
অধ্যাপক ড. মাহফুজুর রহমান রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক। ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে দায়িত্ব পালন করছেন বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজির উপাচার্য হিসেবে। সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে।
আমরা
জানি, এটি
একটি বিশেষায়িত
বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমেই
এর বিশেষ
দিকগুলো জানতে
চাই?
প্রথমত, বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হলো বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি। এ নামের মধ্যে আরএমজি (তৈরি পোশাক) এবং টেক্সটাইল বিষয় নেই। কিন্তু আমাদের বৈশিষ্ট?্য
হলো, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক এবং টেক্সটাইল ও বস্ত্র খাতের জন্য যে ধরনের বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন, তাদেরকে তাত্ত্বিক জ্ঞান ও ব্যবহারিক শিক্ষা প্রশিক্ষণ দেয়া। এ বিষয়ে বর্তমান বিশ্বে এবং আমাদের এশিয়া অঞ্চলে একই সঙ্গে দেশের ভেতরে নতুন যে বিষয় আসছে; বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে যে কৌশল রপ্ত করা প্রয়োজন এবং তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক জ্ঞান সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা, সেসব কথা মাথায় রেখে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এটিই আমাদের প্রধান বিশেষত্ব।
উপচার্য
হিসেবে দায়িত্ব
নেয়ার পর
কোন কোন
বিষয়কে অগ্রাধিকার
দিয়ে কাজ
করছেন?
প্রথমত, আমি খেয়াল করলাম বিশ্ববিদ্যালয়টি তো বেশ নতুন। আমাদের যতগুলো কোর্স আছে তার অনেকগুলোই প্রচলিত ধাচের কোর্স। যে কোর্সগুলোকে কিছুটা আধুনিকায়ন করা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে যে বিষয়টি আমার নজরে এসেছে তা হলো প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং, ফ্যাশন, নিটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বিষয়গুলোয় থিওরি একটু বেশি, কিন্তু কারখানায় বাস্তবে যেসব কাজ হয় এবং নতুন নতুন যে বিষয়গুলো আসছে সেগুলো নেই। তাই এগুলোকে আধুনিকায়ন করা আমার প্রথম অগ্রাধিকারের বিষয়। শুরু থেকেই এগুলোকে নবায়নের কাজ করছি। দ্বিতীয়ত, সারা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনায় কতগুলো বিষয়ের প্রতি জোর দিতে বলা হয়েছে। এসবের মধ্যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—শিক্ষাক্রমকে আউটকামভিত্তিক করা এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপাদানসমূহ অন্তর্ভূক্ত করা এবং এর মধ্যে আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি বাজারের জন্য যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা। এ কাজ দুটো আমার নজরে এসেছে। এগুলোকে লক্ষ্য করেই আমার কার্যক্রম এখন চলছে।
এ বিশ্ববিদ্যালয়
থেকে তৈরি
পোশাক শিল্পের
জন্য শুধু
গ্র্যাজুয়েট তৈরি
হচ্ছে নাকি
উদ্যোক্তাও সৃষ্টি
হচ্ছে?
উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, তবে খুব যে বেশি হচ্ছে তা নয়। আমরা যে এমপ্লয়াবিলিটি নিয়ে কাজ করছি তার আওতায় আপনা আপনি উদ্যোক্তা তৈরি হবে। এর একটা উদাহরণ আমরা এরই মধ্যে দেখতে পেয়েছি। বিশেষ করে করোনাকালে আমাদের অনেক গ্র্যাজুয়েট নিজেরাই উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছে। কেউ কেউ করোনা প্রতিরোধী মাস্ক, আবার কেউ কেউ স্যানিটারি ম্যাটেরিয়ালস তৈরির কারখানা স্থাপন করেছে। এবং সেখানে তারা ভালোই সফলতা পেয়েছে। অর্থাৎ আমরা উদ্যোক্তা তৈরি হতে দেখছি। আশা করছি, উদ্যোক্তাদের একটা তালিকা দ্রুতই আমরা পেয়ে যাব। অনেকে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে গেছেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স কিন্তু মাত্র ১২ বছর। এর মধ্যে ৬ বছরের পড়াশোনা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়া শেষ করে চাকরি করছেন। আবার উদ্যোক্তাও হয়েছেন।
চতুর্থ
শিল্প বিপ্লব
সামনে রেখে
এ বিশ্ববিদ্যালয়ে
গবেষণা সুবিধা,
লাইব্রেরি, ল্যাবসহ
অন্য সুযোগ-সুবিধা
পর্যাপ্ত কিনা?
বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন অ্যান্ড টেকনোলজি যে কারণে আপনাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে সেটি হলো আমাদের সুসজ্জিত ৫২টি ল্যাব আছে। এছাড়া একটি পূর্ণাঙ্গ টেক্সটাইল কম্পোজিট ইউনিট আছে। এ ধরনের সুবিধা খুব কম বিশ্ববিদ্যালয়েই পাওয়া যেতে পারে। আমাদের ক্লাসরুমগুলোর প্রতিটিতে পড়ানোর সক্ষমতা ৭০ জন হলেও আমরা সবসময় ধারণক্ষমতার চেয়ে কম সংখ্যক শিক্ষার্থী অর্থাৎ ৪০ থেকে ৪৫ জন ভর্তি করাই। সর্বোচ্চ ৫০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে থিওরিটিক্যাল ক্লাস নেয়া হয়। এবং প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে সর্বোচ্চ ১০-১২ জন থাকে। আমরা যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার চেষ্ট করি। এর ফলে দেখা যায় যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শুধু লেকচারার নিয়োগ দেয় কিন্তু আমাদের এখানে এমন নয়। আমাদের এখানে শিক্ষকদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক সহকারী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক পদে নিয়োজিত আছেন। তবে আমাদের জনবলের এখনো কিছু সংকট রয়ে গেছে। আমাদের আরো কিছু শিক্ষক রয়েছেন যারা বিদেশে ডিগ্রি নেয়া। ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষক আমাদের শিক্ষা ছুটিতে আছেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, সারা দেশে অনেকেই শিক্ষকতা পেশায় থেকে উচ্চশিক্ষার সুযোগ লাভের পর আর দেশে ফেরেন না। যদি ফিরতেন তাহলে হয়তো আরো বেশি গুণগত শিক্ষা প্রদান করতে পারতাম। তাই উচ্চশিক্ষা শেষে দেশে ফেরার প্রতি আগ্রহ বাড়াতে দুটি প্রণোদনামূলক পদক্ষেপ নিয়েছি।
শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর
উচ্চপদে বিদেশী,
বিশেষ করে
ভারতীয়, পাকিস্তানি
ও শ্রীলংকান
নাগরিকদের উপস্থিতি
বেশি। এ
পদগুলোয় বাংলাদেশীরা
কেন আসতে
পারছেন না?
এক্ষেত্রে শিক্ষার
সুযোগ আমাদের
দেশে পর্যাপ্ত
কিনা?
মোটেই পর্যাপ্ত না। বাস্তবতা হচ্ছে এখনো আমাদের দেশে তৈরি পোশাক খাত ও টেক্সটাইল খাতের মাঝারি ও উচ্চপর্যায়ে প্রচুর পরিমাণ বিদেশী নিয়োজিত আছে এবং তারা আমাদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। সেজন্য আমাদের শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করি একটি কথা বলে—নিজেদের ক্যারিয়ারে সফল হওয়াই তোমাদের লেখাপড়া করার একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। আমরা দেশের জন্য নিজস্ব সম্পদ তৈরি করতে চাই। যাতে করে এ শিল্পে বিশেষজ্ঞের ক্ষেত্রে পরনির্ভরতা দ্রুত কাটিয়ে উঠতে পারি। যাতে তারা তোমাদের যে ন্যায্য জায়গা সেখান থেকে বঞ্চিত করতে না পারে। এবং একই সঙ্গে তারা যেন আমাদের কষ্টার্জিত মুদ্রা এক দেশ থেকে অন্য দেশে নিয়ে যেতে না পারে। সেক্ষেত্রে আমরা এরই মধ্যে সফলতা পেতে শুরু করেছি। আবার ব্যাপক সংখ্যক শিল্পোদ্যোক্তা আমাদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। তারাই আমাদের বোর্ড অব গভর্ন্যান্সের সদস্য। তাই তারা তাদের প্রতিষ্ঠানে আমাদের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নি হিসেবে কাজ করার সুযোগ দিচ্ছেন। সুতরাং ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমি কোলাবরেশনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করছি। এভাবে অচিরেই এ পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটবে বলেও আমি মনে করি।
তৈরি
পোশাক শিল্পে
একবিংশ শতাব্দীর
চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায়
এ বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষার্থীরা কতটা
প্রস্তুত?
এটা বলা মুশকিল। তবে আমি যেটা বলতে পারি, আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া গ্র্যাজুয়েটরা বিভিন্নভাবে সফলতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। আর তৈরি পোশাক শিল্পের বর্তমান যে অবস্থা, এক্ষেত্রে একটি মাত্র তথ্য দিলেই আপনারা বুঝবেন। আমাদের সামর্থ্য, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতার সামর্থ্য সবই ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন থেকে মাত্র আড়াই বছর আগে বিজিএমইএ একটি ঘোষণা দিয়েছিল, বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের রফতানি ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। অনেকের মুখে এটা অসম্ভব মনে হয়েছিল। কিন্তু এ কঠিন সময়ের মধ্যেও ৪৪-৪৫ বিলিয়ন ডলার পোশাক বিক্রি করছে। এটা কি একটা ইন্ডিকেটর না! সুতরাং আমাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার সক্ষমতা রয়েছে। তবে আমাদের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য আরো কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা দরকার।
পোশাক
খাত কেন্দ্র
করে একাডেমিকভাবে
কী কী
চ্যালেঞ্জ রয়েছে?
সবচেয়ে বড় সমস্যা বৈশ্বিক এনভায়রনমেন্ট কমপ্লায়েন্স। এ জায়গাটায় বিশ্ব যেমন এগিয়ে গেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি এগিয়ে গেছে নীতিনির্ধারকরা। আমরা গার্মেন্টস শিল্পে পরিবেশ বান্ধব পদক্ষেপ নেয়ার আগেই বিশ্বের রাজনীতিবিদরা আরো অনেক বেশি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছেন। এটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলাটা আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা এ খাতে ক্যারিয়ার গড়ার দিকে ঝোঁকেনি। তারা মনে করে, এর চেয়ে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিসিএস ক্যাডার, ব্যাংকার হওয়া ভালো এবং পছন্দনীয়। অথচ এখানে ক্যারিয়ার ডেভেলপ করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। সুতরাং মেধাবীদের বোঝানো একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো, এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বিষয়ে জ্ঞানস্বল্পতা রয়েছে। কারণ তারা হয়তো মানবিক নয়তো ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র। তাই এ শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান দিয়ে কারিগরি শিক্ষা দেয়া আরেকটি চ্যালেঞ্জ।
এ বিশ্ববিদ্যালয়
নিয়ে আপনার
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
কী?
আমি খুব বেশি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখি না। অনেকে বলেন, মাত্র ছয় হাজার শিক্ষার্থী নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চালাচ্ছেন। আপনার হওয়া উচিত ২০-৩০ হাজার শিক্ষার্থী। আমি এটা কল্পনা করি না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চিন্তা এমন যে শিক্ষার্থী সংখ্যা ছয় থেকে ১২ হাজারে উন্নীত করা যেতে পারে। এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে স্মার্ট, আধুনিক ও কোয়ালিটিফুল গ্র্যাজুয়েট তৈরি করা। আমি এখানটায় গুরুত্ব দিতে চাই। এজন্য কারিকুলাম সমৃদ্ধ করা, ল্যাব সুযোগসুবিধা বাড়ানো, ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সম্পর্ক বাড়ানো, শিক্ষার উন্নত পরিবেশ ও যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ অর্থাৎ গুণগত শিক্ষার ওপর জোর দিতে চাই। এটাই আমার লক্ষ্য ও পরিকল্পনা।