সময়ের ভাবনা

অর্থনীতির সর্বত্রই সংকটের বার্তা

এম এম মুসা

বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে ফের কালো মেঘ। অর্থনীতিবিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা ও ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সবাই প্রায় এক বাক্যে মানছেন যে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট শুরু হয়ে গেছে। নতুন বছরে তা আরো বাড়বে বলেই সবার আশঙ্কা। এখন পর্যন্ত যা তথ্য-পরিসংখ্যান মিলছে তাতে এর প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। এমনিতেই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমস্যার শেষ নেই। যার অধিকাংশই আবার দুর্বল সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে সৃষ্টি। ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দার প্রভাব আগামী দিনগুলোয় বাংলাদেশে বহু গুণে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯৩০-এর দশকে হওয়া গ্রেট ডিপ্রেশন বা মহামন্দার কথা আজও কেউ ভোলেনি। তার প্রভাব পড়েছিল সারা বিশ্বে। বিধ্বস্ত হয়েছিল বিশ্ব অর্থনীতি। এর পরের কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ধীরে ধীরে উন্নতি হয়েছে। এমন নয় যে এ দীর্ঘ সময়ে কোনো সমস্যা আসেনি। উন্নত ও উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বারবার সংকট এসেছে। সবাইকে কমবেশি চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তবু মোটের ওপর ভয়ংকর সমস্যা এড়িয়ে একটা উন্নতির ধারা বজায় ছিল।

যে রকম বড় সমস্যার কথা বলছি, তা শেষবার এসেছিল ১৫ বছর আগে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে। সে প্রবল ধাক্কার অভিঘাতে নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রিট ধসে পড়ে। সেবার সমস্যার শিকড় ছিল মর্টগেজ ঋণ। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং খাতে দ্রুত ঋণস্ফীতি থেকে যে বিশাল বুদ্বুদ তৈরি হয়েছিল, তার ঢেউ এসে পড়েছিল ইউরোপীয় অর্থনীতিতেও। অথচ অতীতের এ-জাতীয় বিপর্যয়গুলো আঞ্চলিকভাবেই সীমাবদ্ধ থাকত। বিপর্যয়ের উৎসটির মূলে ছিল পর্যাপ্ত তারল্য ও অপরিমিত ঋণঝুঁকি। গ্রাহক-ঋণগ্রহীতা, ব্যাংক ও অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিগুলোর উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া লোভের কারণে উপেক্ষা করা হয়েছিল সব ধরনের ঝুঁকি। এ ব্যবস্থা কিংবা অব্যবস্থাপনার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাব-প্রাইম মর্টগেজ’ সংকটের মধ্য দিয়ে। 

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সংকটের সূত্রপাত ৯/১১-এর হামলার পর। টুইন টাওয়ারে হামলার কারণে অর্থনীতিতে স্থবিরতা দেখা দেয়। বিদেশীরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ সরিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। চাহিদা ও জোগানে মারাত্মক পতন ও শিল্প উৎপাদনে স্থবিরতা দেখা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারেরও পতন ঘটে এ সময়ে। অর্থনীতির সর্বত্র আস্থার অভাব দেখা যায়। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানও শ্লথ হয়ে পড়ে। ফেড রেট ছিল ৬ শতাংশের ওপরে। তৎকালে ফেডের চেয়ারম্যান ছিলেন অ্যালান গ্রিসপ্যান। তিনি অর্থকে সহজলভ্য করার মাধ্যমে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার নীতি গ্রহণ করেন। এর অংশ হিসেবে ফেড রেট কমিয়ে ১ দশমিক ৫ শতাংশে নিয়ে আসেন। অর্থ হয়ে যায় সহজলভ্য। এতে করে ব্যাংকের হাতে প্রচুর লিকুইডিটি চলে আসে। এ অর্থ ব্যবহার করে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা করে ব্যাংকগুলো। তারা অব্যবহৃত বা অলস অর্থ ব্যবহারের জন্য জামানত বা মর্টগেজের বিষয়টা সহজ করে ফেলে। ব্যাংক সুদের হারও কমিয়ে আনা হয়। এতে করে যেসব মার্কিনের ঋণ বা হোম লোন নেয়ার যোগ্যতা ও সক্ষমতা ছিল না তারাও রাতারাতি ঋণের জন্য যোগ্য হয়ে ওঠে। ন্যূনতম মানসম্পন্ন এ ঋণ বা লোনগুলো সাবপ্রাইম মর্টগেজ নামে পরিচিত হয়েছিল। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণ নেয়াকেও সহজ করা হয়। ফলে অনেক গ্রাহক যাদের ঋণ গ্রহণ ও পরিশোধে ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না তারাও বিপুল পরিমাণ অর্থ ঋণ নিতে থাকে। এদিকে গ্রাহকের কাছ থেকে সুদ আয়ের পাশাপাশি তাদের থেকে নেয়া মর্টগেজগুলো থেকেও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকগুলো অর্থ উপার্জনের উদ্যোগ নেয়। তারা শত শত মর্টগেজ একত্র করে একেকটি বন্ড তৈরি করে, যা সিডিও নামে পরিচিত। এসব বন্ড ব্যাংকাররা আবার থার্ড পার্টির কাছে বিক্রি করে দিতে থাকে। এসব থার্ড পার্টি ছিল ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, পেনসন ফান্ড অথবা অন্য কোনো ব্যাংক।

সবকিছু ভালোই চলছিল কিন্তু হঠাৎ করে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজিং ব্যবসা ধীরে ধীরে পড়তে শুরু করে। ব্যাংকের সুদের হারও এ সময় বেড়ে ওঠে। বিক্রয় কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাবপ্রাইম মর্টগেজের সুদহার বেড়ে যায়। ফলে বিপুলসংখ্যক মার্কিনের ঋণের কিস্তি পরিশোধের সক্ষমতা রাতারাতি কমে যায়। ধীরে ধীরে অনেকে ঋণের কিস্তি দিতে অপারগ হয়ে যেতে থাকে। ঋণখেলাপি হয়ে পড়ে অনেকে। এতে যেসব বন্ড ব্যাংকগুলো সাবপ্রাইম মর্টগেজের সমন্বয়ে বানিয়েছিল, সেগুলোর দাম ধীরে ধীরে পড়তে থাকে। তখন পর্যন্ত ব্যাংকাররা বা থার্ড পার্টিরা এটি নিয়ে চিন্তিত ছিল না। কারণ তারা জানত তাদের ঝুঁকি নেই। কারণ এআইজির মতো বড় ইন্স্যুরেন্স প্রতিষ্ঠান এ ঝুঁকি নিয়েছে। ধীরে ধীরে এমন একটি সময় এল, যখন এআইজি অনুধাবন করতে পারল যে তারা এত বেশি সংখ্যক বন্ডের ইন্স্যুরেন্স কাভারেজ দিয়েছে যার বেশির ভাগ ডিফল্ট হয় গেছে, এখন এআইজির পক্ষে এতগুলো বন্ডের ইন্স্যুরেন্সের ক্ষতিপূরণ দেয়া প্রায় অসম্ভব। ২০০৮ সালে এআইজি পুরোপুরি তহবিলশূন্য হয়ে পড়ে। এ সংকটের জেরেই নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করেছিল ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক লেম্যান ব্রাদার্স। কার্যত ডুবেছিল পুরো মার্কিন ব্যাংকিং ব্যবস্থা। 

এবারের আর্থিক সংকটের কারণ অবশ্য আলাদা। মূলত রাশিয়া বনাম ইউক্রেনের যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কারণে জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম বাড়ছে হুহু করে। সার, বীজ ভোজ্যতেল, খাদ্যের দামও বাড়ছে। এতে প্রবল সমস্যার মুখে পশ্চিমা দুনিয়া। কারণ সেখানে এর জেরে বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের মতো জ্বালানির দাম বাড়ছে দ্রুত। অনেক জায়গায় ১০০ শতাংশ! দুশ্চিন্তার শেষ নেই। এরই মধ্যে বিশ্বের ২০০টি দেশের মধ্যে অন্তত ৫০টি দেশে খাদ্য বাবদ ব্যয়ে অর্থের সংকট দেখা দিয়েছে। একদিকে জ্বালানির বাড়তি খরচ মেটাতে গিয়ে খাবার কেনার সংগতি নেই, অন্যদিকে খাবারের জোগানেও ঘাটতি, উৎপাদন হয়নি। আগামী দিনে এ সমস্যা আরো তীব্র হওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে শুরু করে প্রায় সবাই মানছে যে সামনে খুব খারাপ সময় অপেক্ষা করছে। এখন থেকেই ব্যয় ও নতুন বিনিয়োগে কাটছাঁট করতে শুরু করেছে বহু কোম্পানি। আশঙ্কা, আগামী দিনে আমদানি-রফতানি কমবে। অবধারিতভাবে এর প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের ওপরও। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন অনেক বেশি বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। দেশের রফতানি আয়ের বড় অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপ থেকে। আবার আমদানিতে চীন, ভারত, রাশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশের ওপর ব্যাপক মাত্রায় নির্ভরশীল। 

বাংলাদেশের অর্থনীতি কি শুধু বৈশ্বিক প্রভাবের কারণে চাপে পড়েছে নাকি অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতাও রয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান চাপ যতটা না বৈশ্বিক তার চেয়ে বেশি অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার ফল। করোনার আগে থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকটের সূত্রপাত। যারা আর্থিক খাত নিয়ে গবেষণা করেন তাদের অনেকের মতো দেশের ব্যাংক খাতে সবসময়ই নীতিগত আপস হয়েছে। এ খাতে নজরদারি ছিল দুর্বল, খেলাপি ঋণের হার ছিল উচ্চ, সরকারি ব্যাংকের ছিল মূলধন ঘাটতি। সবকিছুর পেছনে ছিল রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা। সেই ব্যাংক খাত নিয়ে বিপদ এখন আরো বেড়েছে। খেলাপি ঋণ ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আইএমএফের হিসাবে প্রকৃত খেলাপি ঋণ আরো বেশি। রাজনৈতিক কারণে বেশকিছু বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকানায় পরিবর্তন আনা হয়। সে ব্যাংকগুলোর স্বাস্থ্য বর্তমানে খুব একটা ভালো নয়। সব মিলিয়ে ব্যাংক খাতের এখন নাজুক অবস্থা, তা দীর্ঘ কয়েক বছরের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির প্রভাব। 

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বড় ধাক্কাটি আসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে। করোনার আগে থেকে শুরু হলেও করোনা-পরবর্তী সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় ও আয়ের ভারসাম্যহীনতা বড় হচ্ছিল। বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক তদন্তে ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মূলত অর্থ পাচারের জন্য বাণিজ্যকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিক ব্যাংক খাতের মাধ্যমেই এ অর্থ পাচার হয়েছে। আমদানি ব্যাপক আকারে বেড়ে যাওয়ায় রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স দিয়ে সেই দায় মেটানো কঠিন হয়ে পড়ছিল।

আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমে গেলে অল্প অল্প করে টাকার অবমূল্যায়ন শুরু করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক শেষ পর্যন্ত ডলারের বিনিময় হার বাজারের ওপর খানিকটা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। প্রথম দিকে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করলেও পরবর্তী সময়ে তা আর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ফলে হঠাৎ করেই ডলারের দাম ৮২ থেকে ১০৭ টাকায় পৌঁছে যায়। 

টাকার মান কমা মানেই অর্থনীতি দুর্বল হয়ে গেছে—এ রকম একটি মনস্তাত্ত্বিক ধারণা থেকেও টাকার মান কৃত্রিমভাবে অনেক দিন ধরে রেখেছে বাংলাদেশ। ধরে রাখা সেই বিনিময় হার নিয়েই করোনার প্রকোপ কমে আসার সময়ে বিপাকে পড়ে যায় বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাপী ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় বেশি দরেই পণ্য আমদানি করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এতে মূল্যস্ফীতিও আমদানি হয়। আবার বিনিময় হার কম থাকায় প্রবাসী আয়ও বৈধ পথে আসা কমে যায়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধ্য হয়েই ডলারের দর বাড়াতে টাকার অবমূল্যায়ন করে। এতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ওঠে। বাংলাদেশ রিজার্ভ নিয়ে বুদ্ধিমানের মতো আচরণ করেনি। অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে। ফান্ড গঠন করে ব্যবসায়ীদের ডলারে ঋণ দেয়া হয়েছে, যার বেশির ভাগই আবার ফেরত আসেনি। বিনিময় হারকে নিয়ন্ত্রিত ভাসমান করা হলেও এখনো একাধিক বিনিময় হার রাখা হয়েছে। হুন্ডিপ্রবণতা কমারও লক্ষণ নেই। এখনো বিনিময় হার নিয়ে নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে, আবার তা বদলেও ফেলা হচ্ছে। ফলে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হচ্ছে না। ডলারের চাপ কমাতে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পথ বেছে নিয়েছে সরকার। রফতানি আয় যাদের নেই, তাদের ঋণপত্র খুলতে চাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। ফলে অনেক ব্যবসায়ীই ঋণপত্র খুলতে পারছে না বলে পণ্যসংকট দেখা দিয়েছে। খাদ্য, ওষুধপত্র, কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানিও কমে গেছে। 

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে প্রথমত বিশ্ববাজারে গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যায়। এলএনজির দরও সব রেকর্ড ভাঙে। দেশের জ্বালানির এ সংকট কেবল যুদ্ধের কারণেই হয়েছে, তা বলা যাবে না। বরং অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতাই জ্বালানি সংকটের বড় কারণ। এক সময়ে বলা হচ্ছিল বাংলাদেশ গ্যাসের ওপর ভাসছে। পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বলা শুরু হয় যে গ্যাসের মজুদ দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। যে গ্যাস আছে, তা দিয়ে আর ১৫ বছর চলবে। এর পরই সরকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির কথা জোরেশোরে বলতে শুরু করেছিল। গ্যাস দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার তথ্য প্রচার করার কারণ ছিল মূলত উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানির যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করা। তা-ই করা হয়েছে।

সরকারের সামগ্রিক আয়-ব্যয়ও এখন অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েছে। সরকার লক্ষ্য অনুযায়ী আয় করতে পারছে না, কিন্তু খরচ বেড়েই চলেছে। কর-জিডিপি অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ক্রমে জটিল হচ্ছে। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে শিল্পের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। উৎপাদন সক্ষমতার বড় অংশই অলস পড়ে থাকছে। ডলার সাশ্রয়ের জন্য এলএনজি, ডিজেলসহ জ্বালানি তেল আমদানিতে রাশ টানা হয়েছে। সব মিলিয়ে বিশ্ব অর্থনীতির সংকট আগামী বছরেও যাবে না বলেই সবাই পূর্বাভাস দিচ্ছে। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, কয়লা ও এলএনজির দামও শিগগিরই কমবে না। 

অর্থনীতির সর্বত্রই সতর্কতার বার্তা। বাংলাদেশের অর্থনীতির দুটি বড় ঝুঁকি হলো, উচ্চমূল্যস্ফীতি আর বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যহীনতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বাবাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও টাকার অবমূল্যায়নের কারণে অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম দুই ক্ষেত্রে রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স দিয়ে আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে টাকার ওপর চাপ বাড়ছে। পাকিস্তান, মিসর, শ্রীলংকার অর্থনৈতিক সংকটের পেছনেও এ দুটি কারণই ছিল মুখ্য। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট কাটাতে বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে। প্রথম কিস্তির অর্থ ছাড় হয়েছে। তাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে সরকারকে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত থেকে ভর্তুকি প্রত্যাহারসহ নানা ব্যয় সাশ্রয়ী পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। এটি আবার মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ বাড়াচ্ছে। বলতে গেলে সরকার এখন কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি। একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অন্যদিকে রিজার্ভ রক্ষা করা। এক্ষেত্রে সরকার যতটা দক্ষতার সঙ্গে দুটি বিষয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করতে পারবে, অর্থনীতি ততটাই মসৃণভাবে চলবে। নতুবা সংকটে পতিত হবে।


এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন