাকাল্টি নিয়ে আসতে চাই। সব মিলিয়ে আগামী চার বছরে এটাকে একটা টপ লেভেলের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে নিয়ে যেতে চাই।
শিক্ষা
ব্যবস্থা নিয়ে
আপনার সার্বিক
পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে
বলুন...
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন কাজে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলাম। ইস্টার্নেও প্রথম মেয়াদে চার বছর দায়িত্ব পালনের পর এবার দ্বিতীয় টার্ম চলছে। এসব অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে আমি যেটা বলব, ছাত্রদের পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ কমে গেছে। কেমন যেন একটা অস্থিরতা আছে। তারা পড়াশোনা বা ক্লাসমুখী নয়। বাইরের দিকে তাদের নজর বেশি। তারা না পড়েই সার্টিফিকেট চায়। এখন সেটা তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। পড়াশোনার মান একটু কমেছে। আর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির সংখ্যা অনেক বেড়েছে।