বিভাগ ও জেলাভিত্তিক ক্যান্সার হাসপাতাল করার পরিকল্পনা রয়েছে

ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম ছবি: কাজী সালাহউদ্দীন রাজু

দেশে ক্যান্সার চিকিৎসায় বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু করেছে ল্যাবএইড গ্রুপ। হাসপাতালটির নানা দিক, রোগীদের জন্য সেবা আগামীর লক্ষ্য নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন ল্যাবএইড ক্যান্সার হাসপাতাল অ্যান্ড সুপার স্পেশালিটি সেন্টারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাকিফ শামীম।  সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তোফাজ্জল হোসেন 

ল্যাবএইড ক্যান্সারের জন্য কেন বিশেষায়িত হাসপাতাল চালু করল?

বিদেশে একটি হাসপাতালে আমি এক বছর কাজ করেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিলদেশের মানুষের জন্য কিছু করা, সাধারণ মানুষের সমস্যাগুলো সমাধান করা। আমার বাবা ব্যবসা করেছেন। তিনি খুবই সফল একজন মানুষ। ব্যবসায়ী পরিবারে যেহেতু আমার জন্ম, সে সূত্রেও একটা আগ্রহ ছিল। বাবাকে দেখেই আসলে মনে হলো দেশের জন্য কিছু করা দরকার। তাই দেশের বাইরে ক্যারিয়ার না করে দেশে ক্যারিয়ার করার চিন্তা করি।

আমাদের ক্যান্সার হাসপাতাল ছাড়া আরো অনেক ব্যবসা আছে। বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ফার্মাসিউটিক্যালসও আছে। প্রথমত, আমি এখানে বিজনেস অ্যাসোসিয়েট হিসেবে কাজ শুরু করি ২০০৭ সালে। আমাদের ফার্মাসিউটিক্যালসটা তখন হচ্ছিল। সেখানে বিভিন্ন স্তরে তিন বছর কাজ করার পর আমি ল্যাবএইড হাসপাতাল এবং ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আসি। আমি গ্রুপটির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর হিসেবে ১২ বছর কাজ করছি। ২০১৭ সালে আমাদের পরিকল্পনা ছিল বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোয় আমরা মনোযোগী হব। আমাদের পরিকল্পনায় ছিল নিউরো হাসপাতাল, মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাসপাতাল, ক্যান্সার হাসপাতাল করার। তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই, আগে ক্যান্সার হাসপাতাল দিয়ে শুরু করি। ক্যান্সার তো আসলে অনেক দীর্ঘ সময় ধরে বয়ে চলা একটা রোগ। এটা অনেক সময় পুরোপুরি ভালোও হয় না। তখন রোগী মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৮ সালে আমি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (এমডি) হিসেবে দায়িত্ব পাই যে, ক্যান্সার হাসপাতালটা আমার নেতৃত্বে হবে।

বাংলাদেশে ল্যাবএইড চালু করার উদ্দেশ্যই ছিল সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধান করা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রায় দেড় লাখ মানুষ প্রতি বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, কিন্তু সংখ্যাটা আসলে হবে পাঁচ-ছয় গুণ। একটি বড়সংখ্যক মানুষের রোগ ধরা পড়ে না। তখন থেকেই আমাদের চিন্তা ছিল ক্যান্সার হাসপাতাল করার। আমরা শুধু একটা ক্যান্সার হাসপাতাল নয়, বিভাগ এবং জেলাভিত্তিক ছোট ছোট ক্যান্সার হাসপাতাল করব। যেখানে রেডিওলজি, অনকোলজিসহ ক্যান্সার চিকিৎসার সব ব্যবস্থাই রাখব। যাতে সব ধরনের রোগীই যেন ক্যান্সারের চিকিৎসা পায়, সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য।

উন্নত দেশগুলোর বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালের সঙ্গে আপনাদের ক্যান্সার হাসপাতালের সাদৃশ সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানতে চাই।

আমাদের সেবার মান সিঙ্গাপুর বা ব্যাংকক থেকে কোনো অংশে কম নয়। আমাদের হাসপাতাল পুরোটাই প্রটোকল বেজড একটা হাসপাতাল। আমরা প্রথম থেকেই জয়েন্ট কমিশন ইন্টারন্যাশনাল যেভাবে হবে সেভাবেই এগোচ্ছি। পাশাপাশি ক্যান্সারের সঠিক দিকনির্দেশনা, রোগটা ধরা পড়ার পরই আমরা একটা মাল্টি ডিসিপ্লিনারি বোর্ড করি। রোগীর যতটা চিকিৎসা দরকার ততটুকুই আমরা দিই। কোনো ক্ষেত্রে যদি আমাদের মনে হয় আমাদের দিয়ে ভালোভাবে চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, সেক্ষেত্রে আমাদের পার্টনার হাসপাতাল আছে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল এবং সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ক্যান্সার সেন্টারের সঙ্গে আমরা বোর্ড করি এবং সেকেন্ড অপিনিয়নের ব্যবস্থা করিয়ে দিই।

ক্যান্সার বিশেষায়িত হাসপাতাল পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনি কী কী বিষয়কে সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখছেন?

আমাদের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে দক্ষ জনবল, দক্ষ নার্স, দক্ষ মিড লেভেল ডক্টর, দক্ষ নন-ক্লিনিক্যাল স্টাফ, অপারেশনাল স্টাফ। জায়গাগুলোয় এখন আমাদের দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। জায়গাটিতে আমরা এখন কাজ করছি। প্রশিক্ষণ উন্নয়ন নিয়ে কাজ করছি। অন্য কোনো হাসপাতালের তুলনায় আমাদের হাসপাতালের সুবিধা বলা হোক, সেবা বলা হোক আমরা সবই দিচ্ছি। তবে ট্রান্সপ্লান্টের সেবাটা বর্তমানে আমাদের নেই, বাকি সব সেবাই রয়েছে। অত্যাধুনিক ট্রুবিমএসটি মেশিন যখন বিশ্বে লঞ্চ করা হলো, তখন ভারতে এবং বাংলাদেশে একই সঙ্গে এসেছে। আমরা দুটি মেশিন এনেছি।

ক্যান্সার চিকিৎসা ব্যয়বহুল। আপনার হাসপাতালে চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে জানতে চাই।

আমাদের এখানে স্ক্রিনিংয়ের (ক্যান্সার শনাক্তকরণ) বিষয়ে আমরা যথেষ্ট সচেতন। প্রতিদিন আমরা ১০০ রোগীর ক্যান্সার শনাক্তকরণ করছি। বিষয়ে আমরা সচেতন। আমাদের সাড়ে ৪০০ থেকে ৫০০ করপোরেট কোম্পানি রয়েছে। তাদের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সেমিনার করছি। আমাদের ডাক্তাররা বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছেন সাধারণ মানুষের চিকিৎসা দিতে। আমরা ফ্রিতে শনাক্তকরণের কাজটা করছি, ফ্রি অপিডি করছি। আমরা আসলে সচেতনতার জন্য ডিজিটাল মিডিয়ায় যথেষ্ট প্রচারণা চালাচ্ছি। আমরা চেষ্টা করছি যেন জনগণ সচেতন হয়। আমার মনে হয়, প্রতি বছর একজন মানুষের -১০ হাজার টাকা খরচ করে শরীরে ক্যান্সারের কোনো প্রাদুর্ভাব রয়েছে কিনা সেটি যাচাই করে নেয়া উচিত। আমার মনে হয় না বছরে একবার করতে তাদের খুব বেশি বোঝা হবে। সমস্যা হয় যখন কারো শনাক্ত হয়, তখন তারা অনেক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে যান। তখন তারা এখানে-ওখানে যাওয়া শুরু করেন, বিদেশে যাওয়া শুরু করেন। আমরা একটা হিসাব করলাম যে দুই-তিন বছরে এভাবে একজন মানুষের ৬০-৭০ লাখ টাকা খরচ হয়ে যায়।

রেডিওথেরাপির খরচ আমাদের এখানে ভারতের সমানই। এখানে লাখ টাকা থেকে শুরু করে সাড়ে লাখ টাকা পর্যন্ত আছে। এছাড়া আইএমআরটিসহ কিছু টেকনিক আমরা করি। এখানে রোগীর একটা খরচ আসে। আড়াই থেকে লাখ টাকা গড়ে। এটা এক মাসব্যাপী চিকিৎসা। আরেকটা হচ্ছে কেমোথেরাপি। আমাদের এখানে বেডচার্জ অনেকটা সহনীয়। মাত্র হাজার টাকা। সমস্যাটা হয়ে যায় ওষুধের দাম। পার সাইকেলে ওষুধ লাগে ৪০-৫০ হাজার টাকার। যেমন ব্রেস্ট ক্যান্সারের জন্য কিছু ইঞ্জেকশন রয়েছে যেগুলোর একেকটার দাম দেড় লাখ টাকা। আমি মনে করি, ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসায় সবচেয়ে বড় যে খরচ সেটা ওষুধেই হয়। আরেকটা খরচ হয় সার্জারিতে। সার্জারিতে অনেক সময় লাগে, অনেক জটিল হয়। ফাইনালি আমি বলব জেনেটিক টেস্টিংয়েও অল্প পরিমাণে কিছু খরচ হয়। বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়াতে গেলে অ্যাক্রিডিয়েশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে করে সেবার মান বাড়ে। আন্তর্জাতিক অনেক সংস্থার স্বীকৃতি আমরা নিয়েছি। এতে করে রোগীর স্বাচ্ছন্দ্য বাড়ে।

সবার জন্য ক্যান্সার চিকিৎসা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কী রয়েছে এবং কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে?

ক্যান্সার অনেক ব্যয়বহুল এবং জটিল একটি রোগ। যেমন লাং ক্যান্সারের একজন রোগীকে অনকোলজিস্ট দেখালেই হবে না। তার রেডিওলজিস্ট লাগবে, প্যাথলজিস্টসহ নানা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ প্রয়োজন পড়বে। এখানে একটা চ্যালেঞ্জ। কারণ ডাক্তারের সংখ্যাও খুব কম। সাধারণ মানুষকে যখন চিকিৎসা দেয়ার ধাপ আসে, তখন এসব বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে আসা অনেক ব্যয়বহুল। সেক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে যদি আমাদের অগ্রিম আয়করের জায়গায় কিছুটা ছাড় দেয়া হয়, তাহলে রোগীর খরচটাও কমে যাবে। আরেকটা হচ্ছে প্রত্যেক মানুষেরই স্বাস্থ্যবীমা দরকার। ক্যান্সারের রোগীদের অনেক খরচ হয়। জমি বিক্রি করতে হয় অনেকের। জায়গায় স্বাস্থ্যবীমা খুবই সহায়ক হবে। এটা সরকারের পক্ষ থেকেই পদক্ষেপ নিতে হবে, যা খুবই জরুরি।

আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে কিছু বলুন।

আমি মূলত একজন উদ্যোক্তা। প্রতিষ্ঠানটা আমি শুরু থেকে নিজেই করেছি। সেখানে মেন্টরশিপ আমার বাবা আমাকে সবসময় দিয়েছেন। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ব্যবসা পারিবারিকভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমি মনে করি, যত বড় ব্যবসায়িক পরিবারের সন্তানই হোক না কেন, নিজে থেকে ছোট একটা কিছু হলেও করা উচিত। তাহলে আত্মবিশ্বাস বাড়ে আবার সবকিছু জানা বা বোঝা হয়ে যায়। তখন বড় কিছু করতেও সাহস পাওয়া যায়। আমার বাবা যখন শুরু করেন, তখন এতটা অবাধ তথ্যপ্রবাহ ছিল না। এখন ইন্টারনেট আছে, অনেক প্রশিক্ষণ আছে, অবাধ তথ্যপ্রবাহ আছে। জায়গা থেকে আমি মনে করি, আমরা অনেক ভাগ্যবান। বাবা-মা আমাদের অনেক পড়াশোনা করিয়েছেন। মানুষকে সচেতন করতে প্রযুক্তি নিয়ে আমরা অনেক সচেতন। আমরা ডিজিটাল প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, অ্যাপস এসবেও গুরুত্ব দিচ্ছি।

আমি ফাইন্যান্স নিয়ে পড়াশোনা করেছি। আমার এমবিএ ছিল করপোরেট ফাইন্যান্স এবং অন্ট্রাপ্রেনিউরের ওপর। আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ে তো আর অন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ শেখানো হয় না, পুঁথিগত যতটুকু। আমার অক্সফোর্ড থেকে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট এবং মেজর প্রোগ্রাম ম্যানেজমেন্টের ওপর মাস্টার্স করা আছে। হার্ভার্ড থেকে সম্প্রতি ক্লিনিক্যাল সার্ভের অপারেশনের ওপর নয় মাসের একটি প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং মাস্টার্স আরেকটা করেছি।

আমাদের হাসপাতালটাই ডিজিটাল। একজন রোগীর একটা রেজিস্ট্রেশন করা হয়। একটা আইডি থাকে আইডি অনুযায়ী তার সম্পূর্ণ হেলথ রেকর্ড আমরা ১০ বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করে রাখি। ডাক্তাররা যখন প্রেসক্রিপশন করেন, তখন সেটিও ডিজিটাল মাধ্যমে থাকছে। ইনভেস্টিগেশনগুলোও আইডিতে করা হচ্ছে। আমরা সবকিছুই অ্যাপস এবং আইটির মাধ্যমে সেন্ট্রালাইজড করছি। ফলে ডাটাভিত্তিক কাজ করতে পারি, ডাটার ওপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ভবিষ্যতে হাসপাতালে আমরা ট্রান্সপ্লান্টেশন নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী। আমাদের এখানে কিডনি লিভার ট্রান্সপ্লান্ট নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।


এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন