সা ক্ষা ৎ কা র

হৃদরোগের সঙ্গে আমরা প্যানিক অ্যাটাককে গুলিয়ে ফেলছি

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব চাইল্ড অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট মেন্টাল হেলথের (বিএসিএএমএইচ) সভাপতি। প্যানিক অ্যাটাকের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা, সীমাবদ্ধতা গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

প্যানিক অ্যাটাক মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর কতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে?

প্যানিক অ্যাটাক মানসিক স্বাস্থ্যের এমন একটি অবস্থা, যখন আক্রান্ত ব্যক্তি মনে করে, সে মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছে অথবা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে যা তার অস্তিত্বকে বিপন্নের মুখে ফেলবে। এটিকে বলা হয় প্যানিক অ্যাটাক। প্যানিক অ্যাটাক যখন ঘন ঘন হতে থাকে তখন সেটাকে বলা হয় প্যানিক ডিজঅর্ডার। এতে মানুষের জীবনযাত্রার মান ব্যাহত হয়।

প্যানিক অ্যাটাক কি কোনো রোগের কারণে প্রভাবিত হয়?

প্যানিক অ্যাটাক প্যানিক ডিজঅর্ডার নামের একটি মানসিক রোগের কারণে হয়। এছাড়া বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা, মানসিক চাপ ইত্যাদি মানসিক সমস্যার কারণেও প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।

শিশু, প্রাপ্তবয়স্ক বা প্রবীণ কাদের মধ্যে রোগের প্রবণতা বেশি দেখা যায়?

প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্যানিক অ্যাটাকে আক্রান্তের হার শিশুদের চেয়ে বেশি। প্যানিক অ্যাটাকের ফলে মানুষের কাজের মাত্রা গুণগত মান কমে যায়। কর্মক্ষেত্রে তার পারফরম্যান্স কমে যায়। শিক্ষাগত ক্ষেত্রে তার পারফরম্যান্স কমে যায়। সব মিলিয়ে একে একটি গুরুত্বপূর্ণ মানসিক সমস্যা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

প্যানিক অ্যাটাক কী কারণে হয়?

এটি একটি কমন মেন্টাল ডিজঅর্ডার। মস্তিষ্কে নিউরো ট্রান্সমিটারের ভারসাম্যহীনতার কারণে এমন সমস্যা হয়। শৈশবে একজন মানুষের বিকাশের ক্ষেত্রে যদি কোনো জটিলতা হয়, যেমন প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে বা পরিবেশগত সমস্যা থাকলে পরবর্তী সময়ে প্যানিক অ্যাটাক হতে পারে।

দেশ বিদেশের সবখানে কি সমস্যার পেছনে একই ধরনের কারণ পাওয়া যাচ্ছে, নাকি আলাদা?

বয়সভেদে অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে প্যানিক অ্যাটাকের আলাদা কারণ রয়েছে। এর আলাদা চিকিৎসাও রয়েছে। প্যানিক অ্যাটাক নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি মানসিক সমস্যা।

এর লক্ষণ উপসর্গগুলো কী?

এতে আক্রান্ত হলে মানুষ মনে করে, তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে, সে মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে পারছে না। পায়ের কাঁপুনি, টালমাটাল ভাব, বুক ধড়ফড়, হঠাৎ ঘাম হওয়া, মৃত্যুভয়ে পতিত হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দিতে পারে।

জনস্বাস্থ্যের জন্য প্যানিক অ্যাটাক কতটা উদ্বেগের কারণ?

প্যানিক অ্যাটাক জনস্বাস্থ্যের জন্য উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। আমরা যদি সত্যিকার অর্থে এটিকে চিহ্নিত করতে পারি তাহলে অনেকাংশেই আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি।

কী কারণে রোগটি অ্যাড্রেস কম করছি বা আমাদের নজরে আসছে না?

অনেক সময় আমরা প্যানিক অ্যাটাককে হৃদরোগ বা অন্যান্য মানসিক সমস্যার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলছি। মানুষ মনে করছে, প্যানিক অ্যাটাক একটি হৃদরোগজনিত সমস্যা। আসলে তা নয়, এটি সম্পূর্ণ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা। চিকিৎসা কাউন্সেলিংয়ে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পূর্ণ নিরাময় হয়।

বাংলাদেশে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্যানিক অ্যাটাকের পরিস্থিতি কেমন?

বাংলাদেশ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্যানিক অ্যাটাক পরিস্থিতি এমন একটি স্বাস্থ্য সমস্যা, যা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণযোগ্য। প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণগুলো যদি আমাদের অন্যান্য চিকিৎসক মানসিক রোগের চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন তাহলে এটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে নিরাময়যোগ্য বা নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি সমস্যা।

বাংলাদেশে রোগটাকে চিহ্নিত করে সেবা, চিকিৎসা পরামর্শ প্রদানের প্রবণতা কি আগের থেকে এগিয়েছে?

অবশ্যই এগিয়েছে। আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের নীতি আছে, মানসিক স্বাস্থ্যের কর্মকৌশল আছে, আমাদের এমএইচ গ্যাপ (মেন্টাল হেলথ গ্যাপ ট্রেনিং) অ্যাকশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে আমরা প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণ চিকিৎসা সম্পর্কে প্রান্তিক পর্যায়ের চিকিৎসক স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। এর মাধ্যমে আমরা প্যানিক অ্যাটাক দ্রুততম সময়ে শনাক্তকরণ চিকিৎসার উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা বলি যে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বিগত ৫০ বছরে মানসিক স্বাস্থ্যের যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তার মধ্যে ৯০ শতাংশ হয়েছে গত ১০ বছরে।

মানসিক স্বাস্থ্যের একটি প্রকল্পে আপনি কাজ করছেন, সেই প্রকল্পটা সম্পর্কে আমাদের কিছু জানাবেন?

প্রকল্পটির নাম স্পেশাল ইনিশিয়েটিভ ফর মেন্টাল হেলথ (এসআইএমএইচ) এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রকল্প; যা বিশ্বের ১৩টি দেশে, যারা মানসিক স্বাস্থ্যকে তাদের নীতিমালায় অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে, সেখানে পরিচালিত হচ্ছে। দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। মানসিক স্বাস্থ্যকে আমরা নীতিগত পর্যায়ে সেবার পর্যায়ে অধিকতর গুরুত্ব দিচ্ছি। আমরা মনে করি, মানসিক স্বাস্থ্যকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত। এখন গণমাধ্যমও এসব নিয়ে কথা বলছে, ১০ বছর আগেও যা পারত না। মানসিক স্বাস্থ্য এখন জনগুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

প্যানিক অ্যাটাক রোগে চিকিৎসার সীমাবদ্ধতা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ পরামর্শ জানাবেন।

আমি মনে করি, চিকিৎসায় আমাদের তেমন কোনো সীমাবদ্ধতা নেই। তবে আমাদের স্কোপ অব ডেভেলপমেন্ট অর্থাৎ উন্নতির অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। মানে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে যদি সাধারণ মানুষকে অবহিত করতে পারি এবং প্রান্তিক পর্যায়ে যেসব চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবাকর্মী রয়েছেন তাদের যদি মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অবহিত করতে পারি তাহলে সব ধরনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করা সক্ষম হবে। সুতরাং আমরা মনে করি, মোটা দাগে আমাদের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, বরং কিছু দায়িত্ব রয়েছে। দায়িত্ব হচ্ছে, চিকিৎসক প্রান্তিক পর্যায়ে কর্মরত সব স্বাস্থ্যকর্মীকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে অবহিত করা।

রোগে কি শুধু মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞরাই চিকিৎসা করবেন, নাকি স্নায়বিক বিশেষজ্ঞদেরও ভূমিকা রয়েছে?

প্যানিক অ্যাটাক বা ডিজঅর্ডার পুরোপুরিভাবে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়, এখানে স্নায়বিক বিষয়ের কোনো সম্পর্ক নেই। এখানে সাইকিয়াট্রিস্ট সাইকোলজিস্ট মানে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মনোবিজ্ঞানী উভয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

প্যানিক অ্যাটাক নিয়ে আমাদের দেশে গবেষণা হচ্ছে কতটা?

আমাদের নন কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল প্রোগ্রামের আওতায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে যে গবেষণা রয়েছে তা গত পাঁচ বছরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। গবেষণা অন্যান্য ক্ষেত্রেও প্যানিক অ্যাটাকসহ অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে বিবেচিত হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যসেবাবিষয়ক গবেষণায় বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে রয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন