মিলছে বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

আমাদের শরীর একটা নিয়মের মধ্যে চলে। নিয়মের বাইরে যদি কোনো কিছু ঘটে যায় তাহলে সে বিষয়ে আমাদের গুরুত্ব দেয়া উচিত। কারো যদি গলার স্বরে কোনো পরিবর্তন আসে বা বসে যায়, হঠাৎ করে ওজন কমে যায় বা ওজনে কোনো পরিবর্তন দেখা দেয়, কারো শরীরে যদি কোনো গোটা চাকা, দলা, ক্ষত, পিণ্ড সৃষ্টি হয় এবং এগুলো যদি সহজে ভালো না হয়, পায়খানা এবং প্রস্রাবের যদি কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দেয়, শরীরের কোনো আঁচিল বা তিলে যদি রক্ষক্ষরণ হয় বা কোনো পরিবর্তন দেখা দেয় অথবা এটি বাড়তে থাকে তাহলে এটিকে আমরা ক্যান্সারের সতর্কবার্তা হিসেবে নিই। যদি লক্ষণগুলো কারো শরীরে দেখা যায় এবং সেগুলো স্বীকৃত চিকিৎসকের (এমবিবিএস) চিকিৎসার মাধ্যমে দুই সপ্তাহের মধ্যে ভালো না হয় তাহলে সন্দেহ করতে হবে তার শরীরে হয়তো কোনো একটা সমস্যা হচ্ছে। এমন মনে করেই তাকে ডাক্তারের কাছে আসতে হবে। তখন স্থানীয় ডাক্তাররা পরীক্ষা করে দেখবেন। যদি তারা একে খারাপ কিছুর লক্ষণ মনে করেন তখন কনসালট্যান্ট পর্যায়ের ডাক্তারদের কাছে পাঠিয়ে দেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হয়, ওই সমস্যা কোনো ক্যান্সারজনিত কিনা অথবা কোনো সাধারণ রোগ থেকে হচ্ছে কিনা। সুতরাং এসব সচেতনতা এবং লক্ষণগুলো আমাদের জানা থাকতে হবে।

অনেক রোগ আছে যেগুলোর কারণ আমরা নিজেরাই। আবার অনেক রোগ আছে যেগুলোর কারণ আমরা জানি না। আমাদের বেশির ভাগ ক্যান্সারের ক্ষেত্রে আমরা কারণগুলো জানি না। আবার অনেক ক্ষেত্রেই জানি, কারো যদি শরীরের ওজন খুব বেশি বেড়ে যায়, যদি ব্যায়াম না করে, তার যদি বংশের মধ্যে ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব থাকে, স্বাভাবিক নিয়ম যদি মেনে না চলেন, যেমন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। তাহলে ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষ করে নারীরা যদি তাদের স্বাভাবিক পরিচ্ছন্নতা বজায় না রাখে তাহলে তাদের জরায়ুমুখ ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বর্তমানে অনেকে ফাস্টফুড, জাংকফুড খান, বোতলজাত খাবার, টিনজাত খাবার খান। এগুলোও ক্যান্সারের কারণ।

নারীদের স্তন ক্যান্সার অন্যান্য ক্যান্সারের সঙ্গে নারীদের সময়মতো বিয়ে করা, সময়মতো সন্তান নেয়া শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সম্পর্ক রয়েছে। ইদানীং নারীরা অনেক দেরিতে বিয়ে করেন, বিয়ে করলেও সময়মতো সন্তান নেন না। আবার অনেকে সন্তানকে বুকের দুধ পান করান না। এতে করে তারা ক্যান্সারের প্রবণতা বাড়িতে তোলেন। আমরা যদি আমাদের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে পারি, তাহলে অনেকগুলো ক্যান্সারের হাত থেকে বাঁচতে পারব। কিন্তু এর পরও কিছু ক্যান্সারে আক্রান্ত হতে পারি আমরা।

কিছু ক্যান্সার আছে, এগুলো হওয়ার আশঙ্কা আছে কিনা বা হয়েছে কিনা, সেটি জানার জন্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম করা হয়ে থাকে। যেমন আমরা স্তন ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম করি, সার্ভিক্যাল ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম করি। অনেক দেশে খাদ্যনালির ক্যান্সারের জন্য স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম করা হয়। আরো অনেক ক্যান্সারের ক্ষেত্রে এটি করা হয়। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, লক্ষণ প্রকাশের আগেই শনাক্ত করা। দ্রুত শনাক্ত করা গেলে তিনভাগের একভাগ ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব। বাকি তিনভাগের একভাগ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বাকি একভাগের ক্ষেত্রে অনেক চেষ্টা করার পরও চিকিৎসকরা খুব বেশি কিছু একটা করতে পারেন না। তখন লক্ষণগুলোকে আমরা চিহ্নিত করি এবং সেগুলো যাতে রোগীকে কষ্ট দিতে না পারে সে বিষয়ে চেষ্টা করি।

আমাদের দারিদ্র্যের কারণেই হোক, অব্যবস্থাপনার কারণেই হোক অথবা আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার কারণেই হোক আমরা ক্যান্সার চিকিৎসা যেখানে-সেখানে করি। দেখা যায় কারো ফুসফুসের ক্যান্সার ধরা পড়ল। সে উপজেলার একটি হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করে দিল। কারো স্তন ক্যান্সার ধরা পড়ল, জেলার যেখানে ক্যান্সারের চিকিৎসা হয় না সেখানে চিকিৎসা শুরু করে দিল। অথচ ক্যান্সারের চিকিৎসা একটি সমন্বিত চিকিৎসা।

আমাদের হাসপাতালে আমরা প্রথমেই ক্যান্সারটার সাব-ক্ল্যাসিফিকেশন দেখি, তারপর ক্যান্সার কতদূর ছড়িয়েছে সেটি দেখি। এরপর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে একটা মেডিকেল বোর্ড করি। যে বোর্ডে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষজ্ঞরা থাকেন। ওখানে বসে প্রথমে একটা পরিকল্পনা করা হয়। এটা কী ধরনের ক্যান্সার, এটার কী কী চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, কতটুকু ছড়িয়েছে, বাংলাদেশে কী কী চিকিৎসা পদ্ধতি আছে, কীভাবে চিকিৎসা করলে সর্বোচ্চ আউটকামটা রোগীকে দেয়া যাবে, এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালে আমরা এমনটা সব সময় করি। ল্যাবএইডের মতো যেসব হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা দেয়া হয় রোগীরা যদি সেখানে আসেন, তাহলে তারা বিশ্বমানের চিকিৎসাসেবা পাবেন। বিভিন্ন জেলা বা উপজেলায় যেসব ডাক্তার আছেন, তারা যদি ক্যান্সার রোগীদের স্পেশালাইজড ক্যান্সার হাসপাতালে পাঠান এবং আমরা যদি বোর্ডের মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা করতে পারি, তাহলে আমরা সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে পারি।

ফুসফুস ক্যান্সারের কথাই যদি বলি, কিছুদিন আগেও এতে মৃত্যুর হার ছিল ৯০ শতাংশ। বর্তমানে তা অনেকাংশেই কমে গেছে। আমরা কিন্তু আধুনিক চিকিৎসার মাধ্যমে বেশির ভাগ রোগীকে ১০ বছর পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখতে পারি। সুতরাং, ক্যান্সার চিকিৎসা আর যেখানে-সেখানে নয়। বিশেষায়িত যেসব হাসপাতাল, যেমন ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল রকম প্রতিষ্ঠানে করতে হবে।

ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা মূলত কেমোথেরাপি, ইমিউনোথেরাপি, রেডিওথেরাপি এবং টার্গেটেড থেরাপি নিয়ে কাজ করি। আমাদের এখানে যে কেমোথেরাপি সেন্টার, সেখানে ভারত থেকেও রোগীরা এসে চিকিৎসা করেন। বায়োসেফটি বলে একটা টেকনিক আছে। আমরা যখন কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, ইমিউনো থেরাপির চিকিৎসাগুলো করি, তখন এগুলো আমাদের পরিবেশের ওপর একটা ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। ক্ষতিকর প্রভাব যাতে বিস্তার না করে, এজন্য বায়োসেফটি মেকানিজমের মাধ্যমে রোগীর শরীরে থেরাপি প্রয়োগ করা হয়। এটা আমাদের ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালে রয়েছে। আমাদের এখানে স্পেশালাইজড অনকোলজি সিস্টার বা অনকোলজি মেডিকেল অফিসার, টেকনিশিয়ান আছে। কেমোথেরাপি দিতে দিতে একটা সময় রোগীর ভেইনগুলো খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা চিহ্নিত করার জন্য ভেইন ডিটেক্টরও আমাদের কাছে আছে। সুতরাং কেমোথেরাপি দেয়ার জন্য যা যা ব্যবস্থা তার সবই আমাদের এখানে আছে।

রেডিওথেরাপি একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। একটা বিকিরণের মাধ্যমে আমরা রোগীর শরীরের ক্যান্সার সেলটাকে ধ্বংস করে থাকি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত যখন আমরা ক্যান্সার সেলটাকে ধ্বংস করতে যাই তখন আশপাশে থাকা স্বাভাবিক সেলগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু আমাদের ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতালে যে মেশিনগুলো ব্যবহার করি, সেগুলোতে কিছু উন্নত প্রযুক্তি আছে। যেমন আমরা বলি আইএমআরটি, ভিম্যাট, এসবিআরটি এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্যান্সারে আক্রান্ত অর্গানের আশপাশের অর্গানকে রেডিয়েশনের ক্ষতিকর প্রভাবমুক্ত রাখতে পারি। এজন্য আমাদের এখানে লিনিয়াক এক্সিলেটর, ব্র্যাকি থেরাপি মেশিন, ট্রিটমেন্ট প্ল্যানিং সিস্টেমসহ সব উন্নত যন্ত্রপাতি রয়েছে। সিঙ্গাপুর, ভারত বা ইউরোপ-আমেরিকায় গেলেও একই ধরনের যন্ত্রপাতি পাবেন। তবে আমরা একটা জিনিসই চাইব, আমাদের এখানে কারো ক্যান্সার না হোক। তাই আমাদের সবাইকে নিয়ম মেনে চলতে হবে। এর পরও কারো ক্যান্সার হলে বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালে চলে আসুক, মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে তার চিকিৎসা পদ্ধতিটা ঠিক করা হোক, তার অপারেশন লাগুক, থেরাপি লাগুক বা যা- লাগুক একই ছাদের নিচে হবে। চিকিৎসা-পরবর্তী ফলোআপটাও এখানে হবে। ক্যান্সার চিকিৎসার জন্য গুণগত মানের যে ওষুধ, সেটাও এসব হাসপাতালে পাওয়া যায়। ক্যান্সার মানেই মৃত্যু নয়। ক্যান্সারও জয় করা যায় এবং ক্যান্সার বিজয়ীরা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করে করবে। এটা আমরা বিশ্বাস করি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন