পর্যালোচনা

ব্যক্তি খাতে জ্বালানি আমদানির উদ্যোগে ঝুঁকিতে জ্বালানি নিরাপত্তা

ড. এম শামসুল আলম

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বেসরকারি খাত চাইলে তাদেরকে জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ হলেও মানুষের দৃষ্টি তেমন আকর্ষণ করেনি। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছে, বিশ্বের অনেক দেশে এ নিয়ম রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিশ্বের কোনো কোনো দেশে এমন নিয়ম সেসব দেশের জন্য সুফল বয়ে আনলেও আমাদের জন্যও সুফল দেবে, এমন নিশ্চয়তা কি আছে? এমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য কোনোভাবেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশে কোনো পণ্যের দামের ওপর বাজার কিংবা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, কোনো পণ্যের আমদানি বা বিক্রি সবকিছু বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হলে বাজারে পূর্ণ প্রতিযোগিতা থাকতে হয়। না হলে সরকারকেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। বাংলাদেশের বাজারে প্রতিযোগিতা নেই। সেটি ভোজ্যতেল, আটা, চাল, ডিম ও চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর মূল্য যখন-তখন ব্যবসায়ীদের ইচ্ছামাফিক বৃদ্ধিতে উপলব্ধি করা যায়। এসব পণ্য সরবরাহ গুটি কয়েক ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে। জ্বালানি বাজার বিদ্যমান আইন অনুযায়ী রেগুলেটেড বা নিয়ন্ত্রিত। আইনের আওতায় প্রতিষ্ঠিত নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবুও জ্বালানি খাত নিয়ন্ত্রণে নেই। অন্যায়, অযৌক্তিক ও লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা বৃদ্ধি তথা অসাধু ব্যবসা প্রতিরোধ করা যায়নি। বেসরকারি কোম্পানিগুলোকেও নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। বরং সরকার নানা পলিসি ও আইন তৈরির মাধ্যমে তাদের স্বার্থ সুরক্ষা করে যাচ্ছে বছরের পর বছর।

দুই.

বাংলাদেশে এলপিজি আমদানি হয় বেসরকারি খাতে। সরকারি খাতে উৎপাদিত যৎসামান্য এলপিজি সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি এলপিজিসিএল বাজারজাত করে। তবে সে এলপিজি খোলা বাজারে আসে না। আমদানীকৃত এলপিজি মূল্য অপেক্ষা প্রায় অর্ধেক মূল্যে এই এলপিজি সমাজের এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী গ্রাহক পান। ক্যাবের পক্ষ থেকে সাশ্রয়ী দামে এ এলপিজি বস্তিবাসীকে এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হোটেল ও রেস্তোরাঁয় সরবরাহ করার দাবি করা হয়। কিন্তু সে দাবি জ্বালানি বিভাগ আমলে নেয়নি, বরং নানা পলিসি প্রণয়ন করে এলপিজির বাজারে অলিগোপলি প্রতিষ্ঠিত করে। সাশ্রয়ী দামে সরকারি এলপিজি পাওয়ার অধিকার থেকে একদিকে সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত করে, অন্যদিকে এলপিজির বাজারে অলিগোপলি প্রতিষ্ঠিত করে এলপিজি ব্যবসায়ীদের লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করার সুযোগ দেয়। অবশেষে হাইকোর্টের বাধ্যতামূলক আদেশে বিইআরসি এলপিজির মূল্যহার প্রতি মাসেই পুনর্নির্ধারণ আদেশ দেয়। সে আদেশ না মানা বিইআরসি আইন মতে দণ্ডনীয় অপরাধ। অথচ এলপিজি ব্যবসায়ীরা সে আদেশ মতে নির্ধারিত মূল্যহার অপেক্ষা অধিক মূল্য হারে এলপিজি বিক্রি করে লুণ্ঠনমূলক মুনাফা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। অথচ এ অভিযোগ নিষ্পত্তিতে বিইআরসি নিষ্ক্রিয়। 

তিন.

জ্বালানি তেল আমদানিতে তিনটা পর্যায়ে ব্যবসা হয়: (ক) আমদানি, (খ) মজুদ ও  (গ) বিতরণ। এ তিনটি ব্যবসার জন্য পৃথক পৃথক তিনটি লাইসেন্স প্রদানের বিধান রয়েছে। বিইআরসি আইন অনুযায়ী এ তিনটি ব্যবসা তিন আলাদা আলাদা প্রবিধান দ্বারা বিইআরসির আওতাধীনে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হওয়ার কথা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, আইন লঙ্ঘন করে বিইআরসির পরিবর্তে জ্বালানি বিভাগ নিজেই তিনটি পর্যায়েরই ব্যয়হার গণশুনানি ছাড়াই নির্ধারণ করে জ্বালানি তেলের মূল্যহার নির্ধারণ করে। এ অবৈধ উপায়ে নির্ধারিত মূল্যহারে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা সম্পৃক্ত থাকে। 

চার.

এ কথা সত্য, বিশ্বের বহু দেশেই বেসরকারি খাত জ্বালানি সরবরাহ করে। সেসব দেশে শক্তিশালী নিয়ন্ত্রক সংস্থা আছে, আছে আইনের কঠোর প্রয়োগ। আবার বাজারে প্রতিযোগিতাও আছে। বাংলাদেশে এর কোনোটিই নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যেখানে সামান্য ভোজ্যতেলের দামই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে না, সেখানে জ্বালানি পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা কোনোভাবেই ভাবা যায় না। আইনের কার্যকারিতা অনেক  ক্ষেত্রেই দেখা যায় না। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নেই। বেসরকারি খাতের অবস্থা আরো নাজুক। কী দরে পণ্য আমদানি হয়, আর কী দরে বিক্রি হয়, তার হিসাব কে রাখে? এলপিজি ব্যবসায় কী চলছে? বিইআরসি দাম নির্ধারণ করে দেয়, বাজারে সে দামে এলপিজি বিক্রি হয় না। জ্বালানি তেল ও গ্যাস আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হলে একই অবস্থা হবে। তাতে ভোক্তার কী অবস্থা হবে! শুধু ভোক্তা কেন, শিল্প উদ্যোক্তাদেরই বা কী অবস্থা হবে! উৎপাদন খাতে জ্বালানি নিরাপত্তা কতটা ঝুঁকিতে পড়বে? নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এসব কোনো কিছুই না ভেবে জ্বালানি আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার কথা তোতা পাখির মতো শেখানো কথার মতো করে বলা হচ্ছে।

পাঁচ.

বেসরকারীকরণের ভূত সরকারকে পেয়ে বসেছে। ব্যক্তি খাতে ছেড়ে দেয়ায় এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। ফলে ভর্তুকি বাড়াচ্ছে। ভোক্তাও বাড়তি দামে বিদ্যুৎ কিনছেন। বিদ্যুৎ সঞ্চালনও বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার পর্যায়ে। তাতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যয় বাড়বে। গ্যাস সরবরাহ কমলেও সঞ্চালন ক্ষমতা ও ব্যয় বাড়ছে। বিদ্যুৎ আমদানি বাড়ছে। ফলে ব্যয় বাড়ায় মূল্যহার ও ভর্তুকি বাড়ছে। গ্যাস আমদানি বৃদ্ধিতে গ্যাসে ভর্তুকি ও মূল্যহার বাড়ছে। আবার জ্বালানি আমদানি বেসরকারি খাতে হবে। তাতেও জ্বালানি সরবরাহ ব্যয় বৃদ্ধিতে জ্বালানি মূল্যহার আরো বাড়বে। সর্বোপরি লুণ্ঠনমূলক মুনাফা স্ফীত হবে। জনগণ ও রাষ্ট্রের ক্ষত বাড়বে। তাতে হিতে বিপরীত হবে।

ছয়.

চাহিদার তুলনায় এলপিজি সরবরাহ ক্ষমতা প্রায় আড়াই গুণ। কাজে লাগে কম-বেশি ৪০ শতাংশ। বাদবাকি ৬০ শতাংশই কাজে লাগে না। তাতে সরবরাহ ব্যয় বাড়ে। এ ব্যয় বৃদ্ধি ব্যবসায়ীর মুনাফা বাড়ায় এবং ভোক্তাকে ন্যায্য ও সঠিক মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে এলপিজি কিনতে হয়। শুধু তাই নয়, আশ্চর্যের বিষয় হলো, ২০২১ সালে গণশুনানিতে উপস্থাপিত তথ্যাদিতে জানা যায়, এলপিজি আমদানিতে জাহাজ ভাড়া বাবদ টনপ্রতি ব্যয় ভারতে কম-বেশি ২০ ডলার। বাংলাদেশে কম-বেশি ১১২ ডলার। এমন অসংগতির কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগকৃত মূলধনের ওপর ১৮ শতাংশ এবং মোটের ওপর আরো ১৮ শতাংশ হিসেবে মুনাফা চান। বিইআরসির মানদণ্ডে তা ৪ দশমিক ১৮ থেকে ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এ দৃষ্টান্ত  থেকে বোঝা যায়, তেল-গ্যাস আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হলে দাম বৃদ্ধির অভিঘাতে ভোক্তারা কী পরিণতির শিকার হবেন।

সাত.

এ কথা সত্য, বিপিসিতে প্রচুর অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়। সেখানে প্রশাসনিক অস্বচ্ছতা এবং সুশাসনের বড় অভাব। জবাবদিহিতা নেই। তাদের অন্যায়, দুর্নীতি ও লুণ্ঠনমূলক কর্মকাণ্ডে জ্বালানি বিভাগের প্রশ্রয় রয়েছে। আমরা এসবের প্রতিকার ও প্রতিরোধ চাই। অথচ বিপিসির দুর্নীতি বন্ধ না করে, তার সার্বিক সক্ষমতা উন্নয়নে দৃষ্টি না দিয়ে বেসরকারি খাতকে জ্বালানি আমদানি করার ক্ষমতা প্রদান দেশের স্বার্থ বিনষ্টের শামিল। সরকার জনসাধারণের স্বার্থ সুরক্ষার দায় নিতে অনাগ্রহী। সরকারের এমন অবস্থা রাষ্ট্রের দর্শনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

আট.

বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েল আমদানি যখন বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হয়, তখন পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপিসি কর্তৃক সরবরাহকৃত ফার্নেস অয়েলে কোনো দোষত্রুটি পিডিবি পায়নি। অথচ এমন অজুহাতে বেসরকারি খাতকে ফার্নেস অয়েল আমদানির সুযোগ দেয়া হয়। ২০২২ সালে গণশুনানিতে বলা হয়, বিপিসির কাছ থেকে পিডিবি প্রতি টন ফার্নেস অয়েল ক্রয় করে ৭৪ ডলার মূল্যে। অথচ বেসরকারি খাতকে দিতে হয় ৯২ ডলারে। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বাড়ে বছরে কম-বেশি ৮ হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত ফার্নেস অয়েলের প্রায় ৯০ শতাংশই আমদানি হয় বেসরকারি খাতে। জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেশি বৃদ্ধি হয় কেন, এ প্রশ্নের উত্তর ওই ৮ হাজার কোটি টাকা বাড়তি ব্যয়েই নিহিত এবং তেল ও গ্যাস আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার কারণও এখানেই নিহিত। 

নয়.

জ্বালানি নিরাপত্তা খাদ্যনিরাপত্তা থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জ্বালানি নিরাপত্তা না থাকলে খাদ্যনিরাপত্তাও থাকবে না। জ্বালানি নিরাপত্তা সংরক্ষণের লক্ষ্যে কত উপায়ে সহনীয় ও সাশ্রয়ী মূল্যে জনগণের কাছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, সে চেষ্টায় বিশ্বের নানা দেশের সরকারগুলো গলদঘর্ম। অথচ আমাদের সরকার এ খাতকে বেসরকারি খাতের হাতে তুলে দিয়ে নিজে দায়মুক্ত হতে চায়। খাদ্য ব্যবসায়ীরা লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ পান। জ্বালানি আমদানি বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া হলে জ্বালানি ব্যবসায়ীরাও লুণ্ঠনমূলক মুনাফা লাভের সুযোগ পাবেন। জ্বালানি নিরাপত্তা অনিশ্চিত হবে। অর্থনীতি আরো কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারাবে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশ কোথায় যাবে, তা কি সরকার ভাববে না? আমরা চাই, সরকার রাজা-বাদশা হবে না, গণতান্ত্রিক হবে।


ড. এম শামসুল আলম: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন