কাদের জন্য বরাদ্দ গণপরিবহনের সংরক্ষিত ৯টি আসন?

সাবিহা জামান শশী

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা হিসেবে কাজ করছেবিবিএসের গত বছর প্রকাশিত গণশুমারির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। যেখানে ৮ কোটি ১৭ লাখ পুরুষ ও ৮ কোটি ৩৩ লাখ নারী। তৃতীয় লিঙ্গ ১২ হাজার ৬২৯ জন। তবে আমার লেখার মূল বিষয়টির সঙ্গে জড়িত আছে ঢাকা। এবার তবে আসা যাক, এ ব্যস্ত নগরীতে কতজন মানুষের বাস। ‘জনশুমারি প্রতিবেদন ২০২২’ বলছে, রাজধানী ঢাকা ১ কোটি ২ লাখের বেশি মানুষ বসবাস করে। এরমধ্যে ঢাকা উত্তর সিটির জনসংখ্যা ৫৯ লাখ ৭৯ হাজার ৫৩৭। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংখ্যা ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৩৪৫। 


এবার আসি মূল বিষয়ে। বিষয়টা হলো গণপরিবহনের সংরক্ষিত আসন। আমরা যারা প্রতিদিন এ ব্যস্ত নগরীর গণপরিবহন ব্যবহার করি তাদের সবার কাছেই পরিচিত বাসের সংরক্ষিত নারী আসন। ঢাকার প্রায় সব বাসে নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি আসন সংরক্ষিত থাকে। জনসাধারণের সুবিধায় এ নয়টি আসনের বিষয়টিও বাসে লেখা থাকে। প্রতিদিন বাসে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি—বাস্তবে এ আসনগুলো পুরুষ যাত্রীর দখলে থাকে।


সময়ের সঙ্গে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। শিক্ষা কিংবা চাকরি—সমাজের সব ক্ষেত্রেই বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা কর্মস্থলে পৌঁছতে বেশির ভাগ নারীই দ্বারস্থ হন গণপরিবহনের। আর এ গণপরিহনের সংরক্ষিত আসন গ্রহণের জন্য নারীকে লড়াই করতে হয় এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই তাকে হেনস্তার শিকার হতে হয়। বাসের মধ্যে সংরক্ষিত নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য নয়টি আসন স্টিকারের লেখা দিয়ে নিজেদের দায় এড়িয়ে যান বাস মালিকরা। প্রকৃতপক্ষে এ আসনগুলো দখল করে বসে থাকেন পুরুষ যাত্রী। আমি নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে বলছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নারীদের জন্য বরাদ্দ সংরক্ষিত আসনে বসার কথা বলতেই নারী ও পুরুষ যাত্রীর মধ্যে বাগবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সংরক্ষিত আসনে পুরুষ যাত্রী বসেন এবং পরবর্তী সময়ে বাসে নারী যাত্রী উঠলেও আসন ছেড়ে দিতে চান না। সংরক্ষিত আসন নারীর অধিকার হলেও নারীকে দাঁড়িয়ে যেতে হচ্ছে। যদি কোনো নারী এ নিয়ে বলতে যান তবে অধিকাংশ সময় তাকে কটু কথা শুনতে হয়। বেশির ভাগ পুরুষ যাত্রীই অবলীলায় বলে বসেন , ‘নারী-পুরুষ সমান অধিকার, তাহলে কেন সংরক্ষিত আসন।এমনকি অনেক সময় তারা বাসচালক কিংবা হেলপারকে বলেন—সিট নেই, মেয়ে নিয়েছ কেন?

তাই অনেক নারী মুখে কুলুপ এঁটে তার গন্তব্যে যান সংরক্ষিত আসনের কথা বাদ দিয়ে। 


বিষয়টা কিন্তু এখানেই শেষ নয়। পিক টাইমে বিশেষ করে সকাল এবং অফিস শেষ করে ঘরে ফেরার সময় অনেক বাসই নারী যাত্রীদের বাসে উঠতেই দেয় না। উঠতে দিলেও বাসের ইঞ্জিনের ওপর অনেক নারী স্থান পান। এমনকি কাঠের ওপর ফোম দিয়ে দুটো আলাদা সিট বানানো থাকে অনেক বাসেই। যখন বাস পরিপূর্ণ তখন ইঞ্জিনের পাটাতন দেয়া হয় ওই আসনে। এতে করে নারীকে আরো বেশি ভোগান্তিতে পড়তে হয়। এই যেমন কিছুদিন আগে ছোট্ট একটা দুর্ঘটনায় আমার বাম পায়ে ফ্রাকচার হয়। অফিস শেষে বাসায় ফিরতে যথারীতি ভিড়; আর নারী আসন না থাকায় আমাকে বাসের হেলপার বিশেষভাবে নারীর জন্য নির্মিত আসনটি পেতে দিলেন। এতে আমাকে আরো বেশি ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। কারণ বাস থেকে নামা বা ওঠার সময় অনেক যাত্রীই পায়ে পাড়া দিচ্ছিলেন। আসলে বাসে যাতায়াত নারীদের হতাশার অন্যতম একটি বিষয়ে পরিণত হয়েছে বলে আমার মনে হয়। যারা রিকশা, সিএনজি কিংবা ব্যক্তিগত পরিবহনে যাতায়াত করেন তারা অনেকেই বিষয়টি এতটা সহজে হজম না করলেও আদতে এটাই সত্যি। 

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ৯২(২) ধারা অনুযায়ী, যদি সংরক্ষিত আসনে অন্য কোনো যাত্রী বসেন, তাহলে এক মাসের কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করা হয়েছে। তবে বাস্তবে এ আইনের ব্যবহার নেই। প্রতিনিয়ত বাসে নারীদের সংরক্ষিত আসনে দিব্বি পুরুষ যাত্রী বসে যাচ্ছেন। এ আইনের কোনো প্রয়োগ নেই। এমনকি বিআরটিসি কিংবা নগর পরিবহনের বাসে নারী যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ থাকলেও সেটি বাস্তব অর্থে বেশির ভাগ সময় থাকে পুরুষ যাত্রীদের দখলে। বর্তমানে রাজধানীর বেসরকারি মালিকানার অনেক বাসেই এখন আর সংরক্ষিত নারী আসনের দেখা মেলে না 


অধিকাংশ যাত্রীদের মাঝেই সংরক্ষিত নারী আসনের বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিও আছে। প্রায়ই বাসে নারী আসন নিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বলা হয়—সংরক্ষিত আসন থাকলে কেন নারীরা পুরুষদের আসনে বসবেন। আসলে সংরক্ষিত নারী আসন মানে এই নয় যে নয়টি আসনের বাইরের বাকি সব আসন পুরুষ যাত্রীদের জন্য বরাদ্দ। আসলে ওই নয়টি আসন নারী, শিশু ও প্রতিবন্ধীদের জন্য। তাই তারাই বসতে পারবেন। তবে যদি নারীর সংখ্যা কম থাকে তাহলে সেখানে পুরুষ যাত্রী বসতে পারেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে বাসে নারী যাত্রী উঠলে সংরক্ষিত আসন ছেড়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে নারী যাত্রীরা অন্যান্য আসনেও বসার অধিকার রাখেন। নারীদের ভোগান্তি কমাতেই এ আসন বরাদ্দ করা হলেও এখন এ আসনের জন্য আরো বেশি ভোগান্তি আর কটু কথা শুনতে হয় তাকে। তবে সব যাত্রী এক নন। এখনো অনেকেই আছেন যারা নিজের আসন ছেড়ে দেন নারী যাত্রীদের জন্য।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে—নারী কি তবে দুর্বল, তাই এ আসন? আসলে এমন কিন্তু নয়, রাজধানী ঢাকার লোকাল বাসে যাত্রীদের ভিড় এতটাই বেশি থাকে যে সেখানে যেকোনো মানুষের জন্য দাঁড়িয়ে থাকাটাই কষ্টকর। আর একজন নারীকে ভিড়ের মাঝে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হয়। এমনকি আসনে বসে গেলেও নারী যাত্রীকে হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় প্রতিনিয়ত, সেখানে ভিড়ের মাঝে তার অবস্থা কতটা বেগতিক সেটা সবার বোঝা উচিত।


একবার ভোগান্তির শেষ সীমানায় গিয়ে ৯৯৯ নম্বরে ফোন দিয়ে বাসে সংরক্ষিত নারী আসন ফাঁকা না রাখায় অভিযোগ করেছিলাম একটি লোকাল বাসের বিরুদ্ধে। প্রত্যুত্তরে শুনতে হয়, দুঃখিত এটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমার খুব জানতে ইচ্ছা হয় এভাবে আর কত দিন। যদি বাসে সংরক্ষিত নারী আসন পুরুষের দখলেই থাকে তাহলে এ আসন রেখে নারীদের ভোগান্তি বাড়ানোর কোনো মানে আছে কি? 


বর্তমান সময়ে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। আমাদের দেশে নারী অধিকার আদায় নিয়ে অনেক কাজ হচ্ছে যেটা প্রশংসা পাওয়ার দাবিদার। কিন্তু গন্তব্যস্থলে যেতে রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনে নারীকে যে ভোগান্তির মুখোমুখি হতে হচ্ছে তা হতাশাজনক। সংরক্ষিত নারী আসন সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি এ আসন নিয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। যাত্রীদের এ নিয়ে সচেত করতে প্রচারণার প্রয়োজন তাহলে নারী আসন নিয়ে যে ভুল ভাবনা সেটি দূর হবে। একই সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গণপরিবহনে সংরক্ষিত নারী আসন কাদের দখলে সেদিকেও নজর দেয়া যেতে পারে। এতে করে যেসব যাত্রী নারী আসন দখল করে রাখেন তাদের একটু হলেও শুভবুদ্ধির উদয় হতে পারে। 

লেখক : সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন