ঢাকা বিআরটি: ভুল, ভোগান্তি ও ভবিষ্যতের বোঝা

প্রকল্প গ্রহণের আগে যথাযথ সমীক্ষা করা হোক

সড়কপথের উন্নয়নে উন্নত দেশগুলোর মতো নানা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ব্যাপক জনভোগান্তির মধ্য দিয়ে এসব প্রকল্প যখন আলোর ‍মুখ দেখে, তখন প্রকল্পের ফলাফল নিয়ে আলোচনা হয়। অথচ প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা যথাযথভাবে না করেই প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। এর ফলে শুধু জনগণের ভোগান্তিই নয়, বিদেশী ঋণের বোঝাও আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে। বর্তমান সময়ে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের ফলে এসব প্রকল্প আমাদের জন্য ভবিষ্যতে বোঝা হয়ে দাঁড়াবে, যা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা এরই মধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, গাজীপুর-বিমানবন্দর সড়কে দেশের প্রথম বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প তেমনই আলোচিত-সমালোচিত প্রকল্পগুলোর একটি। প্রকল্পের শুরু থেকেই নির্মাণকাজের কারণে সৃষ্ট যানজট ও জলাবদ্ধতায় দেশের ব্যস্ততম ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যাতায়াতকারীরা অসহনীয় কষ্ট সহ্য করে আসছেন। নির্মাণকাজের ধীরগতিতে এ কষ্ট আরো দীর্ঘায়িত হয়েছে। বস্তুত গার্ডার ধস, গত বছর জাতীয় শোক দিবসের দিন ক্রেন ছিঁড়ে চলন্ত প্রাইভেট কারের ওপর পড়া, এক্ষেত্রে বিদেশী ঠিকাদারের অদক্ষতাসহ নানা কারণে বারবার প্রকল্পটি আলোচনায় এসেছে।

অথচ এ প্রকল্পের সুফল কতটুকু মিলবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান সড়কপথ বিশেষজ্ঞরা। এক্ষেত্রে যথাযথ সমীক্ষা না করার অভিযোগই তারা তুলছেন। প্রকৃতপক্ষে প্রকল্পটি মূল ঢাকার মধ্যে হওয়ার কথা ছিল। গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি হওয়ার কথা থাকলেও এটি হচ্ছে গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটে, যা ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে খুব একটা কাজে আসবে না বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। কেননা বিমানবন্দর রোড থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে যানজটের তেমন প্রকোপ ছিল না। মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই এ সড়কে যাতায়াত করা যেত। সেখানে গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসতে সুবিধা হবে দাবি করে বিআরটি প্রকল্পের ইতিবাচক দিক তুলে ধরা হলেও তা আসলে এ রুটে যাতায়াতকারীদের আশ্বস্ত করতে পারছে না। এতদিন ধরে বরং যত দ্রুত আসা-যাওয়া করা যেত, এ প্রকল্পের ধীরগতিতে সেটি আরো বিলম্ব হয়েছে। এখন শুধু ভোগান্তিই পোহাতে হয়। বিশেষ করে উত্তরা থেকে গাজীপুরে যাওয়া প্রতিদিনই বাজে অভিজ্ঞতার জন্ম দিচ্ছে। রাস্তায় লম্বা সময় ধরে সংশ্লিষ্টদের যানজটের মুখোমুখি হতে হয়। এমনিতেই মেট্রোরেল, ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের সময় রাজধানীবাসীকে ব্যাপক ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে। এসব ভোগান্তি বিবেচনায় আবারো নতুন করে ভোগান্তি পোহানোর পর যদি সে প্রকল্পের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পাওয়া যায়, তাহলে এসব প্রকল্প নিঃসন্দেহে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

বিশেষ করে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যেভাবে ঠিক মাঝখান দিয়ে বিআরটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, তাতে ব্যস্ততম মহাসড়কটির সক্ষমতাও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। নির্মীয়মাণ প্রকল্পটি সামনের দিনগুলোয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ওপরও চাপ ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা পরিবহন বিশেষজ্ঞদের। যদিও প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে বিআরটি করতে গিয়ে এ মহাসড়কেরও উন্নয়ন করা হয়েছে বলা হচ্ছে, কিন্তু আক্ষরিক অর্থে ভোগান্তির তুলনায় তা কতটা সার্থক হবে অথবা যতটুকু উপকার মিলবে তার চেয়ে আরো বেশি উপকারিতার সম্ভাবনাকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে কিনা সেটি এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হিসেবে গণ্য হচ্ছে।

এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো ঋণ, বিআরটি প্রকল্পের প্রধান অর্থায়নকারী সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিআরটি প্রকল্পে এডিবি ছাড়াও ফ্রেঞ্চ ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (এএফডি) ঋণ অর্থায়ন রয়েছে। চড়া সুদে নেয়া এসব ঋণ ভবিষ্যতে বোঝা হয়ে উঠবে বলে অর্থনীতিবিদরা সতর্কবাণী দিচ্ছেন। তারা এ প্রকল্পকে ভুল জায়গায়, ভুল নকশায় এবং ভুলভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে বলে মত দিয়েছেন। বস্তুত উপযুক্ত সমীক্ষা ছাড়া এমনভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, যেটি থেকে এখন আসলে পিছিয়ে আসারও সুযোগ নেই। তাছাড়া সড়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিআরটি স্থায়ী প্রকল্প না হলেও বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটিকে ছয়টি ফ্লাইওভার দিয়ে একটি স্থায়ী কাঠামো হিসেবে রূপ দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বিআরটি ভেঙে ভবিষ্যতে মেট্রোরেল বা এর মতো স্থায়ী কোনো পরিবহন ব্যবস্থায় যাওয়ার সুযোগ থাকবে না। বস্তুত বিআরটি ধারণায় রাস্তার একটা অংশ বাস চলাচলের জন্য বিশেষ লেনে রূপান্তর করতে হয়। পরবর্তী সময়ে স্থায়ী সমাধান হিসেবে বিআরটি করিডোর ভেঙে মেট্রোরেলের মতো স্থায়ী গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। তাছাড়া বিআরটি প্রকল্পে খুব বেশি বিনিয়োগের দরকার না হলেও এ প্রকল্পে বারবার নকশা পরিবর্তন করায় খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে ঢাকাবাসীর স্বস্তির জন্য বিআরটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও এটিকে এখন অস্বস্তিকর প্রকল্প হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।

তার ওপর নিকট অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, মেট্রোরেল এখনো সব স্টেশনে চালু না হলেও পাতাল রেলের প্রকল্প ঠিকই হাতে নেয়া হয়েছে। এ অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, বিআরটি প্রকল্প উপকারে না এলে নতুন করে যদি আবার আগের প্রকল্প অনুযায়ী মূল ঢাকায় এমন প্রকল্প নির্মাণ করার উদ্যোগ নেয়া হয় তাহলে আগের ভুল নতুন করে হবে না তো? এমন আশঙ্কা থেকেই যায়। 

দেশের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে বিআরটি প্রকল্প সব থেকে বেশি ভুগিয়েছে। ২০১৮ সালে কাজ শুরু হলেও ভোগান্তি এখনো শেষ হয়নি। বিশ্বের অন্যান্য দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, ব্রাজিলে প্রথম বিআরটি শুরু হয়। ইউরোপের ১৪টি দেশে বিআরটি চালু রয়েছে। চীন, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশে বিআরটি সফলভাবে চললেও বাংলাদেশ এখনো এ যুগে প্রবেশ করতে পারেনি। সম্ভাব্যতার কথা যা বলা হচ্ছে, তা কতটুকু ফল দেবে সেটি নিয়েও সংশ্লিষ্টরা সন্দিহান। এ অবস্থায় অন্তত এ প্রকল্প থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে যথাযথ সমীক্ষা করা হবে সেটিই আমাদের প্রত্যাশা। নাহলে বিদেশী ঋণের যে বোঝা চাপবে, তা সামাল দেয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে জনগণের ভোগান্তি তো রয়েছেই। সড়কপথের সঠিক ব্যবস্থাপনা যেকোনো দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সুসমন্বিত পরিকল্পনার কোনো বিকল্প নেই। আমরা আশা করব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে বিআরটি একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হোক—সেটিই সবার কাম্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন