
আমাদের শিল্প, সংস্কৃতি, সুকুমারবৃত্তি চর্চার ধারা প্রতিষ্ঠায় বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশককে অভিহিত করা হয় নবজাগরণ কাল বা রেনেসাঁ হিসেবে। বায়ান্ন-পরবর্তী আন্দোলন-সংগ্রামের পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা অর্জন। এরপর আমাদের শিল্পকলা এগিয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র ও গতি নিয়ে। এ পথচলায় বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ভূমিকা অগ্রণী। পঞ্চাশের দশকে ভাষা আন্দোলনের অনুরণনকে উপজীব্য করে শিল্পীরা নিজেকে নির্মাণ করেছেন। তাদের চিত্র ও কলায় পঞ্চাশের দশকের ভাষা আন্দোলন কাজ করেছে উজ্জীবক হিসেবে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যখন হয় চারুকলা ইনস্টিটিউট তখন নবীন। ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা’—মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও খাজা নাজিমুদ্দিনের এ ঘোষাণার পর অন্য ছাত্র-জনতার মতো চারুকলা ইনস্টিটিউটের ছাত্ররাও সে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। প্রথম থেকেই চারুকলার শিল্পী-শিক্ষার্থীরা বাংলা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫২ সালে মিছিলের সম্মুখসারিতেই ছিলেন আমিনুল ইসলাম, বিজন চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী, মুর্তজা বশীর, ইমদাদ হোসেন, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাকসহ অনেকে।
বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে আহত বরকতের সঙ্গে ছিলেন মুর্তজা বশীর। তিনি তার ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’
গ্রন্থে লিখেছেন, “... হঠাৎ
আমি দেখলাম, মেডিকেল কলেজ ও ব্যারাকের মাঝখানটাতে পিঁপড়া যেমন শস্যদানাকে ঘিরে নিয়ে আসে, সে রকম পাঁচ-ছয়জনের একটা জটলার মতো, তারা কী যেন নিয়ে আসছে। আমার কৌতূহল হলো, দৌড়ে ওখানে গেলাম। আমিও ওই দলে ঢুকে গেলাম। দেখলাম, প্যান্টের মধ্যে শার্ট গোঁজা, লম্বা শেভ করা একজনকে। তার সারা মুখে বড় বৃষ্টির ফোঁটার মতো ঘামের বিন্দু। আর কল খুলে দিলে যেমন অঝোরে পানি পড়ে, তেমনি রক্ত ঝরছে। সে বারবার জিব বের করছে আর বলছে, ‘পানি পানি।’
আমার হাতের রুমালটা ঘামে পানিতে ভেজানো ছিল। আমি ইতস্তত করছিলাম রুমালটা নিংড়ে দেব কিনা। সে কাটা মুরগির মতো ছটফট করছিল। অবশেষে আমি নিংড়ে দিলাম। সে ফিসফিস করে বলল, ‘আমার নাম আবুল বরকত, বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন, পল্টন লাইন, আমার বাড়িতে খবর দিয়েন।’
আর কিছু বলেনি।”
সে সময় ঢাকা আর্ট গ্রুপের দ্বিতীয় চিত্র প্রদর্শনীর তারিখ নির্ধারিত ছিল। কিন্তু গুলিবর্ষণের ঘটনার পর প্রদর্শনীটি বন্ধ করে দেন শিল্পীরা। মুর্তজা বশীরের সঙ্গে আমিনুল ইসলাম, বিজন চৌধুরী, রশিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, আবদুর রাজ্জাক, দেবদাস চক্রবর্তী সবাই সেদিন প্রতিবাদ হিসেবে চিত্রকর্মের প্রদর্শনী না করার সিদ্ধান্ত নেন। পরবর্তী সময়ে মুর্তজা বশীর তার লেখায় বলেছেন, একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন তিনি। এরপর ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’
সংকলনের জন্য পাঁচটি স্কেচ করেছিলেন। এর মধ্যে ছিল “রক্তাক্ত একুশে”
চিত্রটি।
আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন ২০১০ সালে মুর্তজা বশীরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মুর্তজা বশীর ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন নিয়ে ছয়টি ড্রয়িং করেন। হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে ফেব্রুয়ারি সংকলনে ১৯৫৩ সালে সেগুলো প্রকাশিত হয়। এছাড়া কাজী আবুল কাশেমের নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি ছন্দনামে কার্টুন আঁকতেন। ভাষা আন্দোলনের ওপর তার কার্টুন আছে।’
ভাষা আন্দোলনের সময় বড় বড় ক্যানভাসে বিশালাকার ছবি আঁকা হয়নি। তবে লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কিছু ড্রয়িং করেন শিল্পীরা। যার বেশির ভাগই ছিল লাইন ওয়ার্ক। শিল্পীরা তখন ছবি এঁকেছিলেন পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে। আন্দোলনগুলো যে শুধু ভাষা আন্দোলনের মধ্যে আটকে ছিল তা নয়, চলছে অন্যান্য সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনও। সব একসঙ্গে যুক্ত হয়ে আন্দোলনটা এগিয়েছিল।
ভাষা আন্দোলনের ছবি প্রসঙ্গে রনবীখ্যাত শিল্পী রফিকুন নবী বলেন, ‘সে সময় যারা গদ্য সাহিত্যিক ছিলেন তারা গদ্য সাহিত্যে, কবিরা কবিতার মাধ্যমে, সংগীতশিল্পীরা গানের মাধ্যমে ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কাজ করছিলেন, তেমন চারুশিল্পীরাও তাদের চিত্রকর্মের মাধ্যমে শামিল হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের সময় তরুণ শিল্পীরা যে ছবিগুলো এঁকেছিলেন, তা আন্দোলনের প্রয়োজনেই এঁকেছিলেন। যার অনেকটাই এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না বা ধ্বংস হয়ে গেছে। দুঃখের বিষয়, মুর্তজা বশীর ও আমিনুল ইসলাম ছাড়া বাকিদের ছবি আর পাওয়া যায় না।’
তথ্য মতে, ‘রক্তাক্ত একুশে’র দুটি ভার্সন করেছিলেন মুর্তজা বশীর। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির পর তিন-চার মাসের মধ্যে তিনি এ কাজ দুটি করেন। দুই লিনোকাটের প্রধান পার্থক্য হলো গুলিবিদ্ধ ছাত্রকে যে ছাত্র ধরেছে, তার ডান হাতে প্ল্যাকার্ডটি থাকলেও দ্বিতীয় চিত্রটিতে তা নেই। এ লিনোকাটই প্রথম প্রদর্শিত হয়েছিল ১৯৫৪ সালে দ্বিতীয় সাহিত্য সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত বর্ধমান হাউজে অনুষ্ঠিত চিত্র ও আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে। জীবিতাবস্থায় মুর্তজা বশীর তার একটি লেখাতে জানিয়েছিলেন, এ চিত্রটি ছাড়া আর কোনো তার শিল্পকর্ম একুশের ওপর ছিল না।