
কভিড-পরবর্তী বেশ জমজমাট সময় পার করছে ঢাকার শিল্পাঙ্গন। নিয়মিত প্রদর্শনীর পাশাপাশি দেশের বড় দুই শিল্প আয়োজন বসেছে এবার। এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীর অল্প বিরতির পর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে পসরা সাজিয়েছে ঢাকা আর্ট সামিট ২০২৩।
গ্যালারি সজ্জা ও শিল্পকর্মের উপস্থাপনে বৈচিত্র্যের ছাপ পাওয়া গেছে। জাতীয় চিত্রশালার পুরো স্পেসই নানান আঙ্গিকে ব্যবহার হয়েছে। আর্ট সামিট দুই বছর অন্তর ২০১২ সাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকলেও এবারই প্রথম থিম নির্ধারণ করা হয়েছে—বন্যা।
আঞ্চলিক ভূ-প্রকৃতি ও রাজনীতির সঙ্গে বৈশ্বিক এজেন্ডার দিক থেকে ‘বন্যা’ বেশ জুতসই থিম। প্রকৃতিতে মানুষের উত্থান ও যাপনে পানির অবদান অসীম। দর্শনের ইতিহাস বিচারে এ জগতের উৎস সম্পর্কিত প্রথম পদ্ধতিগত আলোচনায় ‘পানি’-কে মূল বলে সাব্যস্ত করেন গ্রিক দার্শনিক থেলিস। পানির ভিন্ন রূপ তাকে এ প্রশ্নের উত্তর জুগিয়েছিল। আর্ট সামিটেও বন্যা থিম পরস্পরবিরোধী চরিত্রসহ বৃহত্তর অর্থে দেখা হয়েছে।
বাংলাদেশের যে পলল গঠন ও এর জনসমষ্টির বড় একটি অংশ কোনো না কোনোভাবে পানি তথা বন্যা দ্বারা প্রভাবিত। আমাদের জীবন শুধু নদীর মতো প্রবহমানই নয় বা এই কূল গড়ে ওই কূল ভাঙে দ্বৈরথের মধ্যে আটকে নেই, পানির স্তর নেমে যাওয়া, উপকূল অঞ্চলের লবণাক্ততা বা আর্সেনিক এবং ভূ-রাজনৈতিক অসাম্যের ক্ষেত্রে পানি ও বন্যা আলোচিত অনুষঙ্গ, যা লৈঙ্গিক রাজনীতিতেও বড় প্রভাব ফেলেছে। বদলে দিয়েছে জীবনযাপনের ছাঁচ। আগামীর বাংলাদেশের সম্ভাবনা অনেকটাই এ হিস্যার ওপর নির্মিত হবে।
নিরাপত্তার ভীষণ কড়াকড়ির মাঝে বদলে যাওয়া শিল্পশালায় ঢুকতেই চোখ ধাঁধিয়ে তোলে লেজার শো। বই, চেয়ার, পিস্তল ও উড়োজাহাজ থিমে এক শিশুর বেড়ে ওঠার দৃশ্যের মাধ্যমে মানুষের আত্মবিনাশী বিবর্তন ও আবার প্রকৃতির কোলে ফিরে যাওয়ার দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। নিচতলা সাজানো হয়েছে জয়দেব রোয়াজার ‘জলমগ্ন’
শিরোনামের সিরিজে। পেইন্টিংসহ নানা মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সিরিজটি নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি গ্যালারি। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধের মাধ্যমে আদিবাসীদের বাসস্থান ডুবিয়ে দেয়ার গল্প উঠে এসেছে তার রাজনীতিসহ। ইনস্টলেশনের মাঝে দাঁড়িয়ে দুই নারী-পুরুষ। হাত উঁচু করে ধরে আছে ক্ষমতার প্রতীক পুরনো রাজবাড়ির ছবি।
চারতলাজুড়ে প্রদর্শনীতে বিচিত্র সব ফর্মের সমাহার ঘটেছে। চিত্রকলা, স্থিরচিত্র, মিশ্রমাধ্যম, ডিজিটাল শো, পারফরম্যান্স আর্ট মিলেছে একই বিন্দুতে। সঙ্গে হইচই আর কোলাহল। কোনোটা প্রদর্শনীর সঙ্গে যুক্ত, আবার কোনোটা দর্শকের উদযাপনের আভাস। সব মিলিয়ে এ আয়োজনে অংশ নিচ্ছেন দেশ-বিদেশের ১৬০ জনেরও বেশি শিল্পী।
প্রথমতলার করিডোরে বড়সড় পরিসর মিলিয়ে বিশ্বজিৎ গোস্বামীর শিল্পকর্ম ‘ঋতু’। দেয়ালে বড় একটি মুখ। যেখানে ঋতু শব্দটি লেখা। ষড়ঋতুকে তিনি সাংস্কৃতিক ও প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। শিল্প ও ব্যক্তির জীবনের গল্প কীভাবে এক সুতোয় গাঁথা হয়ে যায়, সেই গল্প আছে এই প্রদর্শনে। বিশ্বজিৎ প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য আরেকটি অংশের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন। তৃতীয়তলার গ্যালারি ৬, সেখানে বাংলাদেশের ৩৯ জন নবীন-প্রবীণ শিল্পীর কাজ উপস্থাপিত হচ্ছে, যার কিউরেটর বিশ্বজিৎ। গ্যালারিতে ঢোকার মুখে চোখে পড়বে রনবীর বিখ্যাত টোকাই।
‘দ্বৈথ’
শিরোনামের আয়োজনের বৈচিত্র্য দিক হলো এ অংশটুকু রূপ-রসের সঙ্গে হাজির করেছে ‘ঘ্রাণ’। গ্যালারিজুড়ে ছড়ানো ধানের খড়। না, এতটুকুই নয়, ধানের ঘ্রাণটুকু এসে ধাক্কা দেয়। আছে মাটি, কয়লা, সিমেন্টের বস্তা থেকে নৌকার প্রতীকী ব্যবহার।’
আগেই বলেছি, ‘বন্যা’
শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় আকারে চিত্রিত হয়নি। বরং এর পরস্পরবিরোধী বৈশিষ্ট্যগুলো তুলে ধরা হয়েছে। আবীর আব্দুল্লাহর ছবিতে জলবায়ু-শরণার্থীদের নীরব কান্নার সঙ্গে জুড়ে আছে আশাবাদ, যেখানে মানুষের সঙ্গে বিপন্ন প্রাণীও হাজির। আবার তরুণ ঘোষ ‘মৃত নদী, রত ভূমি’
শিল্পকর্মে ব্যবহার করেছেন মাটি, কাদা, খড়, পানি ও বিবিধ অনুষঙ্গ। ওই গ্যালারিতে আছেন হামিদুজ্জামান খান, আনিসুজ্জামান ফারুকী, শহীদ কবীর ও মুস্তাফিজুল হক। তারা তুলে এনেছেন ম্যানগ্রোভের দান সুন্দরবনের বিস্তৃত ভাঙা-গড়া। আর্ট সামিটে সুন্দরবনের আরেকটি অভিনব উপস্থাপন রয়েছে। অমিতাভ ঘোষের লেখা থেকে সালমান তুরের গ্রাফিকস নভেল তুলে ধরেছেন আলী শেঠি।
সামদানি আর্ট অ্যাওয়ার্ড ২০২৩ পেয়েছেন মো. ফজলে রাব্বি ফটিক, ‘মরীচিকা’
শিরোনামের ফটো সিরিজের জন্য। সংযোগ সড়ক নেই, কিন্তু খাল বা নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে আস্ত ব্রিজ। মোট ২২টি স্থিরচিত্র আত্মবিনাশী উন্নয়নের ট্র্যাজেডি দিকটি তুলে এনেছে। যার কোনো অর্থ হয় না, কিন্তু এ অর্থহীনতা নিয়ে প্রাকৃতিক-প্রাণ কীভাবে মানুষের লোভের করাতে বলি হচ্ছে, সেই চিত্র উঠে এসেছে। বন্যার যে ভাঙা-গড়ার ছন্দ, বরাবরই তার বরখেলাপ করে প্রকৃতিকে শুধু বিনাশের দিকে নিয়ে গেছে মানুষ।
আর্ট সামিটে প্রতিটি শিল্পকর্মের সঙ্গে জুড়ে দেয়া হয়েছে বিষয় ও আনুষঙ্গিক বর্ণনা। সেখানে বাংলা ব্যবহারে বেশ আড়ষ্টতা লক্ষণীয়। আর চিত্রশালার সিঁড়ি বেয়ে ওঠা-নামা বয়স্কদের জন্য কতটা অস্বস্তিকর তাও ভেবে দেখা উচিত। আবার বন্যার সামগ্রিকতার ভেতরে আমাদের লোকজ সাংস্কৃতিক উপাদান কমই মনে হয়েছে। নিরীক্ষার আড়ালে কোথাও কোথাও সহজিয়া জীবন উহ্য থেকে যায়।