দেশীয় চা উৎপাদনে সমতলের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

২০২২ সালে দেশে মোট চা উৎপাদনের ২০ শতাংশই এসেছে ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দেশে চা উৎপাদনে ঊর্ধ্বমুখী ধারা অব্যাহত থাকায় গত বছর লক্ষ্যমাত্রা ১০ কোটি কেজি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু শ্রমিক ধর্মঘটসহ নানা জটিলতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হয়নি। এর পরও উৎপাদনের আকার ছিল বড়। আর এক্ষেত্রে প্রতি বছরই সমতলের ক্ষুদ্রায়তন চায়ের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে। ২০২২ সালে দেশে মোট চা উৎপাদনের ২০ শতাংশই এসেছে ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে।

ওই বছর ১০ কোটি কেজি লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে উৎপাদন হয়েছে কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার কেজি। এর মধ্যে শুধু উত্তরবঙ্গের সমতলের চা বাগানগুলো থেকে এসেছে কোটি ৭৭ লাখ ৫৯ হাজার ২২৬ কেজি। প্রতি বছরের মতো ২০২২ সালেও আগের বছরের তুলনায় রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন করেছেন সমতলের চাষীরা। ২০২১ সালের তুলনায় ৩২ লাখ ১৯ হাজার ২২৬ কেজি বেশি চা উৎপাদন হয়েছে সময়।

বাংলাদেশ চা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, উত্তরবঙ্গে চা চাষের পরিকল্পনা শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। তবে পুরোপুরি উৎপাদন শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। শুরুতে পঞ্চগড়ে স্বল্প পরিসরে চা চাষ চালু হলেও ধারাবাহিকভাবে চা প্রক্রিয়াকরণ কারখানা স্থাপন, ক্ষুদ্রায়তন চা চাষে একাধিক প্রকল্প হাতে নেয়া, কৃষক পর্যায়ে প্রশিক্ষণ প্রণোদনার কারণে অঞ্চলে চা শিল্পের বিকাশ ঘটে। যার কারণে প্রতি বছরই উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় চা আবাদি জমির পরিমাণ বেড়ে চলেছে। পঞ্চগড়ে সাফল্যের পর অন্যান্য জেলায়ও চা চাষের জমির পরিমাণ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ২০২২ সালে উত্তরাঞ্চলে চা চাষের পরিমাণ বেড়েছে। ২০২১ সালের তুলনায় চা উৎপাদন কারখানা ৩টি বেড়ে হয়েছে ২৫টি। তাছাড়া অনুকূল আবহাওয়াও অঞ্চলে চায়ের আবাদ বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে। ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে পঞ্চগড়সহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় চা চাষের পরিমাণ আরো বাড়ানো সম্ভব হবে।

জানা গেছে, ২০২০ সালে দেশে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল কোটি ৫৯ লাখ ৪০ হাজার কেজি। ওই বছর উৎপাদন হয়েছিল কোটি ৬৩ লাখ ৯৪ হাজার কেজি। ২০২১ সালে চা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে করা হয় কোটি ৭৭ লাখ ৮০ হাজার কেজি। ওই বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি অর্থাৎ কোটি ৬৫ লাখ হাজার কেজি উৎপাদন হয়। সর্বশেষ বছরে লক্ষ্যমাত্রা অতীতের রেকর্ড ভেঙে ১০ কোটি কেজি করা হলেও তা অর্জিত হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছর দেশের বিভিন্ন বাগানে চা শ্রমিকরা টানা তিন সপ্তাহ ধর্মঘট পালন করায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। তবে উত্তরাঞ্চলে এর প্রভাব পড়েনি। যার কারণে আগের বছরের চেয়েও উৎপাদন বেড়েছে বলে মনে করছেন চা বোর্ডের কর্মকর্তারা।

বর্তমানে উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট নীলফামারীতে স্থানীয় পর্যায়ে চা চাষ করা হচ্ছে। দেশে চা বাগানের মতো একক মালিকানা কোম্পানিনির্ভর উৎপাদন পদ্ধতির পরিবর্তে গ্রামীণ কৃষির মতোই চা চাষ করা হয়। কৃষকরা নিজ জমিতে ব্যক্তি উদ্যোগে শ্রমিক নিয়ে চা চাষ বাগান থেকে পাতা উত্তোলন করেন। এরপর চা বোর্ড নিবন্ধিত কারখানায় গিয়ে চা পাতা বিক্রি করে দেয়। যার কারণে সাধারণ চা বাগানের মতো এখানকার চায়ের গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন। তবে গুণগত মানের প্রশ্নে পিছিয়ে থাকলেও পরিমাণের দিক থেকে সমতলের চা বাগানগুলো অনেক বেশি এগিয়ে বলে জানিয়েছে চা বোর্ড।

জানা গেছে, দেশে মোট চা বাগানের সংখ্যা ১৬৮। ২৫ একরের বেশি ভূমি চা চাষের কাজে ব্যবহূত হলেই চা বোর্ড থেকে বাগান হিসেবে নিবন্ধন দেয়া হয়। এর মধ্যে পঞ্চগড়ে নিবন্ধিত চা বাগানের সংখ্যা মাত্র ৯টি। আরো ২১টি চা বাগান অনিবন্ধিত অবস্থায় রয়েছে। এর বাইরে প্রায় হাজার ৩৫৫ জন ক্ষুদ্র চা চাষীর অধীন চা আবাদি জমির পরিমাণ ১২ হাজার হেক্টরেরও বেশি। প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলে ৪০০-৫০০ হেক্টর জমিতে চাষ বাড়ছে। ধারা অব্যাহত থাকলে আগামীতে দেশের চা উৎপাদনে উত্তরাঞ্চলের অংশগ্রহণ আরো শক্তিশালী হবে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উত্তরবঙ্গে চা চাষ প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ভিন্ন। পঞ্চগড়সহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোয় সাধারণ কৃষির মতোই চা চাষ করা হয়। ফলে শ্রমিক সংকট থাকায় চা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন। স্বাভাবিক নিয়মে পিক সিজনে প্রতি - দিন অফ সিজনে -১১ দিনের মধ্যে পাতা সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু উত্তরাঞ্চলে সাধারণ কৃষি শ্রমিকের মতো মজুরি দেয়ার কারণে শ্রমিক সংকট তীব্র। যার কারণে অনেক সময় ৩০-৪০ দিন পরও বাগান থেকে চা উত্তোলন করা সম্ভব হয় না। ফলে সারা দেশে উৎপাদিত চায়ের গুণগত মানের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে উত্তরাঞ্চলের বাগানগুলো।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন