অভিমত

রাষ্ট্র ও নাগরিকের অসচেতনতা ও আমাদের বিদেশমুখীনতা

নিজাম আশ শামস

আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে যুগসন্ধিক্ষণের কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত আমাদের শুনিয়েছিলেন দেশপ্রেমের এক অমর কবিতা—‘ভ্রাতৃভাব ভাবি মনে, দেখ দেশবাসীগণে, প্রেমপূর্ণ নয়ন মেলিয়া। / কতরূপ স্নেহ করি, দেশের কুকুর ধরি, বিদেশের ঠাকুর ফেলিয়া।’ ঔপনিবেশিক আমলে দেশপ্রেমের এক অপূর্ব নজির দেখিয়েছিল ভারতবর্ষের জনগণ। তাতে অগ্রণী ভূমিকায় ছিল বাংলা। হয়েছে স্বদেশী আন্দোলন। গান্ধীজির আহ্বনে সাড়া দিয়ে বিলেতি দ্রব্য পরিহার করে ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড়’ মাথায় তুলে নিয়েছিল তারা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে—‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা,/ তোমাতে বিশ্বময়ী, বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা’ কিংবা ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি,/ চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।’ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন—‘বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।’ দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়িকে আপন করে নিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে আছে বিনয়-বাদল-দীনেশের কীর্তি। মাস্টারদা সূর্যসেন, কাজেম আলী, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, আদিব হাসান, বীরকন্যা প্রীতিলতা, শাহনেওয়াজ খান, কল্পনা দত্ত প্রমুখ নিজ কর্মে স্বীকৃতি পেয়েছেন ‘অগ্নিযুগের বিপ্লবী’ হিসেবে। তাদের নেতৃত্বে স্বদেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ বেনিয়াদের এ দেশ ছাড়তে বাধ্য করে ভারতবাসী। তারপর কেমন যেন থিতিয়ে যায় সবকিছু। ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র হোক কিংবা প্রয়োজনের খাতিরে হোক, ইতিহাসের ধারাবাহিকতাতেই অভ্যুদয় ঘটে নবগঠিত দুটি রাষ্ট্রের— ভারত ও পাকিস্তান। বহু আশা ও স্বপ্ন বুকে ধারণ করে এ দুটি রাষ্ট্রের যাত্রা। কিন্তু রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা ছিলেন ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ফলে তারা সবকিছু ইংরেজদের মতো করে ভাবতেই অভ্যস্ত ছিলেন। এটিকেই বলা হয় ঔপনিবেশিক মানসিকতা। এ মানসিকতার অনুবর্তী হয়ে তারা ইংরেজদের রেখে যাওয়া কাঠামো এবং নিয়মনীতি অনুসারে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। ইংরেজরা চলে যায় ঠিকই, কিন্তু রেখে যায় তাদের অনুগামী শাসকগোষ্ঠী। এ শাসক ও নীতিনির্ধারকরা এখানকার প্রকৃতি ও প্রয়োজন অনুসারে সবকিছু ঢেলে সাজানোর পরিবর্তে ঔপনিবেশিক আমলের কাঠামোই বজায় রাখে সবক্ষেত্রে। অবশ্য কিছু আগুন তখনো অবশিষ্ট ছিল। তার অন্যতম জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে জ্বালানি হৃদয়ে ধারণ করে, এক বুক আশা ও স্বপ্ন নিয়ে তিনি স্বাধীন করেছিলেন পাকিস্তানের অংশভুক্ত বাংলা অঞ্চলটিকে। বাংলাদেশ নামে নবযাত্রা হয় এককালের পূর্ব পাকিস্তানের।

পাকিস্তান আমলে পঞ্চাশের দশকে বঙ্গবন্ধু চীন ভ্রমণ করেন প্রথমবার পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯৫২ সালের অক্টোবরে  নয়াচীন কর্তৃক আয়োজিত শান্তি সম্মেলনে। ১৯৫৭ সালে তিনি পাকিস্তানের সংসদীয় দলের নেতা হিসেবে দ্বিতীয়বার চীন ভ্রমণ করেন। সে সময় তিনি শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ-এইড দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। চীন ভ্রমণের এ অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি যে ডায়েরি লিখেছিলেন, তা ২০২০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ‘আমার দেখা নয়া চীন’ শিরোনামে প্রকাশ হয়। এ বইয়ের পাতায় পাতায় বঙ্গবন্ধু তুলে ধরেছেন চীনের প্রতি সে দেশের নাগরিকদের অকৃত্রিম ও অকুণ্ঠ প্রেম, ভালোবাসা এবং মমতা দেখে তার মুগ্ধতার অনুভূতি। আর সে প্রেম এতটাই চূড়ান্ত ছিল যে বঙ্গবন্ধু সেখানে হন্যে হয়ে খুঁজেও একটি ব্লেড পাননি। কারণ চীনে তখন ব্লেড উৎপন্ন হতো না। আর মাও সে তুংয়ের নেতৃত্বে নয়া চীনের যে যাত্রা, সেখানে বিদেশী দ্রব্যের কোনো ঠাঁই ছিল না। চীনের আপামর জনসাধারণ কীভাবে দেশটিকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করেছিলেন তা উদ্ধৃত হয়েছে বইটির প্রতিটি চরণে। সেখানে বঙ্গবন্ধু এক চীনা দম্পতির ঘরে মেহমান হলে তারা তাকে উপহার দেয় চীনের তৈরি ‘লিবারেশন পেন’। আর্থিক মূল্যে খুবই সস্তা, কিন্তু তাদের কাছে তা এতটাই মহার্ঘ যে অতিথিকে উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে এর বিকল্প কোনো কিছু তাদের মনেই আসেনি। চীন ভ্রমণে প্রাপ্ত এ অভিজ্ঞতা বঙ্গবন্ধু কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে। সে লক্ষ্যে কাজও শুরু করেছিলেন তিনি। কিন্তু নিয়তির পরিহাস, বাংলাদেশ পুনর্গঠন পরিকল্পনা অসমাপ্ত রেখেই মর্মান্তিক ইতি ঘটে তার জীবনের। 

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেখান থেকে বাংলাদেশ এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি। পারেনি বিদেশমুখীনতা থেকে ফিরতে। স্বাধীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার আমরা করতে পারিনি। এটিকেই চিন্তাবিদ আহমদ ছফা বলেছেন ‘বেহাত বিপ্লব’। প্রকৃত অর্থে, আমরাই যেন বেহাত হয়ে গেছি আমাদের কাছ থেকে। আমাদের মননে বাংলাদেশ আছে কিনা, বাংলাদেশকে বাংলাদেশের মতো করে আমরা ভাবি কিনা, এ উত্তর আজ বুঝি কেউ হলফ করে বলতে পারি না। তবে ওপেন সিক্রেটের মতো আমরা সবাই জানি, আমাদের ভাবনা-চিন্তায় বাংলাদেশ নেই। আর তার প্রতিফলন ঘটেছে আমাদের সমাজজীবনের সর্বস্তরে।

বাসে করে অফিসে যাচ্ছিলাম। পল্টনের কাছে জ্যামে এক হকার ওঠে গাড়িতে। তার কাছে ‘চায়না’ কটন বাড। একজন বয়স্ক ক্রেতা হাতে নিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আসলেই চায়না তো!’ হকার উত্তরে বলল, ‘একদম চায়নার মাল। লোকাল মাল রাখি না। ওইগুলাতে সমস্যা।’ হকারের এ কথাতেই যেন ‘টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া’ সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিধ্বনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পর ‘আমার সোনার বাংলা’ এমন এক অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, আমরা আর দেশী কোনো কিছুর প্রতি আস্থা রাখতে পারছি না। দেশ তো বহু দূর কি বাত!

আমাদের মধ্যে যারা অবস্থাসম্পন্ন, তারা ঘুরতে মালদ্বীপ যায়, থাইল্যান্ড যায়, পাতায়া বিচে গিয়ে ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দিতে পারাকে মনে করে ‘স্ট্যাটাস সিম্বল’। কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এক দম্পতিকে দেখলাম ফেসবুকে একটি ভিডিও আপলোড করেছেন। সেখানে দেখা যায়, তারা তাদের সন্তানকে প্রথম আটলান্টিক সাগর দেখাতে নিয়ে গেছেন। বিশ্বাস করুন, ভিডিওতে যতটুকু দেখলাম, তাতে আটলান্টিকের সমুদ্রসৈকত আর কক্সবাজারের সৈকতের মধ্যে কোনো ফারাক আমি খুঁজে পাইনি। একই মনে হচ্ছিল। কিন্তু কক্সবাজার নিয়ে কি একই উচ্ছ্বাস আমাদের মনে কাজ করে? প্রতি বছর অনেক মানুষ যায় বটে, কিন্তু তাদের সামর্থ্যের মধ্যে অন্য কিছু নেই বলেই যায়। অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মতো। অথচ কক্সবাজার বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্রসৈকত। এত বড় একটি প্রাকৃতিক উপহার আমরা হাতে নিয়ে বসে আছি, অথচ সেটি সংরক্ষণ ও যথাযথ কাজে লাগিয়ে পর্যটন অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার কোনো উদ্যোগ আমাদের নেই। সেন্ট মার্টিনের অবস্থাও তথৈবচ। 

বিদেশে গেলে আমরা ঠিকঠাক আইন মেনে চলছি, যত্রতত্র ময়লা ফেলছি না; অথচ দেশে যেখানে সেখানে আবর্জনা ফেলতে আমাদের রুচিতে বাধছে না। নাগরিকদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্ব আছে। তেমনি রাষ্ট্রের প্রতি নাগরিকদেরও তো কিছু কর্তব্য আছে। আমরা কতজন সে নাগরিক কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন? পৌরনীতির সাধারণ জ্ঞানটুকুও আমাদের নেই। ফলে আমাদের ফুটপাতগুলো মূত্রে ভাসে। অবৈধ দখলদাররা সেগুলো দখল করে রাখে। অসাধু ব্যবসায়ীরা খাদ্যে ভেজাল মেশায়।

সব শ্রেণী-পেশার মানুষের মধ্যেই এমন অবস্থা। রাজনীতিবিদ, আমলা, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, ছাত্র প্রত্যেকেই সুযোগ পেলেই বিদেশ চলে যেতে চায়। ফলে গড়ে উঠছে বেগমপাড়া। দেশের সম্পদ চলে যাচ্ছে ইউরোপ, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে। মেধাবী ছাত্ররা বিদেশে পাড়ি দিয়ে সেখানকার অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। অথচ বাংলা মায়ের ঝুলি শূন্যই থাকছে। রোগীরা দেশের ডাক্তারদের প্রতি আস্থা রাখতে পারেন না। ভারতের ডাক্তাররা তাদের কাছে যেন একেকজন অবতার! আবার ভারতেও যাদের পোষায় না, তারা চলে যায় সিঙ্গাপুর। বাংলাদেশে থাকা বেসরকারি হাসপাতালগুলোও নিজেদের ব্যবসা বাড়ানোর জন্য বিদেশী ডাক্তারদের ভাড়া করে নিয়ে আসছে। তাদের সিরিয়াল পেতে এক সপ্তাহ, এমনকি এক মাস আগে থেকেও সিরিয়াল দিয়ে বসে থাকছেন এ দেশের মানুষ। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা থেকে যারা বিদেশে ডাক্তার দেখাচ্ছেন কিংবা দেশেই বিদেশী ডাক্তার দেখাচ্ছেন, তারা বিশ্ববাসীর কাছে নিজ দেশ সম্পর্কে কী বার্তা দিচ্ছেন?

শিক্ষা ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নেই। উচ্চশিক্ষা নিয়ে যাদের আগ্রহ, বিদেশ যেন তাদের কাছে স্বর্গ! ইউরোপ-আমেরিকা তো কথাই নেই, পার্শ্ববর্তী ভারত থেকেও কোনো রকমে একটি ডিগ্রি নিয়ে আসতে পারলে তার সম্মান বহুগুণে বেড়ে যায় আমাদের বিদ্বৎসমাজে। পক্ষান্তরে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা পিএইচডির যেন কোনো দামই নেই! এমন মানসিকতা থেকে যে হীনম্মন্যতা তৈরি হয়, তা তরুণদের  উদ্বুদ্ব করে যেকোনো মূল্যে বিদেশ চলে যেতে। 

ভাষার মাস শুরু হয়েছে। অথচ ভাষার ক্ষেত্রেও আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগি।  অভিভাবকরা সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়ানোটাকে কুলীনতার সমার্থক মনে করেন। ‘আমার ছেলের বাংলাটা ঠিক আসে না’—এ যেন আজ শাশ্বত সত্য। আমাদের ছাত্ররা বাংলা ঠিকঠাক শেখে না। অথচ ইংরেজির প্রতি তাদের নজর টনটনে। তারা ইংরেজির জন্য বহু টাকা খরচ করে শিক্ষক রাখেন। দেশে সরকারি-বেসরকারি সব চাকরিতেও ইংরেজির প্রাধান্য। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে পরীক্ষায় ইংরেজিতে লিখলে বাংলায় লেখার তুলনায় বেশি নম্বর পাওয়া যায়। আমাদের উচ্চ আদালতের রায় বাংলায় না ইংরেজিতে লেখা হবে, তা নিয়েও আছে নানা বিতর্ক! 

সংক্ষিপ্ত এ পরিসরে আমাদের বিদেশমুখীনতার সম্পূর্ণ চিত্র ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। উপরে যা তুলে ধরা হলো, তা বিক্ষেপ মাত্র। সবশেষে যা বলার তা হলো—বাংলাদেশের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র এবং নাগরিক, এ উভয় দিক থেকেই সংঘটিত অসচেতনতার কারণে জন্ম নিয়েছে বিদেশমুখীনতা। দিনে দিনে তা আরো তীব্র হচ্ছে। পাল্টা একটি প্রজন্ম তৈরি হতে আমাদের আর কত সময় অপেক্ষা করতে হবে!


নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন