আলোকপাত

বল্গাহীন ফাইন্যান্স পুঁজির কবলে বাংলাদেশ: একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

ড. এম এম আকাশ

রাজনৈতিক অর্থনীতিতে পুঁজি একটা সামাজিক সম্পর্ক। সেজন্য পুঁজির মালিকানার জন্য সমাজে সর্বদাই চলছে নানা বিবাদ, ঝগড়া, দখল-বেদখলের লড়াই। বামপন্থীরা একেই সাধারণভাবে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব বা শ্রেণী সংগ্রাম নাম দিয়েছেন। মার্ক্স দাবি করেছিলেন একটি সমাজের ইতিহাস হচ্ছে  শ্রেণী সংগ্রামের ইতিহাস। আধুনিক মার্ক্সবাদীরা শ্রেণী সংগ্রামের জটিল রূপকে বোঝার জন্য অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র ও ভাবাদর্শ সব ক্ষেত্রেই মনোনিবেশ করে থাকেন, কারণ সবগুলো রূপেই শ্রেণীদ্বন্দ্ব বিকশিত হয়ে থাকে।

মূলধারার অর্থনীতিতে পুঁজি বলতে বোঝায় উৎপাদিত উৎপাদনের উপায় বা সাধারণভাবে জীবনকে সহজসাধ্য ও আরামদায়ক করার জন্য মানুষের তৈরি করা হাতিয়ার; প্রযুক্তি, এমনকি এক অর্থে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে রোবটও এ সংজ্ঞা অনুসারে এক ধরনের পুঁজি। তার মানে পুঁজি হচ্ছে ‘উৎপাদিত উৎপাদনের উপায়’। একটি ‘বস্তু’। এজন্য ঠাট্টা করে কেউ কেউ বলেছিলেন, একটা বানর যদি একটা লাঠি দিয়ে একটা গাছ থেকে ফল পারে সেটা তাহলে বানরের জন্য উৎপাদিত উৎপাদনের উপায়। কারণ সে তো লাঠিটা কোনো গাছ থেকে ভেঙে তৈরি করছে। আর সে নিজে লাঠি ব্যবহার করে ফল পেরে ফল ভোগ করছে। তার মানে যে ফল সে পারছে সেটাই তার উৎপাদন। সে অর্থে বানরটা হয়ে যায় পুঁজিপতি আর লাঠিটা হয়ে যায় উৎপাদিত উৎপাদনের উপায় বা পুঁজি! কিন্তু কার্ল মার্ক্স পুঁজির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে দাবি করেন যে ‘পুঁজি’ নিছক উৎপাদিত উৎপাদনের উপায় নয়, উৎপাদিত উৎপাদনের উপায় ‘পুঁজি’-তে পরিণত হয় একটা বিশেষ সামাজিক পরিস্থিতির কারণে। সে কারণটা হলো কোনো সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন সম্পত্তিহীন হয়ে যায় এবং অল্প কিছু মানুষ সম্পত্তির মালিক হয়ে যায় এবং যখন তাদের মধ্যে একটা শ্রমশক্তি বিনিময় সম্পর্ক তৈরি হয়। এক শ্রেণীর কাছে উৎপাদনের উপকরণগুলো আছে কিন্তু তিনি পরিশ্রম করতে রাজি নন। আর যে শ্রেণী পরিশ্রম করতে রাজি আছে তার কাছে উৎপাদনের সব উপকরণ নেই। অবশ্য এখানে মার্ক্স ‘উৎপাদনের উপায়/উপকরণ’ বলতে দুটি ধরন বুঝিয়েছিলেন- প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক উপাদান এবং উৎপাদিত উৎপাদনের উপায়। প্রাকৃতিক উপাদানের উদাহরণ হতে পারে জমি। জমি কেউ উৎপাদন করে না। জমি ছাড়া অন্যান্য উপাদান- কল-কারখানার যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার প্রভৃতি উৎপাদিত উৎপাদনের উপাদান। মার্ক্স এ দুটিকে এক করে বলেছিলেন সম্পদ। কিন্তু এ সম্পদের প্রকৃতিটি এমন যে এটি চিবিয়ে খাওয়া যায় না। এ সম্পত্তি/সম্পদ শ্রমের স্পর্শে উৎপাদনশীল হয়। শ্রমের জাদুকরী স্পর্শে তাদের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত হয়। সুতরাং সম্পদ যদি অল্প কিছু লোকের হাতে কেন্দ্রীভূত হয় আর শ্রম বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। তাহলে এর মধ্যে বিনিময় ছাড়া উৎপাদন সম্ভব নয়। আর এ বিনিময়ের প্রয়োজনটা তখনই উদ্ভব হবে যখন সমাজ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যাবে। তাই পুঁজির উদ্ভবের পূর্বশর্ত বৈষম্যমূলক সমাজ (পুঁজিপতি ও সর্বহারা শ্রেণী), শ্রমশক্তির ও পণ্যের কেনা-বেচা এবং অর্থ বা মুদ্রা যা বিনিময়ের সাধারণ মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।

সে কারণে পুঁজির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে একটা অসম সম্পর্ক তৈরি হয়। অসম সম্পর্ক এ অর্থে যে যার পুঁজি আছে তার শ্রমও আছে। মানুষ হিসেবে প্রত্যেক সুস্থ মানুষের শ্রম থাকাটা স্বাভাবিক। সুতরাং সে একই সঙ্গে পুঁজি ও শ্রমের মালিক। কিন্তু যে শুধু শ্রমের মালিক তার একটা নির্ভরশীলতা থাকবে পুঁজির জন্য, কিন্তু পুঁজিপতি ব্যক্তির নির্ভরশীলতা কম থাকবে বিশেষ করে তার পুঁজি যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোবট নির্ভর হয়। অথবা তার পারিবারিক শ্রম দিয়েই সে যদি কাজ চালিয়ে নিতে পারে। তাহলে বাইরের শ্রমের ওপর তার নির্ভরশীলতা থাকছে না। তাই অনেক আধুনিক তাত্ত্বিক মনে করেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পর আপনাআপনি শ্রমিক-মালিক বৈষম্য বা শ্রেণী সংগ্রাম বর্তমান আধুনিক সমাজ থেকে দূর হয়ে যাবে। তাই তারা সমাজ বিকাশের জন্য শ্রেণী সংগ্রাম বাদ দিয়ে শুধু প্রযুক্তির বিকাশ ও জ্ঞানের বিকাশের জন্য লড়াইয়ের কথা বলেন। কিন্তু তারা এটা ভুলে যান যে পুঁজিবাদী সমাজে যে প্রযুক্তি ও জ্ঞানের বণ্টনবৈষম্য আছে তার নিরসন না ঘটিয়ে এক্ষেত্রে কোনো টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক বিকাশ সম্ভব নয়। বর্তমান বিশ্বে এটা সর্বজনস্বীকৃত সত্য। 

পুঁজির স্বভাবধর্ম হচ্ছে গুটিকয়েক পুঁজিপতির হাতে সম্পদ পুঞ্জীভবন করা, লাভের উদ্দেশ্যে শ্রমিক শ্রেণীকে কাজে নিয়োগ করা, অর্জিত লাভের পুনর্বিনিয়োগ করা। তাই স্বাভাবিকভাবে পুঁজির প্রবৃদ্ধি হলে এর মাধ্যমে শ্রমিকের জন্য নতুন কাজের সৃষ্টি হয় এবং প্রযুক্তিরও বিকাশ হয়। তবে মার্ক্স দেখিয়েছেন, মুনাফা বা অতি লোভের কারণে সস্তা শ্রম, সস্তা কাঁচামাল, নতুন নতুন বিদেশী বাজারের আকর্ষণে পুঁজির কর্মকাণ্ডে এ ধরনের স্বাভাবিক বিকাশ নাও হতে পারে।

পুঁজিবাদের প্রথম যুগে পুঁজির এ কেন্দ্রীভূতকরণ হতো লুটপাটের মাধ্যমে কিন্তু পরবর্তী সভ্য যুগে শিল্পায়নভিত্তিক পুঁজিবাদ যখন প্রকাশ পেতে লাগল তখন পুঁজিবাদীরা পুঁজিটা জোগাড় করত পুঁজির থেকে মুনাফার এক অংশ বিনিয়োগ করে। কিন্তু এভাবেও পুঁজি তার acquisitive প্রবণতা বা মুনাফার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি। তবে লুটপাট করে যে প্রাথমিক পুঁজি সৃষ্টি হয়েছিল সেই রক্তাক্ত ইতিহাস বর্তমানে ভুলে গেছে সবাই। সেটা তাই আমরা এখন জানিও না চিনিও না। আর সেই বদনাম পুঁজির আর নেই। এটা পুঁজির প্রাক-ইতিহাস। পুঁজির প্রাক-ইতিহাস পার হয়ে গেছে এখন পুঁজির নতুন ইতিহাসের মধ্যে আমরা আছি।

বর্তমানে পুঁজির পক্ষ দাবি করছেন যে, যদি শ্রমপক্ষকে তারা নিয়োগ না দিত তাহলে শ্রমপক্ষ না খেয়ে মারা যেত। আর অন্যদিকে শ্রমপক্ষের দাবি হচ্ছে পুঁজিপক্ষ যদি শ্রমপক্ষকে না পেত তাহলে পুঁজি স্থবির রূপে থাকত এবং শেষ হয়ে যেত। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় বেশ একটা দ্বন্দ্বহীন সমতাভিত্তিক বিনিময়। কিন্তু মার্ক্স বললেন এতে সমতা নেই। কারণ শ্রমপক্ষ বা শ্রেণী দুর্বল, তাদের ওপর চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মজুরিকে ন্যূনতম বেঁচে থাকার পর্যায়ে (Subsistence level) নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং তার ফলে অতি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। মার্ক্সের ভবিষ্যদ্বাণী ছিল পুঁজি ক্রমে কেন্দ্রীভূত হবে এবং শ্রমবাজারে তার একচেটিয়া বা একাধিপত্য তৈরি হবে। যখন একচেটিয়া বা একাধিপত্য তৈরি হবে তখন মজুরি কমার এবং মুনাফার হার বৃদ্ধির কোনো সীমা থাকবে না। মুনাফার হার তখন নির্ধারিত হবে পুঁজিবাদীদের দিয়ে শ্রম শোষণের হার দিয়ে। মূলত এ হলো মার্ক্সের শোষণতত্ত্ব। 

বর্তমানে এ সচল বিশাল একচেটিয়া পুঁজি দুনিয়াব্যাপী তরল অর্থের রূপ ধারণ করে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাকেই আমরা নাম দিয়েছি Finance Capital বা আর্থিক পুঁজি। সাধারণত এ ফাইন্যান্স পুঁজির ক্ষুধাটা তার নিজস্ব উদ্বৃত্ত বিনিয়োগযোগ্য তহবিলের চেয়ে বেশি হয়ে যায়। ফলে সে আবার নতুন পুঁজির উৎসের সন্ধান করতে থাকে। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গে পুঁজির প্রয়োজনটাও বাড়ে। কারণ যত বড় আকারে উৎপাদন হবে তত বেশি প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালের প্রয়োজন বাড়বে, যন্ত্রপাতি দামি হবে। দক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজনও বৃদ্ধি পাবে। পুঁজিকে তাই শিক্ষিত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীকেও কাছে টানতে হবে। তাদের হাতে রাখার জন্য অনেক সময় তাদের পুঁজির শেয়ার দেয়া হয় এবং সেখান থেকে তার প্রফিটের ডিভিডেন্ড তারা পায়। আবার তাদের সঞ্চয়কে শুষে নেয়ার জন্য তারা কোম্পানি তৈরি করে তাদের কাছ থেকেই পুঁজি সংগ্রহ করে এবং সাধারণভাবে সবাইকেই বলে, তোমরা কোম্পানিতে পুঁজি বিনিয়োগ করো, যেমন বিলাতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো বৃহৎ মার্চেন্ট কোম্পানিগুলো একসময় পুঁজি এক জায়গায় করে ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট ক্যাপিটালিস্টকে পুঁজি ধার দিত। পরে একটা সময় এসে মার্চেন্ট ক্যাপিটাল ভাবে যে আরো লাভ কীভাবে হবে। তখন তারা একটা ব্যাংক তৈরি করে। মার্চেন্টরাই প্রথম ব্যাংক তৈরি করেছিল। যেমন জগৎশেঠ মসলিন কিনে বাইরে ব্যবসা করত এবং তা থেকে মুনাফা হতো। সে তার পুঁজি ওই মসলিন নির্মাতাদের ধার দিত। এভাবে প্রথম মার্চেন্ট ব্যাংক তৈরি হয় এবং তার থেকে ব্যাংকের ধারণা আসে। তার মানে ব্যাংক আর কিছুই করছে না কেবল নানা ধরনের ক্ষুদ্র-মাঝারি-বৃহৎ পুঁজিপতির ক্ষুধা মেটাচ্ছে। 

বাণিজ্য ও শিল্পের পুঁজিকে সেবা দেয়ার জন্য ফাইন্যান্স ক্যাপিটালের উদ্ভব হয়েছে। অর্থনীতিতে বাণিজ্য ও শিল্প উৎপাদন দ্রুত বিকশিত হতে থাকলে পাশাপাশি ফাইন্যান্স পুঁজি/ ক্যাপিটাল বাড়তে থাকে। যেসব শিল্পপতি রাঘব বোয়াল হয়ে যান তারা ভাবেন যে ফাইন্যান্স ক্যাপিটালকে আমরা সুদ দেব কেন আমরাই ব্যাংকের মালিক হয়ে যাই। তখন তারাও ব্যাংকগুলোর মালিক হতে শুরু করে। লেনিন প্রথম এ বিষয়টি লক্ষ করেন এবং ফ্যাইন্যান্স ক্যাপিটাল ও শিল্পের ক্যাপিটালের এ সমন্বয়ের নাম দেন ফার্স্ট স্টেজ অব ইম্পেরিয়ালিজম। এক সময়ে তারা এত ক্যাপিট্যালের মালিক হয়ে যাবেন যে সেটা তার নিজের দেশের মধ্যে বিনিয়োগ করেও যথেষ্ট মুনাফা হবে না। এমনকি তার নিজের জন্য বিনিয়োগ করেও উদ্বৃত্ত পুঁজি তার হাতে থেকে যাবে।

তখন সেটা বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগের ব্যাপারে অগ্রসর হয়। আর তখনই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কারণ তখন অন্য দেশের পুঁজিপতিরা সেটা আটকানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। সুতরাং ফ্যাইন্যান্স ক্যাপিটাল হচ্ছে শেষ (স্টেজ) ধাপ, যেখানে মেট্রোপলিটন দেশ বাণিজ্যিক পুঁজির ধাপ পার করে, শিল্প পুঁজির ধাপ পার করে একটা ফাইন্যান্সিয়াল বিপ্লব করতে যাচ্ছে। সেই সময়ের একটা প্রগতিশীল দিক হলো যখন সে ফাইন্যান্সিয়াল বিপ্লব করতে চায় তখন সে অন্যদের অর্থ দেয়। সে ব্যাংকে পুঁজি না রেখে অন্য জায়গায় ঋণ দেয় আর সে ঋণ যদি উৎপাদনশীল পুঁজির কাছে যায় তাহলে সেটি নতুন কিছু শিল্প তৈরি করবে। ১৯১৩ সালের পর ভারতবর্ষে ইংলিশ ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল প্রবেশের কারণে কিছু আধুনিক ইন্ডাস্ট্রি ভারতে গড়ে উঠেছিল। ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল কিছুটা ভালো হয় যখন সে উৎপাদনশীল পুঁজিতে পরিণত হয়। আর ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটাল খারাপ হয় যখন সে হুটহাট এখানে-ওখানে ছুটতে থাকে। এটা তখনই হয় যখন যে দেশকে অর্থ দেয়া হয়েছে তারা যদি ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টের কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ না রাখে। ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটালের সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ হলো শেয়ার মার্কেটে টাকা দেয়া ও টাকা নেয়া এবং ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্টকে ওপেন করে দিয়ে অর্থকে যেকোনো সময় এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ট্রান্সফার করতে দেয়া। মূলত ওখান থেকেই ২০০৮ সালে এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকট শুরু হয়েছিল। এশিয়ান ক্রাইসিসের মূল কারণ ছিল ক্যাপিটাল মার্কেট উন্মুক্ত করা। হঠাৎ করে ক্যাপিটাল নিয়ে যাওয়ায় স্থানীয় মুদ্রার মান একদম কমে গিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ক্যাপিটাল অ্যাকাউন্ট যদি অস্থির হয়ে যায় এবং তাতে যদি ফ্যাইন্যান্স ক্যাপিটাল টাকা দিতে থাকে ও নিতে থাকে তাহলে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে। 

আমরা জানি, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর মালিক বা পুঁজিপতিদের এক পা বাংলাদেশে ও অন্য পা বিদেশে। সেজন্য তারা যখন বিদেশে সম্পদ কেনেন তখন এখান থেকে অন্যখানে অর্থ চলে যাচ্ছে। তারা নিজস্ব নিরাপত্তার জন্য সিঙ্গাপুরে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করছেন। বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি ও এনজিও যদি বিদেশে বিনিয়োগ করে, তাহলেও সম্পদ বাইরে চলে যাবে। ব্যাংক এখন তাই একটা আইনি পন্থায় ক্যাপিটাল ট্রান্সফারের হাতিয়ার হয়ে গেছে। এছাড়া অবৈধ পন্থা তো আছেই। অনেকে দেশে বিনিয়োগ করবে বলে অর্থ নিয়ে বাইরে ট্রান্সফার করে দিচ্ছে। দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থও বাইরে চলে যাচ্ছে। এখন এটাই বাংলাদেশে হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রচুর টাকা-পয়সা ধার দেয়া হচ্ছে ঋণখেলাপিদের। তাদের কিন্তু ঋণখেলাপির রেকর্ড আগে থেকে ছিল। তারা আগেও ঋণ নিয়ে ঋণ খেলাপি হয়েছে। তার পরও তাদের এ ঋণকে রিশিডিউল করা হচ্ছে, সুদ মাফ করা হচ্ছে এবং আবারো তাদের ঋণ দেয়া হচ্ছে। 

ঋণের বিপরীতে যে সিকিউরিটি থাকে সেটি এতটাই দুর্বল যে ব্যাংক সেটি বিক্রি করে কিছুই পাচ্ছে না। অনেক সময় কোনো সিকিউরিটি ছাড়াই ব্যাংক বিপুল ঋণ দিচ্ছে। কারণ ব্যাংকের মালিকরাই তো ঋণ নিচ্ছে নিজ ব্যাংক না হোক অন্য ব্যাংক থেকে। আবার অন্য ব্যাংকের মালিকও ফিরতি ঋণ নিয়ে উভয়ই তা বিদেশে পাঠিয়ে দিচ্ছেন!

উন্নত পুঁজিবাদী দেশে প্রত্যেকের ক্রেডিট কার্ডে তার পূর্ববর্তী ক্রেডিটের সম্পূর্ণ ইতিহাস থাকে। সেখানে ঋণ দেয়ার সময়েই ফাইন্যান্স ক্যাপিটাল চিন্তা করে যে আমি এখান থেকে অর্থ উঠাতে পারব কিনা? উন্নত দেশেও স্পেকুলেটিভ হাউজিং ক্রেডিট দিয়ে কী সংকট হয়েছিল, তা আমরা সবাই জানি। তখন ওসব ব্যাংককে বাঁচানোর জন্য সরকার জনগণের অর্থ বেইলআউট করেছে। অর্থ ছাপিয়ে তাদের দেয়া হয়েছে। পুঁজিপতিরা জানে, তারা সংকটে পড়লে সরকার তাদের রক্ষা করবে। কিন্তু শ্রমিককে সরকার রক্ষা করবে না। পুঁজিপতিদের সরকারের দেয়া অর্থটা কিন্তু শেষ বিচারে সাধারণ জনগণেরই ট্যাক্সের টাকা। 

বাংলাদেশে বল্গাহীন ফাইন্যান্স ক্যাপিটালকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এ লুণ্ঠন অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে যত নিয়মকানুন আছে সব পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করে ফাঁক রেখেই করা হয়েছে। আর কখনো কেউ ধরা পড়লে তখন রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক সহায়তায় সে শাস্তি এড়িয়ে যায়। ব্যাংক গরিবকে বলে তুমি সঞ্চয় করো, নইলে ভবিষ্যতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আর ধনীকে বলা হচ্ছে তুমি যত পারো ঋণ করো। ব্যাংক সব পুঁজি এক করে ধনীদের হাতেই তুলে দিচ্ছে। ব্যাংক যেহেতু পাবলিক মানি নিয়ে কাজ করছে সেহেতু তার ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য বাংলাদেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বোর্ড রয়েছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এসব জায়গাতেও ফাইন্যান্স পুঁজি ও ক্ষমতাবান ব্যক্তির স্বার্থটাই প্রাধান্য পায়। তবে ব্যাংকের টাকা কোনো একক ব্যক্তির টাকা নয় বরং এটা জনগণের টাকা। ব্যাংকের তারল্য সমস্যা বা সংকট হলে ব্যাংকের মালিক জনগণের অর্থ শোধ করবে কি? প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে যে তারল্য সংকট কেন হবে? এ তারল্য সংকটের কারণ অর্থ/টাকাগুলো অপব্যবহার করা হয়েছে বা বাইরে পাচার হয়ে গেছে। এটা করেছে ব্যাংকের মালিকরা, কর্মচারীরা এবং খেলাপি ঋণগ্রহীতারা। এটা যদি ইচ্ছাকৃত হয় তাহলে এটা হচ্ছে প্রকৃতপক্ষে লুণ্ঠন। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা অর্থ আদালত যখন শাস্তি না দিয়ে পুনরায় অর্থ দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখছে তখন শেষ বিচারে জনগণের অর্থ দিয়েই তা করা হচ্ছে। দায় তাই সরকারেরও বটে।


ড. এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন