অভিমত

প্রবাসী বাড়ে, রেমিট্যান্স বাড়ে ভালো থাকে কে?

পাপলু রহমান

মানবজীবনের বড় এক উপলব্ধির নাম টাকা। টাকার ওপর টিকে থাকে সম্পর্ক, সমাজ ও দেশ। মানুষের সব ফন্দি-ফিকিরের মূলে রয়েছে এটি। সভ্যতার শুরু থেকে টাকা মানুষকে ভাবিয়েছে। যেকোনো উপায়ে টাকা কামানোই মানুষের মুখ্য হয়ে উঠেছে। টাকার জন্যই কেউ পৈতৃক ভিটেহারা, কেউবা নিজের স্ত্রী-সন্তানকে বিক্রি করে দেন। টাকা মানুষকে ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া করেছে। ব্যবহারভেদে টাকার বাহারি অনেক নাম আছে। যেমন- শ্রমিককে দিলে মজুরি, সরকারকে দিলে কর, আবার প্রবাসীরা দেশে পাঠালে রেমিট্যান্স। 

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশ থেকে ২০২২ সালে সর্বোচ্চ কর্মী বিদেশে গেছেন। কভিড সময়কাল বিবেচনায় এ প্রবাসীর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য।

দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো খবর রেমিট্যান্স প্রবাহের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা। গত ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স বেড়ে ১ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছিল, যা ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১ দশমিক ৬৩ বিলিয়ন ডলার। তবে গত বছর আর্থিক রেমিট্যান্স প্রবাহ ২০২১ সালের তুলনায় কিছুটা কমেছে। এর পেছনে যেসব কারণ ছিল, সেসব বিবেচনা করলে তা কোনোভাবেই মন্দ বলা যাবে না। যুদ্ধচালিত অর্থনীতি, বিশ্ব ভোক্তা বাজারে ধীরগতি, অভ্যন্তরীণ ডলার সংকট, ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক ও অন্যান্য ওপেন সোর্সের বিনিময় হারে পার্থক্য ও হুন্ডির মতো অবৈধ উৎসের মাধ্যমে টাকা পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অথচ ২০২১-২২ অর্থবছরে এসেছে মাত্র ২১ দশমিক ০৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমার হার এক্ষেত্রে দৃশ্যমান। 

বাংলাদেশী কর্মীদের সবচেয়ে বড় গন্তব্য সৌদি আরব। এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোয় প্রবাসী কর্মীদের সংখ্যা বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, রেমিট্যান্সের সিংহভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশটিতে শ্রমবাজার বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, উপসাগরীয় দেশগুলোয় ভারত, মেক্সিকো, রাশিয়া ও চীন প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক অভিবাসী শ্রমিক পাঠাচ্ছে। যার ফলে দক্ষতা ও যোগ্যতার মানদণ্ডে প্রতিযোগিতা করে টিকতে হচ্ছে বাংলাদেশী কর্মীদের। 

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ ৬ জানুয়ারি সাংবাদিকদের জানান, সরকার চলতি বছর নতুন করে আরো প্রায় ১৫ লাখ কর্মী বিদেশ পাঠানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়ায় নিয়মিত লোক যাচ্ছে। রোমানিয়া, ইতালি ও গ্রিসে কর্মী যাওয়া শুরু হয়েছে। লিবিয়ায়ও কর্মী পাঠানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। আগামী দু-এক বছরের মধ্যে চীনসহ আরো কিছু দেশে শ্রমিক সংকট দেখা দেবে। সে সময় সুযোগ কাজে লাগাতে সরকার প্রস্তুত রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের রেমিট্যান্স প্রবাহ ভালো হবে। উন্নত দেশগুলোয় বিপুলসংখ্যক ব্লু-কলার (মজুরিভিত্তিক শ্রমিক) চাকরি সৃষ্টি হবে। আর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলো ব্যাপক উপকৃত হতে পারে। এছাড়া কভিডের পর অস্থায়ী অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। আশা করা হচ্ছে, দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে সরকার ঘোষিত ২ দশমিক ৫ শতাংশ লভ্যাংশ অভিবাসী শ্রমিকদের আরো বেশি টাকা পাঠাতে উৎসাহিত করবে।

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (আরএমএমআরইউ) তথ্য মতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী শ্রমিকদের ৭৪ শতাংশ কম দক্ষ থেকে অদক্ষ ছিল। এটি দেশের বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমাদের দেশের অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার প্রাণশক্তি হলো রেমিট্যান্স। প্রবাসীদের ঘাম ঝরানো এ অর্থে দেশের বৃহৎ অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ চলে। বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধিতে রেমিট্যান্সের প্রভাব ব্যাপক। কিন্তু এই রিজার্ভ যারা সরবরাহ করেন, তাদের বেশির ভাগই বিদেশে গিয়ে গৃহকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, রেস্টুরেন্টকর্মী, নিরাপত্তাপ্রহরী, মালি, ড্রাইভার ও নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে কারো কারো এমন অবস্থা, কাজ করলে টাকা পান, কাজ না করলে নেই। অর্থাৎ তারা বেতনভুক্ত নন। তবে যারা মেকানিক্যাল ও ইলেকট্রিক্যালের কাজ করেন, তাদের মূল্যায়ন একটু আলাদা, তারা বেশি বেতন পান। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) তথ্য অনুযায়ী, একজন বাংলাদেশী প্রবাসীর গড় আয় ২০৩ দশমিক ৩৩ ডলার, যা একজন ফিলিপিনো শ্রমিকের আয়ের (৫৬৪ ডলার) তুলনায় অর্ধেক। আমাদের তুলনায় ভারতীয় ও পাকিস্তানি শ্রমিকেরও আয় ভালো। তাদের আয় যথাক্রমে ৩৯৫ দশমিক ৭১ ও ২৭৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। বিশ্বব্যাপী রেমিট্যান্স প্রবাহের দিক থেকে শীর্ষস্থান ভারতের দখলে। 

অন্য দেশের বিচারে প্রবাসীরা যত কম আয় করুন না কেন, দেশের অর্থনীতি পুষ্ট করতে তাদের অবদান ও ত্যাগ অসামান্য। 

বাংলাদেশ থেকে যারা প্রবাসজীবন বেছে নেন, বেশির ভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের যাওয়ার পথটা সহজ নয়। চড়া সুদে ঋণ নিয়ে যেতে হয়। আবার পরভূমিতে গিয়ে দেখেন, যে কাজের জন্য তাদের নিয়ে আসা হয়েছে, সে কাজ দেয়া হয়নি। যে বেতনের কথা বলা হয়েছে, সেটা মেলেনি। প্রাপ্য অন্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। দুচোখ ভরা স্বপ্ন নিয়ে তাদের দুঃখের সাগরে ভাসতে হয়। তাদের মধ্যে এমনও আছেন, কেউ গোয়ালের গরু বিক্রি করে, কেউ জমি বন্ধক রেখে, কেউ স্ত্রীর গহনা বিক্রি করে যান। এ রকম মানসিক চাপে তারা সেখানেও ভালো থাকতে পারেন না। চিন্তা-অনিদ্রা, হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও ঋণ পরিশোধে তাদের তিন-চার বছর চলে যায়। কেউ কেউ আছেন, এ কষ্ট সহ্য করতে না পেরে জীবনটাই হারিয়ে ফেলেন। অনেকে স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নেন, কেউ কেউ হৃদরোগে মারা যান। অনেক প্রবাসীর ক্ষেত্রে দেখা যায়, দায়িত্বের বোঝা টানতে টানতে যৌবনের ২০/২৫ বছর হারিয়ে ফেলেন। 

প্রবাসীদের সম্মানে সরকার প্রতি বছর ৩০ ডিসেম্বর প্রবাসী দিবস পালন শুরু করেছে। অথচ প্রবাসীদের প্রাণই বাঁচে না। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি-নভেম্বর পর্যন্ত বিদেশ থেকে ৩ হাজার ২২২ জনের মরদেহ এসেছে। তাদের অনেকে অপমৃত্যুর শিকার। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মৃত কর্মীর পরিবার না পান ন্যায়বিচার, না ক্ষতিপূরণ, পেলেও যৎসামান্য। অভিযোগ রয়েছে, বিদেশে বাংলাদেশী দূতাবাস ও রিক্রুটিং এজেন্সি থেকে প্রবাসীরা কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পান না।

অনেক প্রবাসী বিভিন্ন কারণে দেশে চলে আসেন। দেশে এসে তাদের ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় থাকে না। পরিবারের কাছে ছোট হয়ে থাকতে হয়, পাওনাদারের ভয়ে মুখ লুকিয়ে চলতে হয়। আবার প্রবাসজীবন খেটে কেউ দেশে এলে ব্যবসা শুরু করতেও তাকে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। ধার-দেনা করে চলতে হয়। সরকারের উচিত, এসব প্রবাসী ভাইদের সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, পেনশন/বিশেষ ভাতার ব্যবস্থা করা। তাদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়া। মনে রাখতে হবে, রেমিট্যান্স যোদ্ধারা আমাদের মহামূল্যবান বন্ধু। দেশের উন্নয়নে, দেশের স্বার্থে তাদের ভালো থাকার দিকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। 

একই সঙ্গে বেকার যুবকদের প্রতি আহ্বান থাকবে তারা যেন বিদেশ যাওয়ার মোহে অসাধু দালালের খপ্পরে না পড়েন। কাঙ্ক্ষিত দেশে যাওয়ার আগে সে দেশের ভাষা, সংস্কৃতি জেনে ও সংশ্লিষ্ট কাজে দক্ষ হয়ে যেতে হবে। এতে ইনকামও ভালো আসবে। অনেকে অবৈধভাবে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ভাসতে থাকেন, কেউ কেউ লাশ হন, নিখোঁজ হন। আবার তীরে পৌঁছলেও অভিবাসন পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে তারা মাদক বহন, মানব পাচার ও পতিতাবৃত্তির মতো অপকর্মে জড়িয়ে পড়েন। আবার অনেকে নির্দিষ্ট কাজে চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিদেশে গেলেও সেখানে পৌঁছে ওই কাজ ছেড়ে দিয়ে আরেক দেশে অন্য কাজে চলে যান। এতে নিজ দেশের বদনাম হয়। সরকারকে দালালনির্ভর অভিবাসন প্রক্রিয়া পুরোপুরি রোধ করে যোগ্য ও সৎ শ্রমিক বেছে নিতে হবে। তাহলে দেশ আরো এগিয়ে যাবে।


পাপলু রহমান: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন