ডলার সংকটে লভ্যাংশ প্রত্যাবাসনে সমস্যায় পড়ছে বহুজাতিকরা

মেহেদী হাসান রাহাত

দেশের পুঁজিবাজারে বর্তমানে তালিকাভুক্ত বহুজাতিক কোম্পানির সংখ্যা ১৩। এর মধ্যে বেশকিছু কোম্পানি ডলার সংকটের কারণে লভ্যাংশ, রয়্যালটি ফিসহ তাদের সম্পর্কিত পক্ষের সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেনের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। খাতসংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে দেশে ব্যবসারত আরো অনেক বহুজাতিক কোম্পানিকেই।

জানা গেছে, তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানির ডলার সংকটের কারণে বিদেশে অর্থ পাঠাতে সমস্যায় পড়েছে তাদের মধ্যে রয়েছে বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড, ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ কোম্পানি (বিএটিবিসি) লিমিটেড, রেকিট বেনকিজার (বিডি) লিমিটেড ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেড।

বহুজাতিক জুতা উৎপাদক বাটা শু কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সমাপ্ত সময়ে নয় মাসের আর্থিক প্রতিবেদন ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে কোম্পানিটির সংরক্ষিত আয়ের ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য ২৬০ শতাংশ অন্তর্বর্তীকালীন লভ্যাংশ ঘোষণা করে। এরই মধ্যে কোম্পানিটি স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে জানিয়েছে, তারা ঘোষিত অন্তর্বর্তীকালীন নগদ লভ্যাংশ বিনিয়োগকারীদের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। কোম্পানিটির কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশী বিনিয়োগকারীরা গত বছরের ডিসেম্বরে লভ্যাংশের টাকা পেয়েছেন। তবে ডলার সংকটের কারণে তারা বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে লভ্যাংশ পাঠাতে পারছেন না। সংকট কমে এলে কিংবা যখনই তারা প্রয়োজনীয় ডলারের সংস্থান করতে পারবেন, তখন বিদেশীদের লভ্যাংশের অর্থ প্রত্যাবাসন করবেন।

হাইডেলবার্গ সিমেন্ট বাংলাদেশ লিমিটেড ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০২১ হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ২৬ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। গত বছরের আগস্টে কোম্পানিটি স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়, তারা বিনিয়োগকারীদের কাছে লভ্যাংশের অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রেও স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশের টাকা পেয়েছেন। ডলার সংকটের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে কোম্পানিটির পক্ষে লভ্যাংশ প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হয়নি।

দেশে ডলার সংকটের কারণে ২০২১-২২ হিসাব বছরের ঘোষিত ২০০ শতাংশ চূড়ান্ত নগদ লভ্যাংশ এবং ২০২২-২৩ হিসাব বছরের জন্য প্রথম দফায় ঘোষিত ৪৫০ শতাংশ দ্বিতীয় দফায় ঘোষিত ৩০০ শতাংশ অন্তর্বর্তীকালীন নগদ লভ্যাংশের টাকা চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহারের জন্য গত বছরের নভেম্বরে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) কাছে আবেদন করেছিল ভারতের মুম্বাইভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি ম্যারিকো বাংলাদেশ লিমিটেড। সে সময় কোম্পানিটি

জানায়, ডলার সংকটের কারণে তাদের

বিদেশী বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশের অর্থ নিতে পারছেন না। অবস্থায় ডলার সংকট দূর না হওয়া পর্যন্ত তারা লভ্যাংশের অর্থ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবহারের জন্য কমিশনের কাছে অনুমোদন চায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএসইসি তাদের ডলার সংকট না কাটা পর্যন্ত লভ্যাংশের অর্থ চলতি মূলধন হিসেবে ব্যবসায় কাজে লাগানোর অনুমোদন দেয়। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের কাছে পাঠাতে না পারলেও স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা এরই মধ্যে কোম্পানিটির ঘোষিত লভ্যাংশের টাকা হাতে পেয়েছেন।

তামাক খাতের বহুজাতিক জায়ান্ট বিএটিবিসি গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সময়ে সমাপ্ত তৃতীয় প্রান্তিকের নিরীক্ষিত আর্থিক বিবরণীর ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের জন্য ১০০ শতাংশ অন্তর্বর্তীকালীন নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। গত বছরের ডিসেম্বরে বিনিয়োগকারীদের কাছে ঘোষিত নগদ লভ্যাংশের অর্থ পাঠানোর বিষয়টি স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায় কোম্পানিটি।

বিএটিবিসির কোম্পানি সচিব মো. আজিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, সংকট আমাদের সবাইকে মিলে মোকাবেলা করতে হবে। বর্তমানে আমরা শুধু অত্যাবশ্যকীয় এমন পণ্যই আমদানি করছি। অন্যদিকে যেগুলো কয়েক মাস পরে পরিশোধ করলেও হবে, সেগুলো আপাতত পাঠাচ্ছি না। এক্ষেত্রে আমাদের বিদেশী শেয়ারহোল্ডাররাও বেশ সহযোগিতামূলক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। পাশাপাশি আমরা রফতানি বাড়ানোর মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আনার চেষ্টা করছি।

রেকিট বেনকিজার (বিডি) লিমিটেড ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০২১ হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য হাজার ৬৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। গত বছরের জুনে কোম্পানিটি লভ্যাংশের অর্থ বিনিয়োগকারীদের কাছে পাঠিয়েছে বলে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়। কোম্পানিটির কর্মকর্তারা বলছেন, ডলার সংকটের কারণে তারা বিদেশী মালিকদের কাছে রয়্যালটি ফি পাঠাতে পারছেন না। কাঁচামাল আমদানি নিরবচ্ছিন্ন রাখতেই তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ইউনিলিভার কনজিউমার কেয়ার লিমিটেড ৩১ ডিসেম্বর সমাপ্ত ২০২১ হিসাব বছরে বিনিয়োগকারীদের জন্য ৪৪০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করে। গত বছরের জুনে কোম্পানিটি বিনিয়োগকারীদের কাছে লভ্যাংশের অর্থ পাঠিয়েছে বলে স্টক এক্সচেঞ্জকে জানায়। ডলার সংকটের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারী স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে ইউনিলিভারকেও সমস্যায় পড়তে হয়েছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে ইউনিলিভার বাংলাদেশের হেড অব করপোরেট অ্যাফেয়ার্স, পার্টনারশিপ অ্যান্ড কমিউনিকেশন শামীমা আক্তার বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকের কাছ থেকে আমরা চাহিদা অনুসারে ডলার পাচ্ছি না। কারণে ব্যবসার জন্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির বিষয়টিকে মুহূর্তে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের তালিকায় রেখেছি। লভ্যাংশ, রয়্যালটি ফিসহ অন্য যেসব পেমেন্ট পরবর্তী সময়ে পাঠালেও চলবে সেগুলো আমরা পিছিয়ে দিয়েছি।

দেশের বহুজাতিক কোম্পানিগুলো লভ্যাংশ প্রত্যাবাসন, রয়্যালটি ফি প্রদান স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে লেনদেনের ক্ষেত্রে মূলত স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশ সিটিব্যাংক এনএর মাধ্যমে লেনদেন করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, সর্বশেষ সমাপ্ত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলারের বিনিয়োগ প্রত্যাহার (ডিজইনভেস্টমেন্ট) হয়েছে। এর মধ্যে মূলধন প্রত্যাবাসন, বিপরীতমুখী বিনিয়োগ এবং মূল কোম্পানি আন্তঃকোম্পানিকে দেয়া ঋণও রয়েছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে দেশ থেকে প্রত্যাহার করা বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩১ কোটি ৩৯ লাখ ডলার। এর পরের প্রান্তিক অর্থাৎ এপ্রিল-জুনে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১ কোটি ৬৮ লাখ ডলার।

দ্য ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) প্রেসিডেন্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাসের এজাজ বিজয় বণিক বার্তাকে বলেন, মূল সমস্যা কী সেদিকে নজর দিতে হবে। ডিভিডেন্ড, রয়্যালটি পরিশোধ করতে সমস্যা যে হচ্ছে, এতে আশ্চর্য হওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা জানি, বাজারে চলতি হিসাবের ঘাটতি ছিল, যার ফলে এমনটা হওয়ারই কথা। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক কোনো কাজ নেই, এটা ব্যাংকগুলোর কাজ। ডলারের প্রাপ্যতার ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। প্রথম বাণিজ্য বাধ্যবাধকতা, তারপর ঋণ, তৃতীয় সরকারের জ্বালানি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে কোনো অর্থ পরিশোধের বিষয় থাকলে সেটা, তারপর ডিভিডেন্ড, রয়্যালটি। ডিভিডেন্ড যদি রিপ্যাট্রিয়েট করতে না পারে তাহলে শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। পরিস্থিতিতে যৌক্তিকভাবে অগ্রাধিকারের বিষয়গুলো ঠিক করে নিতে হবে। এলসি পেমেন্ট না করে যদি ডিভিডেন্ড পেমেন্ট করতে যাই তাহলে তা বাস্তবসম্মত যৌক্তিক হবে না। প্রত্যেকটি ব্যাংকই যৌক্তিকভাবে কাজ করছে। এখন প্যানিক করার কিছু নেই। এরই মধ্যে পরিস্থিতি অনেক ভালো হয়ে এসেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্য পিক থেকে ৩০-৪০ শতাংশ কমে গেছে। ব্যাংকগুলো নিজেরা লাগাম টেনেছে। আমরা আশাবাদী যে গত বছর বিদেশে যাওয়া অতিরিক্ত ১১ লাখ কর্মীর কাছ থেকে দুই ঈদের রেমিট্যান্স এবং বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠানের অর্থ বিতরণের পর পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে।

২০২১ সালের জুনেই দেশে ডলার সংকটের শুরু। এর পরের বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে সংকটের মাত্রা আরো তীব্র হয়ে ওঠে। বিপিসি, পেট্রোবাংলা, বিপিডিবিসহ সরকারি বড় সংস্থাগুলোর আমদানি দায় পরিশোধের জন্য ব্যাংকগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ডলার কিনেছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত রিজার্ভের প্রায় বিলিয়ন ডলার বিক্রি করা হয়েছে। গত অর্থবছরেও রিজার্ভ থেকে বিক্রির পরিমাণ ছিল দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। এর মাধ্যমে সংকট কাটাতে ডলার বিক্রি করে বাজার থেকে লাখ কোটি টাকারও বেশি পরিমাণ অর্থ উঠিয়ে নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

ডলারের ব্যয়ে রাশ টানতে চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই আমদানি দায় কমানোর তোড়জোড় শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এজন্য আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার শর্তও কঠোর করা হয়েছিল। আবার ডলার সংকটের কারণে এলসি খোলা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছিল দেশের অনেক ব্যাংক। এতে আমদানির নতুন এলসি খোলা কমেছে। তবে ব্যাপক কড়াকড়ি সত্ত্বেও দেশের আমদানি নিষ্পত্তি কমানো সম্ভব হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ শেষে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশের আমদানি নিষ্পত্তি দশমিক ৭১ শতাংশ বেড়েছে। অর্থমূল্যে নিষ্পত্তি বাড়ার পরিমাণ প্রায় বিলিয়ন ডলার।

বাড়তি ডলার ব্যয়ের প্রভাবে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণেও টান পড়েছে। গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৩ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের জুন শেষে ছিল ৪১ দশমিক ৮৩ বিলিয়ন ডলারে। ছয় মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২০ শতাংশ। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বর সময়ের সঙ্গে তুলনা করলে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ কমেছে প্রায় ২৭ শতাংশ।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশে ডলার সংকট শুরু হওয়ার আগেই আমরা লভ্যাংশের অর্থ বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পাঠিয়ে দিয়েছি। ফলে এক্ষেত্রে সমস্যায় পড়তে হয়নি। তবে বাজারে ডলারের সংকট রয়েছে। কারণে আমরা ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে অত্যাবশ্যকীয় যেসব পণ্য আমদানি না করলেই নয় সেগুলো যাতে আনতে পারি সেদিকে গুরুত্ব দিচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন