বাংলাদেশে গ্যাস খাতে দেশী বড় বিনিয়োগ অসম্ভব কি

আবু তাহের

দেশের গ্যাস পেট্রোলিয়াম খাতে পর্যন্ত পুঞ্জীভূত বিদেশী বিনিয়োগ ৩৯৮ কোটি ডলারের কিছু বেশি। এর সিংহভাগই বিনিয়োগ হয়েছে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে। এছাড়া গ্যাস অবকাঠামো বা পাইপলাইন নির্মাণেও বিনিয়োগ রয়েছে। পুঞ্জীভূত বিনিয়োগের মধ্যে বড় একটি অংশ আবার মুনাফার পুনর্বিনিয়োগ। নিট মূলধনি বিনিয়োগ আছে পুঞ্জীভূত বিনিয়োগের অর্ধেকেরও নিচে, প্রায় ৪৯ শতাংশ।

বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারেরও কম মূলধনের বিদেশী বিনিয়োগই এখন দেশের গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রমের মূল চালিকাশক্তি। বিদেশী কোম্পানিগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক শেভরন একাই সরবরাহ করছে দেশে দৈনিক স্থানীয় গ্যাস উত্তোলনের প্রায় ৬০ শতাংশ।

বিদেশী কোম্পানিগুলো দেশে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনে বিনিয়োগ করেছিল মূলত উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আওতায়। বিনিয়োগে উৎসাহ দিতে দীর্ঘদিন ধরে চুক্তির আওতায় বিদেশী কোম্পানিগুলোকে নানা সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়েছে। তার পরও গ্যাস খাতে বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোর নিট মূলধনি বিনিয়োগ বিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশী কোম্পানিগুলোকেও বিনিয়োগে এমন উৎসাহ দেয়া গেলে দেশের সার্বিক গ্যাস খাতের চিত্র অন্যরকম হলেও হতে পারত। এর একটি বড় উদাহরণ হলো বাপেক্স। জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজারে সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত প্রতিষ্ঠানটিকে গ্যাস সংকটের সমাধানে প্রথম কার্যকরভাবে কাজে লাগানো হয়। ওই সময় এক বছরে মাত্র ৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগের মাধ্যমে গ্যাস খাতে সাশ্রয় করা গেছে প্রায় লাখ কোটি টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে ধরনের বিনিয়োগ অপর্যাপ্ত হওয়ার কারণেই দেশের গ্যাস খাত এখনো প্রয়োজনীয় মাত্রায় এগোতে পারেনি। খাতটিকে সংকটে ফেলে দেয়ার অন্যতম বড় কারণ হলো কার্যকর দেশী বিনিয়োগের অপর্যাপ্ততা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দেশের গ্যাস পেট্রোলিয়াম খাতে বিদেশীদের নিট মূলধনি বিনিয়োগ ১৯৩ কোটি ৬২ লাখ ডলার। এর মধ্যে গত তিন অর্থবছরে বিনিয়োগ ৫৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে নিট মূলধনি বিনিয়োগ ছিল ১০ কোটি লাখ ডলার। এরপর ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩০ কোটি ৯৪ লাখ ডলার নিট মূলধনি বিনিয়োগ হিসেবে এসেছে।

বর্তমানে দেশে গ্যাস জ্বালানি খাতে সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের। বাংলাদেশের গ্যাস পেট্রোলিয়াম খাতে দেশটির বিনিয়োগ ২৯৮ কোটি ডলারের। বিনিয়োগের প্রধান অংশটি এসেছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের কাছ থেকে।

দেশের গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রমে এখন সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে মার্কিন কোম্পানিটি। দেশে জাতীয় গ্রিডে মোট গ্যাস সরবরাহের অর্ধেকেরও বেশি উত্তোলন করছে শেভরন। আমদানীকৃত এলএনজি বাদ দিলে অবদান দাঁড়ায় প্রায় ৬০ শতাংশে। বিবিয়ানা, মৌলভীবাজার জালালাবাদ গ্যাসফিল্ড থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে কোম্পানিটি। তিনটি গ্যাসফিল্ড থেকে জাতীয় গ্রিডে দৈনিক সরবরাহ হচ্ছে ১৩৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস। মূলধনি বিনিয়োগের পাশাপাশি উত্তোলন থেকে পাওয়া মুনাফার অর্থ পুনর্বিনিয়োগের মাধ্যমে আরো গ্যাস অনুসন্ধানে কাজ করে যাচ্ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানটি। এরই মধ্যে শেভরন গ্যাস অনুসন্ধান এলাকা বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, কোম্পানিটি এখন দেশের লাখ ৮৬ হাজার একর এলাকাজুড়ে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বর্তমানে গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি দেশের ভূভাগে (অনশোর) গ্যাস উত্তোলন কার্যক্রম সম্প্রসারণে তত্পর হয়ে উঠেছে শেভরন। কোম্পানিটি এরই মধ্যে আরো কয়েকটি গ্যাসক্ষেত্রে উত্তোলন কার্যক্রম চালানোর আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, শেভরন এখন দেশের ভূভাগের ১১টি ব্লকের হাই প্রেসার জোনে অনুসন্ধান চালাতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

শেভরন বাংলাদেশের কমিউনিকেশনস ম্যানেজার শেখ জাহিদুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান জ্বালানি চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজন সুলভ প্রাকৃতিক গ্যাসের নিরাপদ নির্ভরযোগ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা। শেভরন বাংলাদেশ বিষয়টি নিয়ে সরকার পেট্রোবাংলার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ বজায় রাখার বিষয়ে সরকারকে সহায়তা করতে সম্ভাবনার জায়গাগুলোকেও আমরা যাচাই করে দেখছি।

গ্যাস পেট্রোলিয়াম খাতে বিনিয়োগের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরের অবস্থানে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া। দেশটির খাতে বিনিয়োগ ৭৪ দশমিক কোটি ডলার। এছাড়া নেদারল্যান্ডসের ১০ দশমিক কোটি, সিঙ্গাপুরের দশমিক কোটি, যুক্তরাজ্যের দশমিক কোটি, জাপানের দশমিক কোটি, সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দশমিক কোটি এবং অন্যান্য দেশের দশমিক কোটি ডলার বিনিয়োগ রয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ . তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে স্থানীয় বিনিয়োগ খুবই সামান্য। জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের জায়গাগুলো হলো তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কয়লা উত্তোলন। কিন্তু পিএসসি উন্মুক্ত না হওয়ায় দেশে বিদেশী বিনিয়োগও সেভাবে আকৃষ্ট করা যায়নি। অন্যদিকে বৃহৎ আকারে কয়লা উত্তোলনের সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় সেখানেও বিনিয়োগ আসেনি।

তবে মুহূর্তে বাপেক্সের মতো স্থানীয় প্রতিষ্ঠানকে যথাযথভাবে কাজে লাগানোর কথা ভাবছে সরকার। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আলী বণিক বার্তাকে বলেন, গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সের তত্পরতা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি। গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্স নিজস্ব বিনিয়োগ এবং গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ব্যবহার করছিল। এখন বৃহৎ আকারে গ্যাস অনুসন্ধান কর্মপরিকল্পনা বড় হওয়ায় সরকারি তহবিল ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতি বছর বাপেক্স যে পরিমাণ প্রকল্প গ্রহণ করছে, জ্বালানি বিভাগও চাহিদা অনুযায়ী সে পরিমাণ অর্থ সহায়তা দিচ্ছে। আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে জ্বালানি বিভাগের। যদিও কাজের তত্পরতা বিবেচনায় তা ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে বাপেক্সের।

দেশে গ্যাস খাতের উন্নয়নের অংশ হিসেবে বরাবরই আমদানিনির্ভরতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে দেশে মজুদ গ্যাসের ক্রমবর্ধমানহারে হ্রাসের প্রেক্ষাপটে এলএনজি আমদানি নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। এলএনজি আমদানিনির্ভরতা বাড়ানোর কারণে দেশে গ্যাস অনুসন্ধান এক প্রকার স্থবির অবস্থায় ছিল দীর্ঘদিন, যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের কারণে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে গত বছর থেকে জোর পেয়েছে।

আমদানিনির্ভর গ্যাসে জোর দিতে গিয়ে গত চার অর্থবছরে পেট্রোবাংলা প্রায় ৮৫ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকার মতো এলএনজি আমদানি করেছে। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী তা দাঁড়ায় ৮০৭ কোটি বা বিলিয়ন ডলারেরও বেশিতে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত গ্যাস আমদানি করেছে জ্বালানি বিভাগ। চার অর্থবছরে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্স বিনিয়োগ পেয়েছে মাত্র হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে স্থবিরতা দূর না করে এলএনজি আমদানি বাবদ বিপুল অর্থের সংস্থান করতে গিয়ে অর্থ সংকটে পড়েছে পেট্রোবাংলা।

যদিও জ্বালানি বিভাগ বলছে, গত ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। সময়ে ২১টি অনুসন্ধান কূপ, ৫০টি উন্নয়ন কূপ এবং ৫৬টি ওয়ার্কওভার কূপ খনন করা হয়েছে। এছাড়া ছয় হাজার কিলোমিটার থ্রিডি সিসমিক সার্ভে, হাজার ৩৫৫ কিলোমিটার গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন, জ্বালানি তেলের মজুদাগার এবং সরবরাহ পাইপলাইন নির্মাণ বাড়ানো হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি খাত আজ যে পর্যায়ে এসেছে সেটি যদি বিদেশী কোম্পানি ছাড়া করা হতো, তাহলে ধীর গতিতে হতো। হয়তো ১০ বছর বেশি সময় লাগত। গ্যাস অনুসন্ধানে বাপেক্সের সক্ষমতা শতভাগ কাজে লাগিয়ে এরপর বাইরে থেকে সহায়তা আনতে হচ্ছে। এখন যদি বাপেক্সকে দিয়ে সব অনুসন্ধান-উত্তোলন করতে হয়, তাহলে তা- হতে পারে। সে ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় গ্যাস পেতে ১০-২০ বছর সময় লাগতে পারে। বাপেক্সকে শক্তিশালী করার জন্য সরকারের অনেকগুলো কার্যক্রম আছে, সেগুলো পর্যায়ক্রমে করতে হচ্ছে, গ্যাস সরবরাহ সক্ষমতা বৃদ্ধি তো রাতারাতি করা সম্ভব না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন