অর্থ পাচারকে বড় চ্যালেঞ্জ বলছেন ৪৪ শতাংশ ব্যবসায়ী

ব্যবসায় পরিবেশ উন্নয়নে অর্থ পাচার প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হোক

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য সক্ষমতা যেকোনো দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার মূল মানদণ্ড হিসেবে গণ্য হয়। কিন্তু বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বেশ পিছিয়ে। এরই মধ্যে খবর মিলছে, গত এক বছরে দেশের ব্যবসায় পরিবেশের আরো অবনমন ঘটেছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) পরিচালিত এক জরিপে ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দুর্নীতিকে চিহ্নিত করেছে। দুর্বল অবকাঠামো, ব্যাংক থেকে অর্থায়নের সমস্যা ও অর্থ পাচারও ব্যবসার পরিবেশকে জটিলতর করে তুলছে বলে জানিয়েছেন। পুঁজি পাচার প্রতিরোধকে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। দেশে ব্যবসায় পরিবেশ উন্নত করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার জরুরি। তবে সেটি করতে হবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এবং পরিকল্পিত উপায়ে। 

অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি হয় বাণিজ্যের আড়ালে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান জানিয়েছেন, আমদানি পণ্যের দাম ২০০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেখানোর ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংকিং ও কাস্টমস পরিভাষায় এ বাড়িয়ে দেখানোর নাম ‘ওভার ইনভয়েসিং’। বাংলাদেশের অর্থ পাচারের বেশির ভাগ সংঘটিত হয় আমদানি ও রফতানি বাণিজ্যে ‘মিস ইনভয়েসিং’ বা চালান জালিয়াতির মাধ্যমে, যার ফলে একদিকে যেমন ব্যাপক কর ফাঁকি সংঘটিত হচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, কীভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে পাচার হয়? সহজ কথায় তার জবাব হলো ওভার ইনভয়েসিং। অর্থাৎ কর ফাঁকি দিতে, কোম্পানির মুনাফা লুকাতে এবং অন্যান্য কারণে পণ্য আমদানি ও রফতানিতে অনেক সময় পণ্যের প্রকৃত মূল্য দেখানো হয় না। অর্থাৎ কেউ ১০০ টাকার পণ্য আমদানি করবে, দেখানো হলো পণ্যের দাম ১৫০ টাকা। ফলে ৫০ টাকা পাচার হয়ে গেল। রফতানির ক্ষেত্রে করা হয় উল্টোটা। ১০০ টাকার পণ্য রফতানি করে কিন্তু দেখানো হলো ৫০ টাকা। বাকি ৫০ টাকা বিদেশে রয়ে গেল। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে পণ্য সরবরাহকারী কিংবা ব্যাংক বা শুল্ক কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ থাকে। 

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিনিয়োগের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকা ও পুঁজির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারায় প্রতি বছর দেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ বাড়ছে। একটি গোষ্ঠী বন্ডেড ওয়্যারহাউজের অপব্যবহার করে আমদানি-রফতানির আড়ালে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করে দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় খুব সহজেই বিপুল পরিমাণ অর্থের মালিক বনে যাচ্ছেন। এছাড়া নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অবৈধ পন্থায় প্রভাবশালীরা খুব সহজেই অবৈধ পথে আয় করছেন, যা পরবর্তী সময়ে কালো টাকা বলে পরিগণিত হয়। এ টাকা করবহির্ভূত হওয়ায় বৈধভাবে বিনিয়োগও করতে পারেন না। ফলে তা বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার করে দেয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় অর্থ পাচার ঠেকাতে হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আমদানি-রফতানিসহ সামগ্রিক আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। তবে সবার আগে আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকটকালে রফতানিকারকদের বিদেশে রফতানি আয় রেখে দেয়ার পরিমাণ সীমিত করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আয় দেশে আনা বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যৌথভাবে কমিটি গঠন করে দ্রব্যের আমদানি ও রফতানি মূল্য যাচাই করে ওভার ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। হুন্ডি ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধে দুদক ও সিআইডিকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

সরকার দেশে অর্থ পাচার নিরোধ বা বন্ধের জন্য মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন প্রণয়ন করেছে। এ আইন অনুযায়ী, বৈধ অনুমোদন ছাড়া দেশের বাইরে অর্থ-সম্পত্তি প্রেরণ বা পাচার কিংবা দেশের বাইরে উপার্জিত সম্পত্তি, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ রয়েছে, তা ফেরত না আনা কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে অর্জিত অর্থ বা প্রকৃত পাওনা দেশে না আনা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশে থেমে নেই অর্থ পাচার। দেশের সার্বিক অর্থনীতির স্বার্থে এ ধরনের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে অপরাধীদের দ্রুত চিহ্নিত করে দৃশ্যমান কঠোর শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দেশে ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে বিডা এরই মধ্যে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ প্রদানের কার্যক্রম চালু করছে পাশাপাশি কোম্পানি আইন ও ভ্যাট আইনসহ অন্যান্য আইনে বেশকিছু সংস্কার করা হয়েছে। এর সুফল ব্যবসায়ীদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। 

দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ রাখার ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা এবং বিনিয়োগের যথাযথ পরিবেশ না থাকায় দেশের বাইরে, বাংলাদেশ থেকে রাখা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। কোনো দেশই চায় না, তার দেশের উপার্জিত অর্থ অন্য দেশে ব্যবহৃত হোক। তারা বলেন, মুদ্রা পাচার কখনই বন্ধ হবে না যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিটি দেশ এ ব্যাপারে সতর্ক এবং সচেতন না হয়। কারণ এটা দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম। যে দেশ থেকে অর্থ পাচার হয় তারা কখনই তা বন্ধ করতে পারবে না, যদি মুদ্রা পাচারের গন্তব্য দেশটিও সতর্ক না হয়। কোনো দেশ যদি পাচারকৃত মুদ্রাকে তাদের দেশে অভ্যর্থনা জানায়, তাহলে কখনই মুদ্রা পাচার বন্ধ হবে না। কিন্তু উদ্দিষ্ট দেশটি যদি পাচারকৃত মুদ্রা তাদের দেশে অভ্যর্থনা না জানায়, তাহলে এ কার্যক্রম এমনিতেই বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশই তাদের দেশে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে পাচারকৃত অর্থকে স্বাগত জানায়। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশ থেকে প্রতি বছর নানাভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হচ্ছে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ ১৪ দশমিক ১৩ বিলিয়ন ডলার (১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা) ছাড়িয়ে যেতে পারে।’ তথ্যটি খুবই উদ্বেগজনক। তাই বিদেশে অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণ জরুরি। পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনার ক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।

২০২৬ সালে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পর থেকে পণ্য রফতানিতে অগ্রাধিকারমূলক সহায়তা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হবে রফতানিকারকরা, যা আমাদেরকে রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে এবং এ অবস্থা উত্তরণে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় কমাতে অবশ্যই ব্যবসা পরিচালন ব্যয় হ্রাসের প্রতি আরো মনোনিবেশ করতে হবে। ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো প্রতিযোগী দেশগুলো অধিক হারে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে। কারণ দেশগুলোর ব্যবসায় পরিবেশ বাংলাদেশের চেয়ে ভালো। এমন বাস্তবতায় দেশের ব্যবসায় পরিবেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জনের কোনো বিকল্প নেই। ব্যবসায় প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য নির্ধারণ করে নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় সংস্কার; স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও দক্ষতার মাধ্যমে বেসরকারি বিনিয়োগ নিশ্চিত; নাগরিক ও ব্যবসায়িক সেবা প্রদান; ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তা বিধান; আর্থিক খাতে সংস্কার আনতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন