বিশ্ব অর্থনীতি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর উচিত ধীরে চলো নীতি অনুসরণ করা

লুক্রেজিয়া রিচলিন

মূল্যস্ফীতির আকস্মিক প্রত্যাবর্তনে কঠোর মুদ্রানীতির জমানায় ফিরেছে বিশ্ব অর্থনীতি। কোনো সংকটে পড়লেই সুদহার বাড়িয়ে দাও- এমন সহজ সমীকরণে নিরাপদ বোধ করছেন নীতিনির্ধারকরা। সংকট সামাল দিতে এমন সুদহার বাড়ানোর পথে এগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড), ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ (ইসিবি) বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু এ পথে রয়েসয়ে এগোনোর কথা থাকলেও ফেড ও ইসিবির তড়িঘড়ি লক্ষণীয়। সামগ্রিক চাহিদার রাশ টানতে স্বল্পমেয়াদে সুদহার বাড়ানো হয়তো অনেকগুলো সমাধানের একটি। কিন্তু নীতিনির্ধারকরা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তাড়াহুড়ো করছেন কিনা সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। 

সর্বশেষ দফায় মুদ্রানীতিতে পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সমস্বরে আওয়াজ তুলেছে। যদিও ফেড, ইসিবি ও ব্যাংক অব ইংল্যান্ড (বিওই) একেবারে একই সময়ে সুদহার বাড়াচ্ছে, এমন নয়। তবে গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে ২০০ বেসিস পয়েন্ট সুদহার বেড়েছে। এ নীতির পেছনে প্রত্যেকেরই যুক্তি ছিল মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরা। 

বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে চলমান সংকটের কারণে বৈচিত্র্য থাকলেও সমস্বরে সুদহার বাড়ানোর ব্যাপারটা চমকপ্রদ বৈকি। বৈশ্বিক জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বগতির দিকে দৃষ্টি দেয়া যাক। ইউরোপের মতো নিট জ্বালানি আমদানিনির্ভর অর্থনীতির ক্ষেত্রে এটা বড় ধাক্কা হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণ রফতানি আয়ের চেয়ে তাদের আমদানি ব্যয় বেশি। স্বল্পমেয়াদে মূল্যস্ফীতির চাপে পড়লেও সময়ের ব্যবধানে প্রকৃত আয় ও সামগ্রিক চাহিদা কমতে পারত। ফ্রান্সের অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন, ২০২২ সালে দেশটির প্রকৃত আয় হ্রাসের পরিমাণ জিডিপির ৩ শতাংশ, যা প্রায় মহামারীপূর্ব মাত্রায় পৌঁছেছে।

ফ্রান্স ও জার্মানির মতো দেশ যেভাবে জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের বেলায় তা প্রযোজ্য নয়। বিশ্বের বৃহত্তম এ অর্থনীতি শীর্ষ জ্বালানি রফতানিকারক দেশগুলোর একটি। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির পেছনে অন্য কারণ থাকতে পারে। তাই মূল্যস্ফীতির রাশ টেনে ধরতে একই নীতি অনুসরণ থেকে বিরত থাকতে পারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো। 

হয়তো কেউ কেউ যুক্তি দেখাতে পারেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর আগ্রাসী নীতি ফল দিচ্ছে। ইউরো অঞ্চল, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে ভয়ের কারণ হলো, নীতিনির্ধারকরা দ্রুত নীতিগত সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। কথাটা বিশেষ করে ইউরোপের জন্য সত্য। জ্বালানি সংকটের কারণে প্রকৃত নিষ্পত্তিযোগ্য আয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে। 

দ্রুততার পেছনে কারণ থাকতে পারে। ইসিবির নিজস্ব পূর্বাভাস থেকে এটা ধরে নেয়া যায়, ২০২৫ সালের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশে নিয়ে আসতে চায় তারা। বিওইর পূর্বাভাস, ২০২৪ সালের চতুর্থ প্রান্তিক নাগাদ যুক্তরাজ্যের ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ১ দশমিক ৪ শতাংশে নামবে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির ২ শতাংশ মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার নিচেই। যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ওপেন মার্কেট কমিটির মধ্যমেয়াদি পূর্বাভাস, ২০২৪ সালের মধ্যে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ২ দশমিক ৫ শতাংশে থাকবে। 

পল ভলকার যখন ১৯৭৯ সালে ফেডের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন তখন বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ শতাংশ। ১৯৮২ সালে দুই বছরের মন্দা শেষে মূল্যস্ফীতি ৩ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হন তিনি। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত প্রায় ৪ শতাংশ গড় মূল্যস্ফীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। 

এখনকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো কেন এত তাড়াহুড়োর মধ্যে আছে? হয়তো নতুন করে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে এমন পরিস্থিতির শঙ্কা নীতিনির্ধারদের। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সংগতি রেখে শ্রমবাজারে বেতন ও কোম্পানির মুনাফাও ঊর্ধ্বমুখী থাকবে এমন চিন্তা থাকতে পারে তাদের। কিন্তু ইউরোপে বেতন ও দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী হবে এমন সম্ভাবনা আপাতত নেই। ইউরো মুদ্রা ব্যবহারকারী ইউরো অঞ্চলে বেতন বৃদ্ধির তেমন সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এছাড়া ১৯৮০-এর দশকে যেভাবে শ্রমিক ইউনিয়ন ক্রিয়াশীল ছিল এবং বেতন বৃদ্ধির চাপ ছিল, বর্তমানে এমন পরিস্থিতি বিরাজ করছে না। 

আরেকটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হতে পারে, কয়েক দশকে পলিসি অগ্রাধিকারে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিচে রাখতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে ছাড়া দিতেও কার্পণ্য দেখানো যাবে না, এ যুক্তিও ধোপে টেকে না। তিনটি প্রধান অর্থনীতির মধ্যে ইউরো অঞ্চল ১৫ বছর ধরেই শ্লথগতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। 

২০০৭-০৯ সালের বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে ইউরোপে রুগ্্ণ দশকের সূচনা। কভিড মহামারীতে বিশ্ব অর্থনীতিতে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। ২০১৯ সালের চতুর্থ প্রান্তিকের পর যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যেখানে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে সম্প্রসারণ হয়েছে সেখানে ইউরো অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ২ শতাংশ। এদিকে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি সংকুচিত হয়েছে শূন্য দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি বছর নিয়ে ওইসিডির পূর্বাভাস, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরো অঞ্চলের প্রবৃদ্ধি হবে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতি শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ সংকুচিত হবে। 

আরো এক দশক যদি শ্লথগতি বিরাজ করে তাহলে সেটি উৎপাদনশীল খাতের মারাত্মক বিপর্যয় কিংবা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। প্রলম্বিত এ অর্থনৈতিক স্থবিরতার মারাত্মক রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও থাকতে পারে। বিশেষ করে তা ইইউ ও যুক্তরাজ্যের জন্য উদ্বেগের।

এটি কল্পনা করাও কঠিন যে সমাজের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অংশের মানুষের ক্ষতি না করে অথবা উৎপাদন না হারিয়ে আরো এক দশক শ্লথ প্রবৃদ্ধির মধ্য দিয়ে যাওয়া যাবে। এ ধরনের অর্থনৈতিক স্থবিরতায় গুরুতর রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও বিভিন্ন দেশে বিশেষত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্যে দেখা দিতে পারে। 

পরিস্থিতি মোকাবেলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রার সঞ্চালন কমিয়ে আনতে দ্রুতই অগ্রসর হচ্ছে। কারণ তারা বিশ্বাস করে, নিম্নমূল্যস্ফীতি কর্মসংস্থান ও উৎপাদন বাড়ানোর ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, যা ১৯৮০ সালের দিকে দেখা গেছে। কিন্তু সব একাডেমিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ধারণাকে অমূলক বলেই মনে হয়। যখন বাণিজ্যের ভারসাম্যহীনতার কারণে উচ্চমূল্যস্ফীতির সৃষ্টি হয় তখন কঠোর মুদ্রানীতি উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের ক্ষতি করতে পারে। এটি মানুষের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেয়, যা বর্তমানে ইউরোপে দেখা যাচ্ছে। ইউরোপে অতিরিক্ত চাহিদাকেই উচ্চমূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হচ্ছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের এমন তাড়াহুড়া করার কেবল একটাই ব্যাখ্যা হতে পারে যে তারা এমন কিছু জানেন যা আমরা জানি না। এমন কিছু জেনে থাকলে আমাদেরকে জানানো উচিত। অন্যথায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাবধানতার সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উচিত। এতে ক্রমাগত আর্থিক সংকোচন বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তার প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত খারাপ হবে। এর নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতাকেও হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে। 

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট


লুক্রেজিয়া রিচলিন: ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গবেষণা পরিচালক, লন্ডন বিজনেস স্কুলের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ডস ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টি

ভাষান্তর: সাবিদিন ইব্রাহিম

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন