চসিকের প্রকল্প পরিচালককে মারধর

পেশায় নিরাপত্তাহীনতার অবসান চান প্রকৌশলীরা

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

জনপ্রতিনিধিত্বশীল একটি প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য কতদূর গড়িয়েছে তার উদাহরণ তৈরি হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে (চসিক) রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ এখানকার যুগ যুগের বাস্তবতা। সংস্কৃতির ভিত এতটাই গভীরে গেছে যে অন্যায় তদবির না রাখায় সম্প্রতি হামলার শিকার হতে হয়েছে সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত একজন দক্ষ প্রকৌশলীকে। সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে এমন ঘটনার নজির নেই।

চসিকের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীর ওপর হামলার ঘটনায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে এরই মধ্যে সোচ্চার হয়েছেন সারা দেশের প্রকৌশলীরা। অব্যাহত রেখেছেন প্রতিবাদ সভা, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি। তারা বলছেন, দেশে গড়ে ওঠা স্বার্থান্বেষী ঠিকাদারদের দৌরাত্ম্য শক্তভাবে দমন করা না গেলে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের বাধা আসবে। কারণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের ঊর্ধ্বতনরা। এছাড়া অনেকে নিজের সম্মান বিসর্জন দিতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে নিজেকে যুক্ত করতে চাইবেন না দেশের দক্ষ সৎ প্রকৌশলীরা।

চসিকে প্রকৌশলীর ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে চট্টগ্রাম প্রকৌশল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) শিক্ষক সমিতি। সংগঠনের সভাপতি . আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম যুগ্ম সম্পাদক . মো. আবুল হোসেন স্বাক্ষরিত সেই বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ভিশন-২০৪১ বাস্তবায়নে দেশের প্রকৌশলীরা সততা, দক্ষতা পেশাদারত্বের সঙ্গে কভিড- মহামারীতে সহযোদ্ধা হিসেবে দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করে উন্নয়নের ধারাকে সুরক্ষিত রেখেছেন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ করা যাচ্ছে, সরকারি দায়িত্ব পালনকালে প্রকৌশলীরা নানাভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। সরকারি দায়িত্ব পালনকালে সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে প্রকৌশলী গোলাম ইয়াজদানীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করা হয়েছে। ন্যক্কারজনক ঘটনায় সারা দেশের প্রকৌশলীদের মধ্যে চরম উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে।

চুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি যন্ত্রকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক . আবু সাদাত মুহাম্মদ সায়েম প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যে যার পেশাগত জায়গায় ঠিকভাবে কাজ করতে পারলেই দেশ এগোবে। পেশাগত জায়গায় কোনোভাবে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। চসিকের ঘটনা সমাজে একটা ভুল বার্তা দিচ্ছে। অর্থাৎ এখানে যা ইচ্ছা করা যায়। আমাদের দেশে অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প চলমান, যেখানে দেশের মেধাবী সৎ প্রকৌশলীরাই এখন নেতৃত্ব দিয়ে আসছেন। ধরনের অসম্মানজনক ঘটনা

ঘটতে থাকলে উন্নয়ন প্রকল্পে সৎ, দক্ষ ও তরুণ প্রকৌশলীরা এসে ঝুঁকি নিতে চাইবেন না। তাই কোনো ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা না রেখে আমাদের দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী চসিকের ঘটনায় জড়িতদের উপযুক্ত শাস্তি দাবি করছি।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, গোলাম ইয়াজদানী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী। বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন গুরুত্বপূূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়নে নেয়া আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প পরিচালক হিসেবে গত ১৪ আগস্ট তাকে স্থানীয় সরকার বিভাগ নিয়োগ দেয়। দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই তিনি অসাধু চক্র ভেঙে দিয়ে নিয়ম মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করতে চান। আর এতেই তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন রাজনীতিতে সক্রিয় ঠিকাদাররা। চসিকের প্রকল্প পরিচালককে গত ২৯ ডিসেম্বর বিকালে নগরের টাইগারপাসে সিটি করপোরেশনের প্রধান কার্যালয়ে তার কক্ষে ঢুকে মারধর করে কমপক্ষে ১৫ জনের একদল ঠিকাদার। সময় তার টেবিলের কাচ নামফলকও ভেঙে ফেলা হয়। 

ঘটনায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন সারা দেশের প্রকৌশলীরা। এর সঙ্গে যুক্ত প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে জোর দাবি জানিয়েছে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি) প্রকৌশলীদের যথাযথভাবে দায়িত্ব কর্তব্য পালনের স্বার্থে সন্ত্রাসী হামলা ধরনের মারধরের ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে সে লক্ষ্যে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিবৃতিতে। হামলার ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে দ্রুত গ্রেফতার করে আক্রান্ত প্রকৌশলীর নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, প্রচলিত ফৌজদারি আইনের আওতায় আনা, বিভাগীয় তদন্ত করে মাঠ পর্যায়ে কর্মক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করারও দাবি জানানো হয়েছে। 

আইইবির চট্টগ্রাম কেন্দ্রের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী প্রবীর কুমার সেন বণিক বার্তাকে বলেন, একজন দায়িত্বরত প্রকৌশলীর ওপর কোনোরূপ উসকানি ছাড়াই বর্বরোচিত হামলা সন্ত্রাসী আক্রমণ কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। চসিকের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানীকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে সরকারের যে পরিকল্পনা, তিনি তার প্রথম সারির দক্ষ প্রকৌশলী উঁচু মানের একজন প্রশিক্ষক। আমি মনে করছি, অনেক বড় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হওয়ার কারণেই সরকার সৎ যোগ্য অফিসারকে চসিকের জায়গায় সম্প্রতি নিয়োগ দিয়েছে। ফলে তার ওপর ঘটে যাওয়া ঘটনা সৎ দক্ষ প্রকৌশলীদের মনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তাই সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পে অসাধু ঠিকাদারদের চিহ্নিত করে কালো তালিকাভুক্ত করাসহ উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নতুবা দৌরাত্ম্য বেড়েই চলবে। আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকবেন কর্মকর্তরা। মানসিক জোর হারিয়ে ফেললে দক্ষদের দেশে তখন কোনোভাবেই ধরে রাখা যাবে না।

এদিকে চসিকের পক্ষ থেকে করা মামলার এজাহারেও উল্লেখ করা হয়েছে, প্রকল্প পরিচালক গোলাম ইয়াজদানী দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সততা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। এভাবে দায়িত্ব পালনের কারণে অসৎ ব্যক্তিরা অন্যায় সুবিধা নিতে না পেরে তার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে তারা প্রকৌশলীর সঙ্গে বাদানুবাদে লিপ্ত হয়েছে। কিন্তু প্রকল্প পরিচালক আইন মেনে দরপত্র প্রক্রিয়া পরিচালনা করায় তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। 

মামলায় আসামি হিসেবে ১০ ঠিকাদারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে অজ্ঞাতনামা আসামিও করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত তিন ঠিকাদারকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠিয়েছে পুলিশ। সেলফোনে যোগাযোগ করা হলে চসিকের উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক মো. গোলাম ইয়াজদানী হামলার বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

চসিক সূত্রে জানা গেছে, সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প হচ্ছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কালভার্ট নির্মাণ, ওভারপাস, সড়ক, সেতুসহ বিভিন্ন উন্নয়নকাজ হবে। আড়াই হাজার কোটি টাকার প্রকল্প জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদন পায় গত বছরের জানুয়ারি। প্রথম ধাপে ৩৭টি ভাগে (লটে) ২২০ কোটি টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল গত নভেম্বরে।

চসিক মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ভবনের সিসিটিভি ফুটেজ ভালোভাবে চেক করা হচ্ছে। অন্যায়ভাবে যারা কাজ পেতে চায়, তারাই হামলা চালিয়েছে। হামলাকারী ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্ত করা হবে। এরই মধ্যে ঘটনায় চসিকের পক্ষ থেকে মামলা করা হয়েছে এবং অ্যাকশনও চলছে। নীতির অবস্থান থেকে দোষীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ছাড় পাবে না দুষ্কৃতকারীরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন