সলিমুল্লাহ মুসলিম হল

ষাটের দশকে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল

সম্প্রতি তোলা সবুজ বাগান বেষ্টিত এসএম হল ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

সময়ের পরিক্রমায় যে দিনগুলো আজ ভাস্কর হয়ে প্রজ্বলিত জীবনের স্মৃতির পাতায়, সে সুখস্মৃতিগুলো ক্ষণে ক্ষণে দোলা দিয়ে যায় অতৃপ্ত হূদয়ে। যেথায় মন হারিয়ে যেতে চায় আনমনায়। এখনো স্বপ্নচারী স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল। এই তো সেদিন! তখন আমরা চারজন আবাসিক ছাত্র হিসেবে বেশ বড় একটা রুমে ছিলাম। সবার কথা মনে নেই। তবে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং ইতিহাসের ছাত্র শাহেদ আলী দুজনের কথা মনে পড়ে। কিছুদিন পর আমি দ্বৈতাবাসিক হলাম, ওয়েস্ট হাউজের নিচতলায়। এসএম হলে খাবার উন্নত ছিল এবং ছুটির দিনগুলোয় পোলাও-মাংস রান্না হতো।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অনেক প্রতীক্ষিত সিঙ্গেল রুমে বরাদ্দ পেলাম। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানচর্চার জন্য একা পড়াশোনার পরিবেশ দরকার। আমি সেটা পেয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আবাসিক কক্ষগুলোয় থাকার মধ্যে অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে। প্রথমে চারজনের বড় রুম এবং পরে দ্বৈতাবাসিক রুম। সময় গ্রুপ স্টাডি করা প্রয়োজন এবং এজন্য পরিবেশে থাকা একজন ছাত্রকে অনেক কিছু দিতে পারে। যেটি আমরা নিয়েছি। সিঙ্গেল রুম পাওয়ায় তৎকালীন সমাজবাস্তবতা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনার সে সুযোগ আমি পেয়েছিলাম। সে সময়ের স্মৃতিগুলো এখনো অমলিন। এখনো কানে বাজে সেই ঝিক ঝিক শব্দ। হলের সামনেই পলাশীর পাশ কেটে চলছিল ট্রেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ে বেজে উঠত সে ধ্বনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম। সবাইকে নিয়ে এখানে সভা, সেমিনার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করতাম। ব্রিটিশ কাউন্সিল এবং ইউএসআইএসে যাওয়া হতো। আমার বেশির ভাগ সময় কাটত ব্রিটিশ কাউন্সিলে। অধিকাংশ সময়ই ব্যয় করতাম পড়াশোনার পেছনে। 

সে সময় একটা ঘটনা ঘটল, পাকিস্তানের রাজনীতিতে তখন সমালোচিত মুখ জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান ইউথ লীগ প্রধানের দাওয়াতে ঢাকায় এলেন। তখন ঢাকায় কোনো এসি হল ছিল না। ইউএসআইএসে একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রুম খুঁজে পাওয়া গেল। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির ওপর তিনি উচ্চমানের বক্তৃতা দিলেন। ইউএসআইএস প্রোগ্রামে  চা খাওয়ার পর আমাকে ডেকে বললেন, ইয়ং ম্যান, আই এম  ইম্প্রেসড উইথ ইউ, উই নিড পিপল লাইক ইউ ইন ফরেন সার্ভিস অব পাকিস্তান। এখন পেছনে তাকিয়ে ভাবি, জুলফির কথাই কি আমাকে অনুপ্রাণিত করেছিল পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দিতে? কে জানে

এছাড়া মনে পড়ছে বিশেষ ঘটনা, ওই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। সে অনুষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের জেনারেল কনভেনশন সার্টিফিকেট দেয়ার কথা ছিল মোনায়েম খানের। আমরা  সিদ্ধান্ত নিলাম সমাবর্তন অনুষ্ঠান হতে দেব না। পরের দিন হরতাল, হামলা-পাল্টাহামলা চলল। তখন এসএম হলে কিছু ঘটনা ঘটেছিল। ছাত্রশক্তি নামে একটি নতুন সংগঠনের উদ্ভব হলো। এটি জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ চারটি মূলনীতিতে বিশ্বাস করত। আমানুল্লাহ খান ভাই আমাকে ওখানকার মেম্বার করলেন। আমরা চেয়েছিলাম পূর্ব পাকিস্তান তার ন্যায্য হিস্যা বুঝে পাক। পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষার জন্য আমরা নীতিগতভাবে সব ছাত্রের মাঝে কাজ করেছি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বিভিন্ন আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেছি। আমি  রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলাম। প্রো-বাঙালি এবং আওয়ামী লীগের মুভমেন্টগুলোর সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলাম।

আমি সবসময় বক্তৃতার মাধ্যমে ছাত্রদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করতাম। ছাত্রলীগের বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সময়কার ছাত্র আন্দোলনগুলো পূর্ব বাংলার সাধারণ মানুষের ভেতর সচেতনতা সৃষ্টি করে। তারা ধীরে ধীরে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। যার নেতৃত্বে ছিল ছাত্রসমাজ এবং বাংলাদেশের কিছু বরেণ্য রাজনীতিবিদ। শেখ মুজিবুর রহমান তার মধ্যে অন্যতম।

এত বছর পরে মনে পড়া সুবিশাল বিস্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষী বটগাছের ছায়ায় দাঁড়ানো অপরাজেয় বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে চিরঞ্জীবতায় তুমি বেঁচে থাকো অমর হয়ে। তোমার উজ্জ্বলতায় প্রস্ফুটিত হবে সোনার বাংলায় সোনালি ইতিহাস। আর আমরা! গর্বভরে বলব, তো আমাদেরই আবাস। আমাদেরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদেরই সলিমুল্লাহ মুসলিম হল।

 

ওয়ালিউর রহমান

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বিশেষ দূত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন