জাতীয়ভাবে ক্যান্সার রেজিস্ট্রি থাকা জরুরি

আমাদের দেশের ক্যান্সার চিকিৎসার গোড়াপত্তন হয় ১৯৫৮ সাল থেকে। দেশে ক্যান্সার চিকিৎসার পথিকৃৎ মরহুম অধ্যাপক সৈয়দ ফজলুল হক। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিও তিনি। ক্যান্সারের বিষয়টি তিনি সরকারি পর্যায়ে প্রথম নজরে আনেন। তারপর ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রথম ক্যান্সার চিকিৎসার কেন্দ্র তৈরি হয়। স্বাধীনতার ৫০-৫১ বছর পর ক্যান্সার ব্যবস্থাপনার কী কী অগ্রগতি হয়েছে, কোথায় কোথায় আমাদের বাধা আছে এবং এগুলো কীভাবে অতিক্রম করা যায় এগুলো যদি বিবেচনায় নিই, তাহলে কিছু তথ্য-উপাত্ত আমাদের জানা দরকার।

প্রথমত দুইভাবে আমাদের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসি। একটি হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায়, অন্যটি বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। আর রয়েছে মহাখালীর জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতাল, এটি শুধু ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য তৈরি হয়েছে। ক্যান্সার চিকিৎসার বেশকিছু ধাপ রয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে রক্তের ক্যান্সার ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রধান চিকিৎসা অপারেশন। আর যদি আমরা রোগীকে আরলি স্টেজে না পাই তাহলে ওষুধ বা কেমোথেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা দিয়ে অপারেশনের অবস্থায় আনা হয়। তারপর অপারেশন করা গেলে অপারেশন এবং কোনো কোনো সময়ে রেডিওথেরাপি দেয়া হয়। ক্যান্সার চিকিৎসায় তিনটা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা আমাদের প্রয়োজন পড়ে। এসব নির্ভর করে আমাদের রোগীরা কোন স্টেজে আমাদের কাছে আসেন।

বাংলাদেশে এখন কতজন ক্যান্সারের রোগী রয়েছে তার খুব সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। কারণ আমাদের দেশে ক্যান্সার রেজিস্ট্রি সিস্টেমটা এখনো ডেভেলপ করতে পারিনি, সেটা হওয়া জরুরি। তবে আনুমানিক বাংলাদেশে ১৩ থেকে ১৫ লাখ ক্যান্সার রোগী রয়েছে। আর প্রতি বছর আড়াই থেকে তিন লাখ নতুন রোগী যুক্ত হয়। এর তিন ভাগের দুই ভাগকেই আমরা খুব বেশি সাহায্য করতে পারি না। তারা প্রায় মৃত্যুর দিকে চলে যায়। কারণ আমাদের কাছে তারা আসেই একেবারে শেষ পর্যায়ে। তিন ভাগের এক ভাগ রোগীকে ভালো চিকিৎসার আওতায় আনতে পারি।

আমাদের মেডিকেল কলেজ এবং জেলা পর্যায়ে ক্যান্সারের অপারেশন হয়। এখন অনেক অভিজ্ঞ সার্জন রয়েছেন। গত এক দশকে আমাদের ক্যান্সার সার্জিক্যাল অনকোলজিস্ট উন্নত হয়েছে। যারা ক্যান্সার সার্জারি করেন তাদের জন্য কোর্সও চালু হয়েছে। আমাদের রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপিএই দুটি চিকিৎসাসেবা দেয় ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট। সংখ্যায় তারা এখন ৪৮০-এর মতো। আপাতত যে রোগী আসছে সেই রোগীগুলোকে জনবল দিয়ে চিকিৎসাসেবা দেয়া যাচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে কেমোথেরাপির ওষুধ আগে আমদানি করে আনা হতো। দেড় দশক ধরে বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি করছে। সেসব ওষুধের গুণগত মান বিদেশীদের সমপর্যায়ের। দেশের প্রায় ৯৭ শতাংশ চাহিদা মেটাতে পারছে কোম্পানিগুলো। সঙ্গে কিছু আমদানি করা ওষুধ তো আসছেই। এমনকি ১০০টিরও বেশি দেশে আমাদের ক্যান্সারের ওষুধগুলো রফতানি হচ্ছে।

আমাদের নৈরাশ্যের দিক হচ্ছে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আমাদের রেডিওথেরাপির মেশিনের অপ্রতুলতা। সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে সারা দেশে ৪০টির মতো রেডিওথেরাপির মেশিন আমাদের আছে। কিন্তু ডব্লিউএইচও বা ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক কমিশনের ফর্মুলা অনুযায়ী আমাদের জনসংখ্যার অনুপাতে ১৭০টির বেশি আমাদের রেডিওথেরাপির মেশিন থাকা উচিত। সুতরাং মেশিনের অপ্রতুলতার কারণে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রেডিওথেরাপি দেয়া খুব কঠিন হয়ে যায়।

তবে আমাদের যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আছে, সেখানে রেডিওথেরাপির ব্যবস্থাপনা মোটামুটি সন্তোষজনক, যদিও ব্যয় অনেক বেশি। একটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত একজন রোগীকে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকায় রেডিওথেরাপির পুরো চিকিৎসা দেয়া সম্ভব। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে এই একই রোগীর চিকিৎসা খরচ প্রায় ১০ গুণ। প্রায় দেড়-দুই লাখ টাকা লাগে।

২০২২, ২০২৩ ২০২৪ সালের বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ক্যান্সার ব্যবস্থাপনার মধ্যে বৈষম্য দূর করা। আমাদের হতদরিদ্র রোগীদের সরকারি ব্যবস্থাপনায় যেখানে চিকিৎসা পাওয়ার কথা, সরকার ভর্তুকি দিয়ে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা করছে; কিন্তু সেটা এখনো অপ্রতুল। যে মেশিনগুলো আমাদের চালু থাকার কথা সেগুলো চালু নেই, প্রায় ৭০ শতাংশ মেশিন চালু নেই। সুতরাং ওইদিকে আমাদের নজর দেয়া দরকার। না হলে বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের প্রতিপাদ্য প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে।

তাছাড়া যদিও আমরা বলছি, আমাদের ফিজিক্যাল অনকোলজিস্ট যথেষ্ট পরিমাণে আছে, কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাদের যে পরিমাণ পদ থাকার কথা তা নেই। যারা পাস করে বসে আছে তাদের উপজেলা পর্যায়ে বিভিন্ন হাসপাতালে পোস্টিং হচ্ছে। কিন্তু যেহেতু তাদের পদ নেই তাই সঠিক জায়গায় তাদের পোস্টিং নেই। বাংলাদেশ ক্যান্সার সোসাইটির জোরালো দাবি, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পদের যে স্বল্পতা সেই পদ সৃজন করা এবং পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। সঠিক জায়গায় সঠিক চিকিৎসক যখন পদায়ন হবে তখন ক্যান্সার রোগীরা পরামর্শ থেকে শুরু করে তাদের চিকিৎসার শেষ ধাপ পর্যন্ত সেবাটা পাবে। এদিকেও আমাদের নজর দিতে হবে।

ক্যান্সার চিকিৎসা এখনো রাজধানীকেন্দ্রিক। সুতরাং যেসব মেডিকেল কলেজ রয়েছে, সেগুলোকে দ্রুত উন্নয়নের দিকে নিয়ে যেতে হবে। সরকারি যেসব কেন্দ্র রয়েছে সেখানে চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে পুরনো মেশিনগুলোকে কর্মক্ষম করা এবং যেগুলো কর্মক্ষম করার সুযোগ নেই সেগুলোকে বাতিল করা গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের দেশে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব বেশি হওয়ার কয়েকটি মৌলিক কারণ আছে। সেগুলোতে নজর দেয়া উচিত। বিশেষ করে তামাক জাতীয় দ্রব্য গ্রহণ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। নগরায়ণের জন্য আমাদের শিশু-কিশোর, তরুণরা ফাস্ট ফুড বা জাঙ্ক ফুড খাচ্ছে। বিষয়গুলোতে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন