দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় বড় ভরসা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়

মানসম্পন্ন ও যুগোপযোগী শিক্ষা নিশ্চিত করা হোক

নিম্নমধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবার থেকে উচ্চশিক্ষায় আসা সর্বোচ্চসংখ্যক শিক্ষার্থীদের আশ্রয়স্থল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যারা টাকার অভাবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে নামতে পারেন না। আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অনেক দূরের কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে বেশি অবহেলা আর উদাসীনতার শিকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েও দৃশ্যমান উন্নতির ছোঁয়া পাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়টির ব্যয় যত বেড়েছে ভোগান্তিও বেড়েছে তত বেশি। যে সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা হয়েছিল, তা নিরাশায় পরিণত হয়েছে। বছরের পর বছর কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অনাদরে সমস্যার স্তূপ জমতে জমতে পাহাড়সম আকার ধারণ করেছে। দেশের প্রতিটি জেলায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ রয়েছে। এগুলোকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করার মাধ্যমে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের মানসম্পন্ন শিক্ষা প্রদান করা কঠিন কিছু নয়। প্রত্যাশা থাকবে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারের উদ্যোগ নেবে।   

উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। শিক্ষায়ও এগিয়ে যাচ্ছি বলে অনেকে দাবি করে থাকেন। তারা হয়তো জানেন না দেশের শিক্ষার্থীরা চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘোরেন, হতাশ হয়ে আত্মহননের পথও বেছে নেন কেউ কেউ। ১৯৯২ সালে উচ্চশিক্ষায় সেশনজট নিরসনের কথা বলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। দীর্ঘ ৩০ বছরে পার করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু পরিস্থিতির উন্নতি খুব একটা হয়নি। পুরনো সংকট নতুন রূপে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা ক্লাস করেন না। কেন ক্লাসে আসেন না? প্রশ্নটা হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে পাস করা একজন শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে কেন ক্লাস করতে চান না, তার কারণ কী? শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই, পরীক্ষার হলরুম নেই, অধিকাংশ কলেজে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই, লাইব্রেরিতে বই নেই, অনেক কলেজে যাতায়াতের ব্যবস্থা নেই, বেশির ভাগ কলেজে আবাসন ব্যবস্থা নেই। আর যে কয়েকটি ক্যাম্পাসে আবাসন সুবিধা আছে, সেগুলোয় আবার ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের কর্তৃত্ব থাকে। 

অনেক কলেজে দেখা যায় বছরে একটি ক্লাসও হয় না। এক্ষেত্রে শুধু শিক্ষক কিংবা কলেজের ওপর দোষ চাপানো ঠিক হবে না। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কলেজে কিংবা ক্লাসে উপস্থিত থাকেন না। তবে এর দায়ও বিশ্ববিদ্যালয়টি এড়াতে পারে না। কারণ শিক্ষার্থীরা কেন ক্লাসে আসছেন না, কী তাদের সমস্যা এসব তদারকি করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং ক্লাসে ছাত্রদের টানতে না পারার ব্যর্থতা কলেজের শিক্ষকদেরও নিতে হবে। এজন্য যেকোনো পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, কিন্তু কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। মাথাপিছু বরাদ্দের দিক থেকেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বঞ্চিত করা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীর পেছনে খরচ মাত্র ১ হাজার ১৫১ টাকা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার কারিকুলাম থেকে শুরু করে স্বতন্ত্র পরীক্ষা ব্যবস্থা আর বৃহৎ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জনগোষ্ঠীর পড়াশোনার সিলেবাসের তফাৎ তৈরি হয় ওই বরাদ্দ থেকেই। একই বিষয়ে কোনো সিলেবাস পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক রকম, অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজে রয়েছে ভিন্নতা। কেউ ইংরেজি বই পড়াচ্ছে, আবার কেউ বাংলা। 

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোয় পর্যাপ্ত শ্রেণীকক্ষের অভাব রয়েছে। গবেষণাগার থাকলেও সেখানে নেই পর্যাপ্ত গবেষণাসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি। আর লাইব্রেরিগুলোয় সংশ্লিষ্ট বিষয়ের ওপর বইয়ের ব্যাপক সংকট রয়েছে। এসব কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই সমস্যা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এছাড়া বর্তমানে সব ক্ষেত্রে তথ্য ও প্রযুক্তির ওপর জোর দেয়া হলেও সরকারি কলেজগুলোয় স্নাতক পর্যায়ে প্রযুক্তিবিষয়ক কোনো ডিগ্রি দেয়া হয় না। এসব কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী তথ্য ও প্রযুক্তির ব্যবহারেও অনেক পিছিয়ে। কিছু বেসরকারি কলেজে এভিয়েশন সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিডউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফ্যাশন টেকনোলজি বিষয়ে স্নাতকে ডিগ্রি দেয়া হলেও তার পরিমাণ খুবই সামান্য। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোর মধ্যে বেশির ভাগেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীর জন্য ডেডিকেটেড ইন্টারনেট সংযোগ নেই। আর যেসব কলেজে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে, সেখানে ব্যান্ডউইডথের মান খুবই নিম্নমানের। তবে কিছু ক্ষেত্রে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও তার সুফল শুধু শিক্ষক-কর্মকর্তারা ভোগ করেন। শিক্ষার্থীরা এসব প্রযুক্তিগত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যাপীঠ। বিপুল শিক্ষার্থীর ভবিষ্যতের কথা বিবেচনায় রেখে একে আন্তর্জাতিক মানের করে তুলতে হবে। নিয়মিত ক্লাস এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকদের মাধ্যমে পাঠদান, নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্ট, প্র্যাকটিক্যালসহ ক্লাসের উপস্থিতির মাধ্যমে ইনকোর্স নম্বর প্রদান করার নিয়ম রয়েছে,  কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় ক্লাসে উপস্থিত থাকার চেয়ে প্রাইভেটে উপস্থিত থাকা বাধ্যতামূলক। এতেই মিলে যায় ইনকোর্স নম্বর। এসব সমস্যার সমাধান যতদিন হবে না, ততদিন এমন পরিবেশ থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়টির। দেশের দরিদ্র ও নিম্নবিত্ত পরিবারের উচ্চশিক্ষার অবলম্বন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য শুরু হয়। অর্থাভাবে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ার সুযোগ হয় না নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের। পরিবার খরচ চালাতে না পারায় যাওয়া হয় না কোচিং কিংবা প্রাইভেট টিউশনে। এ কারণে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকাটাই দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যায়ে দরিদ্র পরিবারের খুব কম শিক্ষার্থীরই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ মেলে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোর ওপর নির্ভর করতে হয় উচ্চশিক্ষাপ্রার্থী দরিদ্র শিক্ষার্থীদের। পড়তে আসার পরও কলেজে গিয়ে তারা ফের বৈষম্যের মুখোমুখি হন। কারণ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলোয় উচ্চশিক্ষার ন্যূনতম মানদণ্ডও অনুসরণ করা হয় না। শ্রেণীকক্ষের পাঠদান ঠিকমতো নিশ্চিত করা হচ্ছে না। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। 

বাংলাদেশ আজ যে উন্নয়নশীল দেশের বিশ্ব-স্বীকৃতি লাভ করেছে, তার মূলে রয়েছে শিক্ষার অবদান। তবে মনে রাখা আবশ্যক, বর্তমান সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানভিত্তিক সৃষ্টিধর্মী উদ্ভাবনী শিক্ষাই পারে একটি জাতিকে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছাতে। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার বিকল্প নেই, আর সে গবেষণাকর্ম হতে হবে মৌলিক, সৃষ্টিশীল ও উন্নয়নমুখী। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আসা সব তরুণ-তরুণী এ দেশের সম্পদ। তাদের ভালো করে গড়তে পারলেই তারা দেশ গড়বে। না হলে এক দলকে যে সুযোগ-সুবিধা দেবেন আর এক দলকে বঞ্চিত করবেন, তা দিয়ে কখনো শিক্ষার মানে সুষম বণ্টন হতে পারে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এ বিশাল জনগোষ্ঠীর ভারে নুয়ে পড়ছে, তাকে সুচিকিৎসা দেয়াও জরুরি। এক্ষেত্রে অধিভুক্ত কলেজগুলোয় উচ্চশিক্ষার নিবিড় পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব বটে। যদিও উচ্চশিক্ষার ইউনিফায়েড সিলেবাস থাকে না, তবে মৌলিক শিক্ষার দিক থেকে আঠারো-উনিশ হতে পারে। কর্তৃপক্ষের মনোযোগ কেবল মাথাপিছু ব্যয়ের দিকে নয়, মূলত এই জনগোষ্ঠীকে মূলধারার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কীভাবে সংযুক্ত করা যায়, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনার প্রয়োজন। তাহলে দেশ এগিয়ে যাবে, মৌলিক জ্ঞান আহরণ থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় সুষম মান বজায় থাকবে।  

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মান ও শিক্ষার সংকট দূর করতে হলে আগে কলেজগুলোর শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষার অধিকার, সামাজিক অধিকার, সুস্থ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই গড়ে তুলতে হবে। বিশ্বমানের পাঠদানের সঙ্গে চলতে হলে পাণ্ডিত্য ও গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন জ্ঞানের সৃষ্টি করতে হবে, কার্যকর ও সময়োপযোগী শিক্ষণের মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞানের প্রয়োগ করতে হবে। চিন্তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়ে বৈষম্যহীন পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ দিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন