সলিমুল্লাহ মুসলিম হল

ঢাকা শহরে যেন এক গ্রামীণ পরিবেশ

পাখির চোখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছবি: কামরুল হাসান

কোনো এক পৌষের শীতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের একজন আবাসিক ছাত্র হিসেবে আমার যাত্রা। হলে ঢুকেই পশ্চিম পাশে অতিথি কক্ষ। শিক্ষার্থীদের আত্মীয়-স্বজন এখানে বসে অপেক্ষা করেন। দক্ষিণাংশের সঙ্গে উত্তরাংশের সংযোগের জন্য মাঝখানে একটি ছাদযুক্ত পথ নির্মাণ করা হয়েছে। পথের দুই পাশে দুটি মাঠ। সেখানে শোভা পায় বাহারি রকমের ফুলগাছ। গোলাপ, গাঁদা, জবা, ডালিয়াসহ বিভিন্ন রকমের ফুলের চাষাবাদ হয়। হলের ছাত্রদের সকালে নির্মল বায়ুতে হাঁটাহাঁটি কিংবা রাতে পায়চারিকে মাতিয়ে তোলে ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। আঙিনায় ছোট ছোট অনেক ঝাউগাছ থাকলেও বড় দুটি ঝাউগাছের নিচে হলের শিক্ষার্থীর আড্ডা সভা হয়।

বর্ষা মৌসুমের আগে হলের ভেতরের আঙিনায় ফুলের মৌসুম শেষ হয়ে যায়। এরপর আবার বর্ষা শেষে নতুন করে শুরু হয়। যদিও হলের বাইরে খেলার মাঠ আছে কিন্তু নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও বৃষ্টিতে কখনো কখনো হলের শিক্ষার্থীরা ফুটবল নিয়ে এখানেই নেমে পড়ে। যখন নিচে খেলা চলে, তখন করিডোরে দাঁড়িয়ে উপভোগ করতে কেউ কার্পণ্য করে না। এসএম হলের বিশেষত্ব হচ্ছে এর বিশাল আঙিনা। হলের মূল ভবনের পাশে অনেক জায়গা। সেখানে শোভা পাচ্ছে বড় বড় গাছ। কংক্রিটে মোড়ানো ঢাকা শহরে যেন এক গ্রামীণ পরিবেশ এনে দিয়েছে। এখানে সকালে পাখির কিচিরমিচির শব্দে শিক্ষার্থীর ঘুম ভাঙে। বসন্তে এখানে কোকিলেরা কুহুকুহু ডাকে। এক নৈসর্গিক সৌন্দর্য! কত সৌন্দর্যপিয়াসী হলের ঘাসে শুয়ে পূর্ণিমার চাঁদ দেখেছেন কিংবা কত প্রেমিক কল্পনার রাজ্যে তার প্রেমিকাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে চেয়েছেন পূর্ণিমার তারায় পরিপূর্ণ আকাশের বিশালতার মাঝে তার ইয়ত্তা নেই।

হলে ঢুকেই বিশাল অডিটোরিয়াম। সেখানে হলের সব ধরনের সভা সমাবেশ হয়। এছাড়া টিভি রুম হিসেবেও এটি ব্যবহূত হয়। অডিটোরিয়ামের এক পাশে রয়েছে ইনডোর গেমসের জায়গা। হলের নিচতলার উত্তর পাশে রয়েছে মেস। শিক্ষার্থীরা নিজেরা টাকা দিয়ে নিজেরাই এটি পরিচালনা করেন। মেসের বিশেষত্ব হচ্ছে প্রতি সেশনে (১৫ দিনে এক সেশন) একদিন ফিস্ট দেয়া হয়। বাহারি রকমের খাবার থাকে সেদিন। ওইদিন উৎসবে রূপ নেয় মেস। মেসের সদস্যরা খাওয়া শুরু হওয়ার আগেই খেতে চলে যায়। তৈরি হয় বিশাল সারি। মেসের পাশেই গানের রুম আছে। কোনো কোনো দিন রাতে কান পাতলে শোনা যায় গায়কের কণ্ঠে ভেসে আসছে প্রেম, বিরহ কিংবা ভাটিয়ালি সুর। মেসের পূর্ব পাশে ডিবেটিং ক্লাব। শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সপ্তাহে দুদিন হল ডিবেটিং ক্লাবে বিতর্ক হয়।

মেসের বাম পাশে পত্রিকা রুম। এখানে দেশের শীর্ষস্থানীয় সব পত্রিকা রাখা হয়। সকাল থেকে শুরু করে রাত ১২টা পর্যন্ত কেউ না কেউ পত্রিকা রুমে থাকে। মেসের ওপরই দোতলায় হল মসজিদ অবস্থিত। মসজিদটি অনেক বড় নান্দনিকতায় পূর্ণ। প্রতি শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান শিক্ষকের অনেকেই এখানে নামাজ পড়তে আসেন। মসজিদের ঠিক বিপরীত পাশেই হল লাইব্রেরি এবং রিডিং রুম। লাইব্রেরি একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খোলা থাকে। শিক্ষার্থীরা এখানে বসে পড়তে পারে। লাইব্রেরি কার্ড জমা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বই রুমে নিয়ে যেতে পারে। রিডিং রুম ২৪ ঘণ্টাই খোলা থাকে। রিডিং রুমের পাশে ভবনের দক্ষিণ থেকে উত্তর সংযোগ পথের ছাদকে আমরা বলি ফ্লাইওভার। এখানে রিডিং রুমে পড়ুয়ারা কখনো কখনো বসে বিশ্রাম নেন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যায় না বলে একটি কথা আছে। ঠিক তেমনি আমাদের হলের রিডিং রুমের বাতি কখনো বন্ধ হয় না। কেউ না কেউ সারাক্ষণ থাকে। রিডিং রুমের পাশেই মসজিদ। পড়াশোনা শেষে রুমে ফেরার আগে কেউ হয়তো স্রষ্টার প্রার্থনায় রত।

হলে সিনিয়র-জুনিয়রদের মধ্য সম্পর্ক যেমন দৃঢ়, বন্ধুত্বের বন্ধনও তেমন অটুট। বছরের বিভিন্ন সময়ে হলকেন্দ্রিক প্রোগ্রামগুলো সবাইকে একত্রিত করে। দেশের নানা অঞ্চল থেকে এসে হলের এক পরিবারে আবদ্ধ হয় ছাত্ররা। হলকে আমরা বলি সেকেন্ড হোম। আসা-যাওয়ার প্রকৃতির অমোঘ চক্রের মাঝেই জীবন চলে। কয়েক বছরের জন্য আমরা হলে থাকি কিন্তু হলকেন্দ্রিক বন্ধন থাকে আজীবন।

 

মো. শহীদুল ইসলাম

আবাসিক শিক্ষার্থী, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন