নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান হয়েছে ৫৪ শতাংশ প্রতিবন্ধীর

প্রতিবন্ধীবান্ধব কর্মক্ষেত্র গড়ে তোলা হোক

নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি ৪০ লাখ মানুষ অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ কোনো না কোনোভাবে প্রতিবন্ধিতার শেকলে বন্দি। সমাজের ইতিবাচক মনোভাব বিলীন হওয়া এবং নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দীর্ঘসময় মেধা, যোগ্যতা ও কাজের দক্ষতা থাকার পরও প্রতিবন্ধী মানুষের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং উপযুক্ত সেক্টরে অংশগ্রহণের জন্য কোনো ধরনের সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। নিজ উদ্যোগই তাদের ভরসা। সম্প্রতি বণিক বার্তায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৫৪ শতাংশ প্রতিবন্ধীর নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো প্রত্যাশা অনুযায়ী চাকরিতে প্রতিবন্ধীদের নিয়োগ দিচ্ছে না। 

প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের আইন, নীতি ও কর্মসূচি রয়েছে। তবে এসব বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোর উদাসীনতা ও অবহেলার কারণে তাদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়ছে। যেসব প্রতিবন্ধী বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত তারা পুরোপুরি নিজ ইচ্ছায় ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং সচেতনভাবে কাজে যোগ দিতে পেরেছেন। দেশে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় প্রতিবন্ধীদের বড় একটি অংশ বাদ পড়ে যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেমন প্রতিবন্ধীবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি, তেমনি কর্মক্ষেত্রগুলোও প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী নয়। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীবান্ধব কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। 

প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা, উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অবহেলা রয়েছে। প্রতিবন্ধীরা যে সরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ কম পাচ্ছে, এজন্য সরকারের সেই কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা দায়ী। প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারের আইন, নীতিমালা ও প্রকল্প থাকলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক রয়েছে। প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন ও নীতির দিক দিয়ে উন্নত দেশগুলোর চেয়েও বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। তবে গলদটা বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াতেই। বিবিএস যে পরিসংখ্যান দিয়েছে বাস্তব চিত্র আরো কম। দেশের দৃষ্টি, শ্রবণ ও শারীরিক প্রতিবন্ধীরা যারা নিজ ইচ্ছায় লেখাপড়া শেষ করতে পারছেন তারা কোনো না কোনো কর্মক্ষেত্রে কাজ করছেন। প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা করা হলে তারা সম্পদে পরিণত হতে পারত। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সংস্থার প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থান নিয়ে কাজ করার কথা। তাদের উপযোগী করে তুলতে প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা। তবে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থা নিচ্ছে না। 

বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধিতা-সংক্রান্ত সনদে স্বাক্ষর করেছে অনেক আগে। সনদের ২৭ নম্বর আর্টিকেলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের কথা বলা আছে। সেই সঙ্গে তাদের জন্য উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টির কথাও বলা আছে। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩ সালের কর্মসূচিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি সংস্থান ও চাকরির ক্ষেত্রে সমান সুযোগের কথা খুব জোর দিয়ে বলা হয়েছে। সুতরাং দেশের আইন চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সহায়ক। কিন্তু এ আইন ও এর বাস্তবায়ন সম্পর্কে কতটুকু জানে মানুষ? এগুলো বাস্তবায়নের জন্য আগ্রহ আছে? সবাইকে এ ব্যাপারে আরো সচেতন হতে হবে। কর্মক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা পিছিয়ে আছেন, নাকি তাদের পিছিয়ে রাখা হচ্ছে, সেটাও ভাবতে হবে। শুধু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করলেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যাবে না। সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ধরেও রাখতে হবে। তারা যাতে ঝরে না পড়েন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। প্রতিবন্ধী মানুষের নিয়োগ পাওয়া যেমন জরুরি, তেমনি কর্মপরিবেশ ভালো রাখাটাও জরুরি। তারা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে আবার ঝরে পড়বেন। প্রয়োজনে তাদের সহায়তা দেয়া দরকার। কোথাও দেখা যায়নি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাকরি দেয়া হয়েছে কিন্তু তারা ঠিকভাবে কাজ করতে পারছেন না। তারা বরং আরো আগ্রহ নিয়ে কাজ করছেন। তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, সহযোগিতা করতে হবে। সেই সঙ্গে নিয়োগকর্তাদেরও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। 

বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত আছে, সব ধরনের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এবং প্রজাতন্ত্রের সব দপ্তরের চাকরির ক্ষেত্রে সব নাগরিকের জন্য সমান সুযোগ থাকবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩-এর অনুচ্ছেদ ১০-এ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যহীনতা, ন্যায়সংগত সুযোগ-সুবিধা, কোটা সুবিধাসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর অব্যাহতির কথাও বলা হয়েছে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১ অনুযায়ী কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় শতকরা পাঁচ ভাগ আসন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর জন্য সংরক্ষিত রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য সব কাজই উন্মুক্ত থাকা উচিত। প্রতিবন্ধিতা দিয়ে নয়—প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মূল্যায়ন করা উচিত অন্যান্য স্বাভাবিক (বা অপ্রতিবন্ধী) ব্যক্তিদের মতোই তাদের কাজের সামর্থ্য দিয়ে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যেসব উল্লেখযোগ্য বাধা প্রায়ই মোকাবেলা করতে হয়—তার মধ্যে একটি হচ্ছে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, যা অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই নিহিত আছে। এ রকম ধারণা বা দৃষ্টিভঙ্গি অনেকের মধ্যেই রয়েছে, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা কোনো কাজ করতে পারে না। আবার এমনো কথা শোনা যায়, যেখানে স্বাভাবিক মানুষই কাজ পাচ্ছে না সেখানে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য আপনার অত মাথাব্যথা কেন? নারী প্রতিবন্ধীরাই সাধারণত এ লৈঙ্গিক অবস্থান এবং প্রতিবন্ধিতাজনিত নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। সরকারি চাকরিতে প্রতিবন্ধী কোটা রয়েছে। সেখানেও যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রচলিত শিক্ষা পদ্ধতির ত্রুটির বিষয়টি বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কারিকুলাম প্রতিবন্ধীবান্ধব নয়। 

দেশে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আছে। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য যে রকম সেটআপ বা ইকুইপমেন্ট দরকার, সেগুলো সব জায়গায় গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। কর্মকর্তারা চাকরি ক্ষেত্রে যে ধরনের দক্ষতা চান, সরকার যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতধারায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সরকারের একক চেষ্টায় পরিবর্তন আসা কঠিন। এক্ষেত্রে বেসরকারি অংশীজনদের এগিয়ে আসতে হবে। প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে হবে ও প্রতিবন্ধীবান্ধব করতে হবে। আমাদের জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আছে, জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদ আছে, সমাজসেবা অধিদপ্তর আছে। সবার একসঙ্গে জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। 

সব হতদরিদ্র পরিবার এক নয়। সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তার কথা চিন্তা করলে যারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ও বঞ্চিত, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেসব হতদরিদ্র পরিবারে প্রতিবন্ধী রয়েছে, সেগুলোর ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি। এমন পরিবারগুলোয় আয়বর্ধনমূলক সহযোগিতা দেয়া প্রয়োজন, যাতে তারা দরিদ্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। প্রতিবন্ধী এসব পরিবার প্রায় সব দিক থেকে অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার। এসব পরিবারের দুই-তৃতীয়াংশ শিশুই শিক্ষাবঞ্চিত। শিক্ষা না পাওয়ায় কর্মদক্ষতা ও সক্ষমতাও তৈরি হচ্ছে না। তাই কর্মসংস্থানের বেশ দুর্দশা। আর আয় না থাকায় স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, খাদ্য নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থান—সব দিক থেকেই খুব মানবেতর জীবনযাপন করছে প্রতিবন্ধী পরিবারগুলো। 

প্রতিবন্ধীদের অধিকার ও সুরক্ষার জন্য আইন, নীতিমালা এবং কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলেও বাস্তবায়নের গতি মন্থর। প্রতিবন্ধীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃত সব অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সবাইকে নিরলসভাবে কাজ করতে হবে। যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত প্রতিবন্ধিতার ধরন দেখে উপযুক্ত জায়গায় প্রতিবন্ধীদের কাজ দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিবন্ধীর পরিবারকে জানাতে হবে, কোথায় প্রতিবন্ধীদের জন্য স্কুল রয়েছে, চিকিৎসা কেন্দ্র কোথায়, সরকারি সুযোগ-সুবিধা কী ইত্যাদি। প্রতিবন্ধীদের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ প্রদান, সামাজিক কুসংস্কার এবং পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে সম্ভব সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে আনা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন