বাজারে ক্যান্সারের ওষুধ ছাড়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসকদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছে

ছবি: মাসফিকুর সোহান

বিদেশে ক্যান্সারের ওষুধ রফতানিকারক প্রথম বাংলাদেশী প্রতিষ্ঠান বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় ৩০০ জেনেরিকের ওষুধ উৎপাদন করছে। এর মধ্যে অন্তত ৭০টি ক্যান্সারের ওষুধ। ২০২৩ সালে বিশ্ব ক্যান্সার দিবস উপলক্ষে এর চিকিৎসায় দেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের অবদান, সীমাবদ্ধতা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন বীকন ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. এবাদুল করিম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

ক্যান্সার চিকিৎসায় ওষুধ প্রস্তুতকারক হিসেবে বীকনের অবদান রয়েছে। কবে নাগাদ দেশে ওষুধ উৎপাদন শুরু হয়েছে?

বাংলাদেশে একসময় ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি হতো না। শত ভাগই আমদানিনির্ভর ছিল। বেশির ভাগ সময় বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যান্সারের ওষুধগুলো উৎপাদন করত। আমাদের দেশে বাজারজাতের জন্য তাদের নিবন্ধন ছিল। দেশের কয়েকজন চিকিৎসক ক্যান্সারের চিকিৎসা করতেন। তবে আর্থিক সক্ষমতার অভাবে রোগীদের ৯০ শতাংশেরই ওষুধ কেনার সক্ষমতা ছিল না। সামর্থ্যবানরা চিকিৎসার জন্য যেতেন সিঙ্গাপুর ভারতে। বিশাল জনগোষ্ঠী ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। অনেক রোগীর আবার রোগটা নির্ণয়ের সুযোগও ভাগ্যে জোটে না। তাই ভবিষ্যৎ চিন্তা না করে মানবিক দিক দিয়ে অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা ক্যান্সারের ওষুধ নিয়ে কাজ শুরু করি। ২০০৯ সালের অক্টোবরে আমরা প্রথম ক্যান্সারের ওষুধ বাজারজাত শুরু করি।

দেশে তো এখন বেশ কয়েকটি ফার্মাসিউটিক্যালই ক্যান্সারের ওষুধ প্রস্তুত করছে। তা না হলে আমদানি করতে হতো। এতে করে কত ব্যয় হতো?

ক্যান্সারের চিকিৎসা অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর নির্ভর করত। আমরা ওষুধ প্রস্তুতের পর থেকে চেষ্টা করেছি যেন দামটা কমানো যায়। যেসব বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ওষুধ বাজারে আনত তারাও আমাদের কারণে দাম কমাতে বাধ্য হয়েছিল। যদি দাম তুলনা করেন তাহলে ১০ বছর আগের আর আজকের দামের মধ্যে বিশাল ব্যবধান পাবেন। চিকিৎসকদের আস্থা অর্জন করতে গিয়ে অবশ্য আমরা প্রথম দিকে কিছুটা সমস্যায় পড়েছিলাম। তারা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের ওষুধ লিখে অভ্যস্ত। সেগুলো সম্পর্কেই কেবল জানেন। ক্যান্সারের মতো এত জটিল রোগের ব্যয়বহুল ওষুধ কোনো চিকিৎসক তো আর শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে হাতেও নিতে চান না। সেখানে বাজারে আমাদের ওষুধ ছাড়ার ক্ষেত্রে তাদের আস্থা অর্জন করতে হয়েছে। কখনো কখনো হাসপাতালে এসব ওষুধ ফ্রিতেও দিয়েছি।

উন্নত দেশের বিবেচনায় ওষুধের মূল্য এক রকম আসবে। আর আমরা দেশে যে মূল্যে দিয়েছি তাতে উন্নত বিশ্বের দাম দিয়ে পাঁচ গুণ ওষুধ কেনা যায়। পরিমাণটা আরো বেশিও হতে পারে। তাই দেশে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন না করলে মানুষ এখন যে দামে কিনছে তার থেকে পাঁচ গুণ টাকা বিদেশে চলে যেত।

আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। মাথাপিছু আয় বেড়েছে। মানুষের হাতে টাকা থাকলে চিকিৎসা নিতে চায়। আগেও রোগী ছিল কিন্তু ওষুধ কেনার মতো মানুষ ছিল না। এখনো যে পরিমাণে রোগী রয়েছে সে অনুযায়ী মানুষের ওষুধ কেনার সক্ষমতা থাকলে ক্যান্সারের ওষুধ উৎপাদন করার আরো ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান লাগত।

ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের জন্য জাতীয় ঔষধ নীতি আইনে কোনো ধরনের সুবিধা রয়েছে কি?

নীতি বা আইনে কোনো সুবিধা দেয়া হয়নি, বরং নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের অবস্থানকে আরো কঠিন করে তোলা হয়েছে। এককথায় বলতে গেলে ঔষধ নীতি বা আইন ওষুধ শিল্পের অনুকূলে নেই।

কী ধরনের নীতি আইন থাকলে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান আরো আগ্রহী হবে বলে আপনি মনে করছেন?

ওষুধের দাম কমাতে যেখানে আমরা চাপ দিতে পারি, সেখানে নিশ্চয়ই আমাদের মানসিকতা বুঝতে সরকারের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আমরা বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ে অনেক অনেক কমে দাম রাখার প্রস্তাব রেখেছি। বাজারে সে দামে ওষুধও ছেড়েছি। ওষুধের মূল্য বিবেচনার প্রশ্ন যখন আসে তখন সরকারের কর্তৃপক্ষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। শিল্প আজ যে অবস্থায় এসেছে সেখানে না এলে, শতভাগ বা নব্বই ভাগ ওষুধ আমদানি করা লাগলে ৩০ হাজার কোটি টাকার বাজার হয়ে যেত ন্যূনতম দেড় লাখ কোটি টাকার। আর টাকার পুরোটাই তখন দেশের বাইরে চলে যেত। বিশাল একটা ব্যয় থেকে সরকার জনগণকে স্থানীয় শিল্প বাঁচিয়ে দিয়েছে। বিষয়টির দিকে কেউ খেয়াল করছে না। একটা ওষুধ উৎপাদন করে তার খরচ না উঠলে; যেমনওষুধের খরচ, কারখানার খরচ, বিপণন খরচসহ যাবতীয় ব্যয় বিবেচনায় রেখেই একটা দাম প্রস্তাব করতে হয়। করোনা এবং করোনার পর এসেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধের কারণে পুরো বিশ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খরচ আমাদের এখানে সাত-আট গুণ বেড়েছে। ৭৫ লাখ টাকার গ্যাসের খরচ এখন ডিজেল সিএনজি (কমপ্রেস ন্যাচারাল গ্যাস) মিলিয়ে হচ্ছে কোটি টাকারও বেশি। ডলারের দাম বেড়েছে। এখানেও খরচ বেড়েছে। বাড়তি খরচের সঙ্গে দামের সমন্বয় প্রয়োজন। বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা জরুরি। যখন আমরা দাম কম রেখেছিলাম তখন তো সরকার বাধ্য করে ওষুধের দাম কমায়নি। আমরাই কম রেখেছিলাম। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করি, কার আগে কে কত দাম কমাতে পারি। কমানোর একটি প্রতিযোগিতা চলে। যেখানে আমরা অচল, আর পারি না সেখানেই কেবল মূল্য বিবেচনার জন্য বলি। ওষুধ নীতিতে দুই ধরনের ওষুধ পণ্য রয়েছে। একটি অ্যাসেনশিয়াল আরেকটি নন-অ্যাসেনশিয়াল। নন-অ্যাসেনশিয়াল ওষুধের দাম নির্ধারণে আমাদের স্বাধীনতা ছিল। সে বিষয়টিও আমরা ভোগ করতে পারছি না। আমরা দাম বিবেচনার কথা বললে তা কিন্তু হওয়ার কথা। কেননা নীতিতে এমনটি বলাও রয়েছে।

১৯৮২ সালের ড্রাগ অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী দাম নির্ধারণের সুযোগ প্রতিষ্ঠানের ছিল না। পরবর্তী সময়ে সুযোগ প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়। সাধারণত প্রস্তাবিত দামই ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদন করে থাকে। সেক্ষেত্রে দাম নিয়ে আপনাদের অসন্তোষ থাকার কথা নয়।

ফার্মাসিউটিক্যালস প্রতিষ্ঠানের প্রস্তাবিত দামে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়। তবে এমন বহু প্রস্তাবই করা হয়েছে কিন্তু অনুমোদন দেয়নি। করোনা মহামারী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারের অস্থিতিশীল অবস্থায় আমরা তো দামের বিষয়ে সহযোগিতা পাইনি।

ওষুধের দাম নিয়ে কথা উঠলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, ভোক্তা, বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহলের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া থাকে। এর মূল বিষয় কী বলে আপনি মনে করেন?

সবার নজর হলো ওষুধের দিকে। সবাই দেখে, ওষুধের দাম বাড়ানো হলো কিনা, কিন্তু নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য পণ্যের দাম বৃদ্ধিতে কিন্তু বাধা নেই। অন্যান্য অভিজাত পণ্যের কথা না হয় বাদ দিলাম। তবে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মধ্যে তো খাদ্যও জরুরি। জীবনধারণের জন্য ওষুধের চেয়েও খাদ্য আগে। সেখানে দাম নিয়ে তো কোনো কথা হচ্ছে না। কেউ তো খাদ্যে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি, সেখানে ওষুধের দাম নিয়ে আমাদের ওপর এত খবরদারি কেন? দেশের লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে যাওয়া বন্ধ করেছি, এটা কি অপরাধ? আমরা বলছি, আমাদের খরচ ব্যবস্থাপনা বিবেচনা করে দাম সমন্বয়ের কথা। আমরা তো ইচ্ছামতো দাম ঘোষণার জন্য বলছি না। অন্য শিল্পের থেকে ওষুধ শিল্পের মধ্যে পার্থক্য হলো, কারখানার পরিবেশ ঠিক করতে হয়, বাতাসে বিভিন্ন ধাতুর ক্ষুদ্র কণা কীভাবে অপসারণ করা হবে, কতটুকু থাকবে, বাতাসে কোনো অণুজীবের উপস্থিতি রয়েছে কিনা; তাও দেখতে হবে। অর্থাৎ কারখানাকে পরিপূর্ণভাবে ওষুধ উৎপাদনে প্রস্তুত করতে হবে। এরপর যন্ত্রাংশের উপযোগিতা দেখতে হয়। এগুলো নিশ্চিত করতে না পারলে রোগীর যেকোনো ক্ষতি হতে পারে।

শতাধিক দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রফতানি হয়। প্রতি অর্থবছরে আয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। তবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ উন্নত কয়েকটি দেশে বাজারজাতের অনুমোদনের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা কী বলে মনে করছেন?

যুক্তরাষ্ট্রে ড্রাগ অ্যান্ড ফুড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) এবং যুক্তরাজ্যের মেডিসিনস অ্যান্ড হেল্থ কেয়ার প্রডাক্টস রেগুলেটরি অথরিটি (এমএইচআরএ) আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দেখতে শুরু করেছে। তারা কারখানার যেমন মান চায় তা করতে গেলে সে খরচ বাজার থেকে তোলা সম্ভব নয়। যথাযথ দাম না পেলে মানোন্নয়ন কঠিন। ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বেশ ব্যয়বহুল। একেক ধরনের ওষুধের জন্য কারখানার ব্যবস্থাপনা ভিন্ন ভিন্ন হতে হয়। তাপমাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। ওষুধ বাজারজাত করতেও আলাদা ব্যবস্থা রাখতে হয়। কেউ বলুক বা না বুলক আমরা ওষুধ উৎপাদনে সর্বোচ্চ মান নিয়ন্ত্রণ করছি। ওষুধের মান বজায় রাখতে প্রতিটি শর্ত আমাদের মানতে হয়।

বিদেশে রফতানীকৃত আর দেশীয় বাজারে যে ওষুধ যায় সব কি একই মানের কাঁচামালে তৈরি?

যে কাঁচামাল দিয়ে তৈরি ওষুধ বিদেশে রফতানি হচ্ছে তা দিয়েই দেশীয় বাজারের জন্য ওষুধ উৎপাদন করা হয়। এখানে কাঁচামালের কোনো তারতম্য করা হয় না।

আপনি বীকনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছাড়াও দেশের একজন আইনপ্রণেতা। ওষুধ শিল্পের ক্ষেত্রে সরকারের মনোভাব নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সরকারের অংশ হিসেবে থেকেও আমি বলি, সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন। ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়ন করতে হলে সব দিকেই উন্নয়ন করতে হবে। কোনো কিছু চাপিয়ে রাখলে আমাদের লক্ষ্য পূরণ হবে না। একদিকে মানবসম্পদ অন্যদিকে আধুনিক শিল্পের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। দুইয়ের সমন্বয়ে ২০৪১ সালের লক্ষ্য পূরণ সম্ভব।

ওষুধের দাম বাড়ালে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ হবেএমন ফোবিয়া থেকে বের হতে হবে। সবকিছুরই দাম বেড়েছে। ওষুধ শিল্পকে সহযোগিতা না করলে যদি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে কি ভালো হবে? যে পণ্য লাখ টাকায় কিনতে হতো সেই ওষুধ লাখ টাকায় পেলে মানুষের উপকার হচ্ছে না? বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা উচিত যে, কতটুকু সহযোগিতা আমাদের প্রয়োজন। তা না হলে শিল্পের একটি দিকই অন্ধকারে থাকছে। মুহূর্তে আমরা বায়োসিমিলার ওষুধ নিয়ে চিন্তিত। ওষুধ দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। নিবন্ধন করতে না পারলে চিকিৎসার ক্ষেত্রে জনগণ বঞ্চিত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন