কয়েক বছর ধরে দেশে ভিটামিন ডির ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি

ডা. মো. খলিলুর রহমান। বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের সাবেক মহাপরিচালক। দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পুষ্টি কার্যক্রম মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে কাজ করেছেন। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও কাজ করেছেন সাবেক এ কর্মকর্তা। দেশের মানুষের ভিটামিন ডি ঘাটতির কারণ, ঘাটতি মোকাবেলায় করণীয়, সীমাবদ্ধতা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

ভিটামিন ডির ঘাটতি কী? কী কী কারণে ঘাটতি হয়?

সূর্যের আলো যখন আমাদের শরীরে পড়ে তখন ভিটামিন ডি তৈরি হয়। কোনো মানুষ যদি দিনে আধা ঘণ্টা রোদে শরীরের কিছু অংশ উন্মুক্ত রেখে ঘোরাফেরা করে তাহলেই অনেকখানি ভিটামিন ডির চাহিদা পূরণ হয়ে যায়। পাশাপাশি খাবার দিয়েও এ ঘাটতি পূরণ করা যায়। কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে ভিটামিন ডির ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। আগে মনে করা হতো বাংলাদেশের মানুষ যেহেতু মাঠে-ঘাটে কাজ করে তাই আমাদের দেশে ঘাটতি কম। কিন্তু তখন আমাদের ভিটামিন ডি মাপার মতো মেশিন বা ইকুইপমেন্ট ছিল না। যখন মানুষ মাপা শুরু করল দেখা গেল লেভেলটা অনেক কম। আইসিডিডিআর,বির এক জরিপেও একই চিত্র দেখা গেছে এবং মাত্রাটা অন্যান্য দেশের থেকে কম।

ক্যালসিয়াম আর ফসফেটের ঘাটতিই কি ভিটামিন ডির ঘাটতি?

তা নয়, তবে ভিটামিন ডির গুরুত্বটা ওই জায়গাতেই। ক্যালসিয়াম ও ফসফেটের ঘাটতি পূরণ করতে গেলে ভিটামিন ডির সাহায্য লাগে। ভিটামিন ডি না থাকলে ক্যালসিয়াম অ্যাবজর্ব হয় না। ফলে এর ঘাটতি হওয়ার সঙ্গেই ক্যালসিয়াম ও ফসফরাসের অভাব দেখা দেয়।  

কোন বয়সে ভিটামিন ডির ঘাটতি বেশি দেখা যায়?

সাধারণত প্রাপ্তবয়স্ক থেকে বয়স্কদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। বয়স্কদের বেশি দেখা যায় কারণ তারা রোদে যায় না। খাদ্যাভ্যাসের কারণেও এ ঘাটতি দেখা যায়। আগে যারা স্কুল-কলেজে যেত তারা মাঠে খেলত। ইদানীং সে সুবিধা নেই। তাই ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। 

অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে ভিটামিন ডি লেভেলের ঘাটতির পরিমাণটা কেমন দেখছেন?

আমাদের দেশে এখনো এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশদ গবেষণা হয়নি। ছোট ছোট গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ভিটামিন ডির লেভেল স্বাভাবিকের থেকেও অনেক কম। 

শীতপ্রধান দেশ না হওয়ায় বাংলাদেশের মানুষ পর্যাপ্ত সূর্যের আলো পায়, সেখানে ভিটামিন ডির ঘাটতি হচ্ছে কেন?

হতে পারে কিছু মেকানিজম বা অন্তর্নিহিত বিষয় রয়েছে, যে কারণে ভিটামিন ডি কার্যক্রমটা ঠিকভাবে হচ্ছে না। সেটা হয়তো খাবার ঠিকমতো অ্যাবজর্ব করতে পারছে না অথবা আননোন কোনো ফ্যাক্টর আছে। কেন হচ্ছে তা খুঁজে দেখা দরকার।

অন্যান্য ভিটামিনের তুলনায় ভিটামিন ডির ঘাটতি কি আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে বেশি?

আমার মনে হয় সাম্প্রতিক সময়ে বেশিই হবে। অন্যান্য ভিটামিনের ঘাটতি সেভাবে চোখে পড়ে না। যেমন এ, বি, সি, ই, কে ভিটামিনের ঘাটতির যেসব লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায়, সেগুলো খুব অপ্রতুল। কিন্তু ভিটামিন ডি কেন জানি টিপ অব দি আইসবার্গের মতো মনে হচ্ছে। তাই অন্যান্য ভিটামিনের থেকে ভিটামিন ডির ঘাটতি বেশি। 

ভিটামিন ডি ঘাটতি প্রতিরোধ ও প্রতিকারে আমাদের কী কী করণীয় রয়েছে।

প্রথম কাজ হচ্ছে আমাদের দেখতে হবে ভিটামিন ডির উৎস কোথায়। সেসব যদি আমরা খাবারের অভ্যাস দিয়ে পূরণ করতে পারি তাহলে ভিটামিন ডির ঘাটতি পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আরেকটা হচ্ছে শিশুদের রোদে খেলতে দেয়া। আর যারা বয়স্ক তাদেরও জীবনযাপনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। একটু কর্মক্ষম রাখলে ভিটামিন ডির ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। তার পরও যদি না হয় তাহলে বড় আকারের জরিপ করে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচি নেয়া যেতে পারে।

ভিটামিন ডি ঘাটতির বিষয়টি কেন সাধারণ মানুষের জানাশোনার বাইরে থেকে যাচ্ছে?

কভিডের আগে যারা স্বাস্থ্য বিষয়ে প্রফেশনাল তারাও ভিটামিন ডি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায়নি। কিন্তু কভিডের সময়ে দেখা গেল, যাদের ইমিউনিটি কম তারা কভিডে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আর ভিটামিন ডি লেভেল কম হওয়াই ইমিউনিটি কম হওয়ার কারণ। যেহেতু গুরুতর কোনো উপসর্গ আসে না, তাই সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা নেই। এখন আমাদের উচিত সাধারণ জনগণকে এ বিষয়গুলো জানানো ও সচেতনতা বাড়ানো।

দেশের মানুষের ভিটামিন ডি ঘাটতি প্রতিরোধসহ পরিপূর্ণ পুষ্টি নিশ্চিতে কী নীতি নেয়া উচিত? সেসব বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

নিউট্রিশনকে আমরা কোনো সময় গুরুত্ব দিইনি। পুষ্টিমানের বিচারে আমরা কখনো খাবার খাইনি। আমরা পেট ভরার উদ্দেশ্যে খাই। পুষ্টি বিবেচনায় খাবার খেলে অনেক কিছুই ওভারকাম করা যাবে। শুধু ভিটামিন ডি নয়, পুষ্টিসম্পর্কিত আরো অনেক বিষয়েই সাধারণ মানুষের সচেতন হওয়া উচিত। যেসব খাদ্য প্যাকেটজাত, সেখানে পুষ্টি উপাদান সঠিকভাবে উল্লেখ করে দেয়া উচিত। পাশাপাশি সামাজিকভাবে একটা ব্যাপক প্রচার-প্রচারণাও দরকার আছে। সুস্থ জাতি গঠন করতে চাইলে আদর্শ খাবার বা ব্যালান্সড ডায়েট ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব না। মানুষকে সচেতন করার জন্য ব্যাপক প্রচারণা দরকার। সেই সঙ্গে জীবনযাত্রায়ও পরিবর্তন আনতে হবে। 

আপনি দীর্ঘদিন ধরে সরকারের পক্ষে পুষ্টি কার্যক্রমের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এসব কার্যক্রমের ঘাটতি নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ জানতে চাই। 

পুষ্টি বিষয়ে সরকারি পর্যায়ে বড় ধরনের কার্যক্রম আমাদের ছিল না। ভিটামিন এ সাপ্লিমেন্ট বা সম্পূরক দেয়াই সরকারের একমাত্র মাঠ পর্যায়ের পুষ্টি কার্যক্রম। পুষ্টি কার্যক্রম একক কোনো বিভাগের কাজ না। সব মন্ত্রণালয় ও শাখার সবাইকেই পুষ্টির দিকে একটু নজর দিতে হবে, তা না হলে অনেক সময় লাগবে। সেগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করার জন্যই বাংলাদেশ ন্যাশনাল নিউট্রিশন কাউন্সিল তৈরি হয়েছে। আমি মনে করি নীতিগতভাবে আমাদের সবকিছু ঠিক আছে, নীতিও ঠিক আছে কিন্তু সেটা বাস্তবায়ন করার জায়গায় সমস্যা আছে। সেই বাস্তবায়ন আরো জোরালোভাবে ও সবাইকে সঙ্গে নিয়ে করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন