আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের মেলে ধরতে প্রস্তুত ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা

চট্টগ্রামের সন্তান সাঈদ আল নোমান তার হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি। আমেরিকার সেন্ট্রাল মিশিগান ইউনিভার্সিটি, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে পড়ালেখা শেষ করার পর দেশ-বিদেশে নেতৃত্ব তৈরিতে সক্ষম একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। শুরু থেকে চলার পথে নানান দিক নিয়ে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে সে স্বপ্ন বাস্তবায়নের ভিন্ন ভিন্ন দিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বণিক বার্তার চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান রাশেদ এইচ চৌধুরী

বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শুরুর গল্পটা বলুন।

শুরুর কথা বলতে গেলে আমার মায়ের কথাই বলব সবার আগে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী এবং পরবর্তী সময়ে ইকোনমিকসের অধ্যাপক ছিলেন। আমার বাবাও একটি কারণ। আমি ছোট থেকেই তাকে সোশ্যাল ওয়ার্কার হিসেবে সবসময় দেখে এসেছি। সেই অর্থে শিক্ষার জগতে এমন একটি প্রতিষ্ঠান দাঁড় করানো আসলে মায়ের পেশা বাবার যে প্যাশন দুয়ের সংমিশ্রণের ফল। আমার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পেছনে আরো অনেক মানুষের ভালোবাসা সম্পৃক্ত হয়েছে। যাদের প্রজ্ঞা দিকনির্দেশনা এখানে যুক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আসছি একেবারে শুরু থেকেই।

বিদেশে পড়ালেখার সময় সেখানকার গবেষণা কার্যক্রমগুলো আমাকে খুব আকর্ষিত করে। আমি ভাবতাম বাংলাদেশে মানের বিশ্ববিদ্যালয় কোন দিন হবে? পরে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট শেষ করার পর আমি লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসে পাবলিক পলিসিতে মাস্টার্স করি। এরপর অক্সফোর্ডে এমফিল করি কমপ্যারিটিভ সোশ্যাল পলিসিতে। এসব করার পেছনে কারণ ছিল চট্টগ্রামে এমন একটা প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাব যে প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক মানের একটি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে।

ইস্ট ডেল্টার নামকরণ স্থান নির্বাচনের পেছনের গল্প জানতে চাই।

ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির নামকরণ একটি অর্থ বহন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চট্টগ্রামকে ধারণ করার মানসিকতাও কিন্তু প্রতিফলিত হচ্ছে নামকরণে। ডেল্টা শব্দের অর্থ বদ্বীপ। বাংলাদেশের ভূখণ্ডটি মূলত গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার অববাহিকায় সৃষ্ট বদ্বীপ। এই বদ্বীপের ইস্ট বা পূর্ব অংশটি হলো চট্টগ্রাম। অর্থাৎ ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির মানে হচ্ছে পূর্ব বদ্বীপ তথা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আবার ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির অ্যাব্রিভিয়েট করলেও এডু অর্থাৎ এডুকেশন যদিও এটা প্ল্যনের অংশ না হলেও অদ্ভুতভাবে মিলে গেছে। ফলে এখানে দারুণ একটা ভালো লাগা কাজ করেছে আমাদের। যেহেতু ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির মাধ্যমে চট্টগ্রামকে বিশ্বের দরবারে তুলে আনতে চাই সেই অর্থেও নাম দ্বারা একটি সার্থকতা খুঁজে পেয়েছি বলে মনে করি। বিশ্ববিদ্যালয় আমি ঢাকায়ও করতে পারতাম। যখন শুরু করি তখন চট্টগ্রামে উচ্চশিক্ষার অপ্রতুলতাই আমি দেখতে পেয়েছি। এছাড়া চট্টগ্রামেই আমার শেকড় আমার বাবাও একমত হয়ে অনেকটা সাহস দিলেন এবং বললেন চট্টগ্রাম থেকেই উদ্যোগ নেয়া দরকার। আর এভাবেই স্থান নির্বাচন করা।

ঢাকার বাইরে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ার পরিকল্পনা এল কী কারণে?

বিভিন্ন কারণেই আমাদের সবকিছুতে ঢাকামুখী নীতি তৈরি হয়েছে। এজন্য চট্টগ্রাম কিংবা দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহর সেভাবে মনোযোগ পায়নি। পাবলিক পলিসির ছাত্র হিসেবে বলতে পারি আমাদের যাদেরই উদ্যোগগুলো নেয়ার সুযোগ সামর্থ্য আছে তারা যদি এগিয়ে না আসে তাহলে পিছিয়েই থাকা হবে। যদিও এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। উদাহরণ হিসেবে বলি, আমাদের ইউনিভার্সিটি আজ ঢাকায় অবস্থিত হলে যদি ১০০ মাইলে দৌড়াতে চাইতাম তবে চারদিকে একটা সহায়ক পরিবেশের কারণে হয়তো ২০০ মাইলের একটা গতি পেয়ে যেতাম। কিন্তু ঢাকার বাইরে হওয়ার কারণে সেই ১০০ মাইল বেগের চাওয়াটা ৩০- নেমে আসে। কেননা ঢাকার বাইরে পলিসি সাপোর্ট সেভাবে তৈরি হয়নি।

আপনাদের ভিশন নিয়ে কিছু বলুন।

চেষ্টা করে চলেছি আন্তর্জাতিক মানের উচ্চশিক্ষা গ্রহণে দেশের এবং দেশের বাইরের শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামে এসে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পায়। এমন এমন সাবজেক্ট নির্বাচন করছি যেগুলো বাংলাদেশের কোথাও চালু হয়নি। আমরা মাস্টার অব পাবলিক পলিসি অ্যান্ড লিডারশিপ পড়াচ্ছি। লিডারশিপকে ট্যাগ করে পাবলিক পলিসি এমন একটি ইউনিক প্রোগ্রাম দাঁড় করিয়েছি যেটি অন্য কোথাও পাবেন না। রকম আরেকটি হলো এমএসসি ইন ডেটা অ্যানালিটিকস অ্যান্ড ডিজাইন থিংকিং ফর বিজনেস। এটা একটা অনন্য প্রোগ্রাম যেখানে আমরা মনে করছি এখন ডেটা সায়েন্স নিয়ে কাজ করা দরকার। এটাও আমরা প্রথম একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শুরু করেছি। উদাহরণগুলো এজন্যই দিচ্ছি কারণ এতে করে বুঝতে সহজ হবে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি কোনো ধরনের ভিশন নিয়ে কাজ করছে। প্রকৃতপক্ষে ইমপ্যাক্টফুল হবে সোসাইটিতে এমন প্রোগ্রাম নিয়ে কাজ করছি। বিদেশ থেকে শিক্ষক এসে পড়াচ্ছেন। এখন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট লেভেলেই আমরা টেকনোলজি, ডেটা অ্যানালিটিকস, হিউম্যান রিসোর্স ইনফরমেশন সিস্টেমস, অ্যাকাউন্টিং ইনফরমেশন সিস্টেমস, মার্কেটিং অ্যান্ড অ্যানালিটিকস চালু করার পদক্ষেপ হিসেবে এর উপযুক্ত সিলেবাস এর মধ্যে প্রস্তুত করা হচ্ছে। রোবটিকস, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভার্চুয়াল রিয়েলিটি অ্যান্ড মেন্টাল রিয়েলিটি, ন্যানো টেকনোলজি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে একটি ফিউচার ফ্যাক্টরি ইন ল্যাব তৈরি করছি, যেখানে ডেটা উন্মুক্ত থাকবে। ফিউচার ফ্যাক্টরির একটা ডেমু স্টেশনও করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে খেয়াল রেখে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা, সৃজনশীলতা উদ্ভাবনী শক্তি বিকাশে কাজ করছে বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাপদ্ধতিও সেভাবেই অনুসরণ করা হচ্ছে যেন বিদেশ থেকেও আমাদের এখানে আসতে উদ্বুদ্ধ হবে শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব কী?

আমরা বিশ্বাস করি গুণগত গবেষণার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির মর্যাদা নির্ভর করে। গবেষণা না হলে নতুনভাবে নলেজ ডেভেলপ করবে না। আর এটা না হলে একটা সাসটেইনেবল সোসাইটিও গড়ে উঠবে না। আমাদের বাজেটে গবেষণা খাত সর্বাধিক গুরুত্ব পায়। এর কারণেই গত কয়েক বছরে ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটি অসাধারণ অনেক পাবলিকেশনসের দাবিদার। রোবটিকসসহ নানা ক্ষেত্রে গবেষণা নেতৃত্বের চর্চা করার সুযোগ তৈরি করা আমাদের একটি বড় লক্ষ্য। এছাড়া টিচিং মেথডোলজিতে নিয়ে এসেছি যেসব মেটো সেখানে রয়েছে ডোমিন নলেজ, সফট স্কিলস গ্লোবাল সিটিজেনশিপ। নিয়েই পরিচালিত হচ্ছে একাডেমিক কার্যক্রম। বিতর্ক, সাংস্কৃতিক চর্চা, খেলাধুলাসহ নানা বিষয়ভিত্তিক ক্লাব সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করছে।

কারা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত করছে সেটি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি উচ্চশিক্ষার ভালো মানের শিক্ষকের অপরিহার্যতা রয়েছে। ভালো উদ্দেশ্য থাকলে ফ্যাকাল্টি রিকোয়ারমেন্টটাও সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে করা হয়। প্রশাসনও সেভাবেই দাঁড় করানো হয়। ভর্তির ব্যাপারে আমরা কখনই সংখ্যাত্মক হিসাব অনুসরণ করি না। পাঠদানের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে এমনভাবে ক্লাসরুমের পরিসর ঠিক করেছি যেন কোনোভাবেই একটি কক্ষে ৩৫ জনের বেশি শিক্ষার্থীর আসন বিন্যাস না হয়। আমাদের একটা ডিভিশনই আছে যারা পুরোপুরি বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে। এক যুগ ধরেই সেসব ইউনিভার্সিটির সঙ্গে আমরা বিভিন্নভাবে পার্টনারশিপে কাজ করে চলেছি। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপের স্বনামধন্য এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম কিংবা শিক্ষার্থীদের ট্রান্সফার হওয়ার সুবিধার্থে প্রয়োজনে সিলেবাসের পরিবর্তনেও গুরুত্ব দেয়া হয়।

স্বপ্ন বাস্তবায়নের কতটা পথ পাড়ি দিয়েছেন বলে মনে করছেন।

অর্জনের ক্ষেত্রে আমি বলব এখনো অনেক পথ চলা বাকি। প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনেক কিছুই করা বাকি আছে। সে অর্থে পথচলা শুরুই হয়েছে বলব। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রস্তুতি রাখতে হবে সবসময়। আমরা কাজ করেই যাব। সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেকে মেলে ধরতেই প্রস্তুত হচ্ছেন ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন