সময়ের ভাবনা

সবুজ অর্থনীতি ও বাংলাদেশের সামগ্রিক বাস্তবতা

নিজাম আশ শামস

বাংলাদেশে অবকাঠামো দুর্বলতা কাটানোর জন্য প্রচুর নির্মাণযজ্ঞ চলছে। তবে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবেশের ওপর। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় করে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনার মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে। এসব মডেলে প্রকৃতিকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের জায়গায় রাখা হচ্ছে। আধুনিক অর্থনীতিবিদরা প্রকৃতির সঙ্গে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ যোগসূত্র আবিষ্কার করেছেন। তারা দেখিয়েছেন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে অর্থনীতি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অর্থনীতির এ নবধারণা সবুজ অর্থনীতি নামে পরিচিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সবুজ বিনিয়োগ ও সবুজ ব্যাংকিংয়ের মডেল। পরিবেশের কোনো ক্ষতি না করে কীভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যায়, সেটিই সবুজ অর্থনীতির মূল আলোচ্য বিষয়। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এসব ধারণা এরই মধ্যে পরিচিতি লাভ করেছে। তবে বাংলাদেশে সবুজ অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা, নিয়ম-কানুন ইত্যাদি তৈরি হলেও কাঠামোগত কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ কারণে বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ব্যাপক হারে। এর প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতেও। 

২০২২ সালের জুনে প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বাংলাদেশের উন্নয়ন বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর শিরোনাম ‘ক্রিয়েটিং আ গ্রিন অ্যান্ড সাসটেইনেবল গ্রোথ পাথ ফর বাংলাদেশ’। এ প্রতিবেদন অনুসারে, পরিবেশের অবনমনের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ ৬৫০ কোটি ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এ পরিমাণ বাংলাদেশের বার্ষিক জিডিপির ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ আছে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যুর ২৮ শতাংশ সংঘটিত হয় পানি এবং বায়ু দূষণের কারণে। এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্সের (ইপিআই) বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বাধিক দূষিত ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম। ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেড ক্রস অ্যান্ড রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিস (আইএফআরসি) প্রকাশিত ওয়ার্ল্ড ডিজেস্টারস রিপোর্ট-২০১৮ অনুসারে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় দিয়ে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ১৯৮০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশ প্রায় ৪২৯টি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে আছে ভূমিকম্প, বন্যা, ভূমিধস, টর্নেডো, ট্রপিক্যাল সাইক্লোন, জলবায়ু পরিবর্তন, ভূমিক্ষয় ইত্যাদি। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। 

শিল্পায়নের জোয়ারে বাংলাদেশের কৃষি খাতের দিক থেকে মনোযোগ সরে গেছে। অথচ এ দেশের মোট কর্মক্ষম জনগণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কৃষি খাতে জড়িত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট জিডিপির মাত্র ১৩ দশমিক ৩২ শতাংশ কৃষি খাত থেকে আসে। ১৯৯৫ সালে এ হার ছিল প্রায় ২৫ শতাংশ। অন্যদিকে শিল্প খাতে এ পরিমাণ ৩১ দশমিক ১৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ১৯৯৫ সালে এ পরিমাণ ছিল মাত্র ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেবা খাত বাংলাদেশের জিডিপিতে ৫৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ অবদান রেখেছে। একটি গতিশীল অর্থনীতি নির্মাণে শিল্প ও সেবা খাতের প্রয়োজন আছে। সে কারণে কৃষি খাতকে অবহেলা করা যাবে না। শিল্প ও সেবা খাতের সঙ্গে কৃষি খাত যদি সুষমভাবে এগিয়ে না যায়, বরং ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তা সবুজ অর্থনীতির ধারণার সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।

সবুজ অর্থনীতির ধারণা অনুসারে, প্রকৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে যে অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়, অনেক সময় সাদা চোখে তা ধরা যায় না। তবে ধীরে ধীরে তার প্রভাব স্পষ্ট হয়। যখন তা বোঝা যায়, ততদিনে আর কিছু করার থাকে না। এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের প্রধান নগরগুলোয় শিশু-কিশোরদের প্রায়ই দেখা যায় গলিতে এমনকি যানবাহন চলাচলের রাস্তায় খেলাধুলা করতে। এ বাস্তবতা একদিনে তৈরি হয়নি। আমরা টের পাওয়ার আগেই বেহাত হয়ে গেছে খেলার মাঠগুলো। সেখানে উঠেছে বহুতল আবাসিক ভবন কিংবা শপিং মল। এর জন্য দায়ী অতিরিক্ত মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা। তারা ছলে-বলে-কৌশলে মাঠগুলো দখল করে নিচ্ছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত আমলা ও অসাধু রাজনীতিবিদ। গত বছর ডিসেম্বরে ওটিটি প্লাটফর্ম হইচইয়ে অমিতাভ রেজা নির্মিত ওয়েব সিরিজ ‘বোধ’-এর স্ট্রিমিং শুরু হয়। এ ওয়েব সিরিজে একটি আবাসন কোম্পানি কর্তৃক একটি কলেজের খেলার মাঠ দখলের নগ্ন চিত্র উপস্থাপন হয়েছে। এ ধরনের অবৈধ দখলদারত্বের কারণে আমাদের শিশু-কিশোররা একটি সুন্দর ও যথাযথ শৈশব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের মনোজগতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফলে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বেড়ে চলেছে। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার কথা ছিল খেলার সামগ্রী, সেখানে তারা অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। এসব বিপথগামী কিশোর সামান্য ছুতোয় এমনকি একে অন্যকে খুন করতেও দ্বিধা করছে না। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হচ্ছে। শিশু-কিশোররা মানসিক জটিলতা নিয়ে বড় হচ্ছে। তাদের সুষম বিকাশ হচ্ছে না। ফলে দেশের স্বার্থে অবদান রাখার মতো উপযোগী হয়ে তারা গড়ে উঠতে পারছে না। এর ফলে বাংলাদেশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে অন্তত দুই দিক দিয়ে। প্রথমত, এসব বিপথগামী ও মানসিক জটিলতাগ্রস্ত শিশু-কিশোরদের চিকিৎসা এবং পুনর্বাসনের পেছনে রাষ্ট্রের প্রচুর পরিমাণে অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, মানসিক বিপর্যস্ততার কারণে পরিণত বয়সে তারা দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখতে পারছে না। ব্যাপারটা বাটারফ্লাই ইফেক্টের মতো। এমনিতে দেখতে গেলে মাঠ দখলের কারণে যে পরিবেশগত বিপর্যয়, তার সঙ্গে অর্থনৈতিক ক্ষতির কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু উপরের আলোচনা থেকে মাঠ দখল কীভাবে অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে, তার ধারণা পাওয়া যায়। 

আমাদের নদীগুলো তাদের নাব্যতা হারাচ্ছে। জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সেখানে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন শিল্প-কারখানা, আবাসিক এলাকা ও রাস্তাঘাট। ঢাকা শহরে একটি জায়গা আছে ধোলাইখাল নামে। অথচ সেখানে গিয়ে এখন আর কোন খালের অস্তিত্ব খুঁজে পওয়া যাবে না। খাল ভরাট করে সেখানে রাস্তা তৈরি হয়েছে। তুরাগ নদীর কী অবস্থা তা কারো অজানা নেই। সারা শহরের শিল্প-কারখানা এবং আবাসিক এলাকার যাবতীয় বর্জ্য গিয়ে মেশে বুড়িগঙ্গা নদীতে। নদীটির পানির গন্ধে টেকা দায়। অথচ এর অবস্থা তো এমন ছিল না। বুড়িগঙ্গার রূপে মুগ্ধ হয়েই তো তার তীরে আহ্সান মঞ্জিল নির্মাণ করেছিলেন ঢাকার নবাবরা। ছাদে বসে সপরিবারে নদীর শোভা উপভোগ করতেন ঢাকার নবাবরা। কিন্তু বর্তমান বুড়িগঙ্গার রূপ দেখলে এসব ইতিহাস রূপকথা মনে হয়। যেন কোনো এক জাদুবলে কিংবা অভিশাপে শীর্ণকায় বৃদ্ধায় পরিণত হয়েছে সুন্দরী রাজকন্যা! এ তো গেল ঢাকার কথা। চট্টগ্রামে একমাত্র কর্ণফুলী ছাড়া অন্যসব নদী হয় মরে গেছে কিংবা মুমূর্ষু অবস্থায় আছে। কর্ণফুলীতেও দূষণের হার আশঙ্কাজনক। কালুরঘাট ভারী শিল্প এলাকাসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলের বর্জ্য মিশে নদীটিকে দিনে দিনে অসুস্থ করে তুলছে। কালুরঘাট ব্রিজ পার হয়ে দক্ষিণে যতদূর যাওয়া যায়, রাস্তার দুই পাশে দেখা যাবে বিলের পর বিল বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের দখলে। বিলের বুকে গেড়ে বসে আছে তাদের বাহারি সাইনবোর্ড। চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন স্থানে পাহাড় কেটে শিল্প-কারখানা স্থাপিত হচ্ছে। আমাদের প্রধান নগরগুলোয় জলাবদ্ধতা একটি প্রধান সমস্যা। বর্ষাকালে রাস্তাঘাট পানিতে ডুবে থাকে। এ জলাবদ্ধতা নিরসনে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেও কোনো সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং প্রকৃতির সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ শিল্পায়ন ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে আমাদের জলাশয়গুলো ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে জলাবদ্ধতার শিকার হচ্ছি আমরা। 

পরিবেশগত বিপর্যয়ের কারণে একটি দেশের অর্থনীতি কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, উপরের আলোচনায় তার দুটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে। রাস্তাঘাটে পথ চলতে এমন অনেক নজির আমাদের চোখে পড়ে।

তবে পরিবেশকে বিরূপ না করে উন্নয়ন কার্যক্রম চালাতে সবুজ অর্থনীতির ধারণার সঙ্গে এরই মধ্যে জড়িত হয়েছে বাংলাদেশ। সবুজ বিনিয়োগ এবং সবুজ ব্যাংকিংয়ের ধারণা সরকারিভাবে জনপ্রিয় করার প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। যেসব শিল্প-কারখানা যথাযথ পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করছে, তাদেরকে কর রেয়াতের সুবিধা দেয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলো যেন পরিবেশ দূষণকারী কোনো কর্মকাণ্ডে বিনিয়োগ না করে, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ দিকনির্দেশনা আছে। তবে সবুজ অর্থনীতিকেন্দ্রিক এসব নীতি যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। ফলে তার কোনো সুফল মিলছে না। বাংলাদেশকে বাসযোগ্য রাখতে সবুজ অর্থনীতির বিকল্প নেই। সুতরাং সবুজ অর্থনীতি নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি স্তর থেকে শুরু করে একেবারে ব্যক্তি পর্যায়ে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে। 


নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন