সাক্ষাৎকার

মুদ্রানীতি কার্যকরে রাজস্ব নীতিকেও সহায়ক ভূমিকা রাখতে হবে

ড. মনজুর হোসেন

[গতকালে পর]

অর্থ পাচার বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর কোনো প্রভাব ফেলছে কি?

বাইরে যখন অর্থ পাচার হয়, সেটা নিশ্চয়ই হুন্ডির মাধ্যমে হয়েছে এবং ওভার আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে হয়। তাহলে অবশ্যই রিজার্ভের ওপর এর প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ভূমিকা আছে। কালোবাজারে ডলার রেটটা অফিশিয়াল রেটের চেয়ে অনেক বেশি হয়। ওভারঅল, ক্যাপিটাল ফ্লাইট তো কোনো দেশের জন্যই ভালো নয়। কোনো কারণেই এটা মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। কিন্তু আমি মনে করছি না এটার জন্য বর্তমান সমস্যাটা। আমদানি হঠাৎ করে বেড়ে গেছে, এটা সারা বিশ্বেই বেড়েছে। সেটার একটা কারণ হচ্ছে প্রাইস এসকেলেশন। রিয়েল সেন্সে খুব একটা ইমপোর্ট হয়তো বাড়েনি। মূল্য বেড়ে যাওয়ায় আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। সে তুলনায় এক্সপোর্টটা আমাদের ক্ষেত্রে ডাইভার্সিফাইড নয়, যার ফলে আমদানি-রফতানির গ্যাপটা বেড়ে গেছে। একই সময়ে রেমিট্যান্স হঠাৎ করে কমে গেছে, সে কমাটাও আমি অযৌক্তিক মনে করি না। কারণ যখন করোনাকালীন রেমিট্যান্স অনেক বেড়েছিল। এর একটা কারণ বিদেশে আমাদের যারা অভিবাসী শ্রমিক আছেন, তারা তাদের আত্মীয়-স্বজনকে লাইভলিহুড সাপোর্ট দেয়ার জন্য যা সঞ্চয় আছে তা- পাঠিয়েছেন, এমনকি ধার করে পাঠিয়েছেন। এখন যেহেতু রিকভারি চলছে, অর্থাৎ কিছু কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে এবং উপার্জন হচ্ছে, সেহেতু এখন তারা রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়ে ওখানে যেসব ধার-দেনা আছে, সেগুলো শোধ করছেন। রেমিট্যান্সেরও একটা চক্র আছে, এটা যে সবসময় একইভাবে চলবে এটা মনে করা ঠিক নয়।

এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার, ৪৮ বিলিয়ন ডলারের যে রিজার্ভ হয়েছিল এটাকে বাংলাদেশের জন্য আমি স্বাভাবিক রিজার্ভ বলে মনে করি না। করোনার কারণে আমদানি কমে যাওয়া এবং রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়া এর কারণ ছিল। তাই বর্তমানে রিজার্ভ যে কমে আসছে তাতে এখনো খুব বেশি উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। সেদিক থেকে চিন্তা করে আমি মনে করি না যে রিজার্ভের যে অবস্থান আছে, সেটা খারাপ অবস্থায় আছে। এটা মোটামুটি যৌক্তিক, চার-পাঁচ মাসের আমদানি করতে পারার মতো রিজার্ভ ধরে রাখতে পারা যথেষ্ট।

বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে থাকলেও তো সেখানে কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে...

খেলাপি ঋণের সঙ্গে জড়িতরা অনেক শক্তিশালী। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করাটা কঠিন। সেজন্য বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অটোনমির কথা বলা হয়েছে, স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। কথা সত্য, গণতান্ত্রিক একটি দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পুরোপুরি স্বাধীনতা দেয়াও সম্ভব নয়। উন্নত দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো পুরোপুরি স্বাধীন হয়নি। কিন্তু ন্যূনতম যে স্বাধীনতাটুকু থাকা দরকার, রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনের মাধ্যমে তাদের যে ভূমিকা পালন করার কথা, এক্ষেত্রে সরকারেরই উচিত তাদের সমর্থন দেয়া। সে জায়গায় অন্তত ঋণখেলাপি হওয়ার বিরুদ্ধে তারা যেন যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে, সেখানে অন্য যে সমস্যাগুলো রয়েছে সেগুলো যেন তারা প্রকৃতভাবে সমাধা করতে পারে সে সুযোগটা তাদের দেয়া উচিত। সক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের খুব একটা ঘাটতি নেই। কিন্তু তাদের যে সিগন্যাল বা দিকনির্দেশনা সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া দরকার, সেখানে অনেক সময় ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। কারণেই সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

শুরুতে বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। মাঝে হঠাৎ করে এটিকে বার্ষিক করা হলো। এবার আবার ছয় মাস পর মুদ্রানীতি ঘোষণার মধ্যে ফিরে গেল বাংলাদেশ ব্যাংক। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

একসময় বছরে দুবার মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হতো। মাঝখানে একবার করে ঘোষণা করা হয়েছে। এবার আবার ষাণ্মাসিক ভিত্তিতে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হচ্ছে। এটি ভালো পদক্ষেপ। ভারতে মুদ্রানীতি কমিটি আছে, তারা প্রতি দুই মাস অন্তর মুদ্রানীতি পর্যালোচনা করে। বিভিন্ন নীতিহার পরিবর্তন করে। মুদ্রানীতি একটা ডায়নামিক প্রসেস। এটাকে ছয় মাসের জন্য ফিক্সড করে রাখা ঠিক নয়। সে বিবেচনায় এটা যদি কোয়ার্টারলি ঘোষণা করা যায়, তাহলে মানুষের কাছে মুদ্রানীতি আরো স্বচ্ছ দৃশ্যমান হবে এবং অর্থনীতির জন্য আরো কার্যকর হবে। সেদিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে, তারা মুদ্রানীতি কমিটি গঠন করতে পারে অথবা মুদ্রানীতি বোর্ড করতে পারে। মুদ্রানীতির ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান বোর্ডের কোনো প্রভাব আছে বলে মনে হয় না। সেদিক থেকে মুদ্রানীতি যদি কোয়ার্টারলি করা যায়, তাহলে সমস্যাগুলো নিয়ে আরো বেশি আলোচনা করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সমাধানের জন্য আরো দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবে।

আপনি বলেছেন মুদ্রানীতিকে কার্যকর করার ক্ষেত্রে রাজস্ব নীতির একটা ভূমিকা আছে। বাংলাদেশের রাজস্ব নীতি কি মুদ্রানীতিকে সহায়তা করে?

রাজস্বনীতি ডেফিনিটলি বিভিন্নভাবে মুদ্রানীতির কমপ্লিমেন্টারি ভূমিকা পালন করে। জোগানের দিক থেকে যেসব বিষয় রয়েছে যেমন চাঁদাবাজি বন্ধ, সড়ক ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন ইত্যাদির মাধ্যমে সরকার যদি ব্যয় কমিয়ে আনে পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম জোরদার করে, তাহলে মুদ্রানীতির মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ অনেকটা সহজ হয়ে যায়। সরকার যদি অপ্রয়োজনীয় খাতে ঋণ নেয়া বন্ধ করে অর্থাৎ বিনিয়োগ কমিয়ে দেয়, তাহলে মুদ্রানীতি একটা ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্য একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটি আছে যেখানে মূল্যস্ফীতি হার কত হবে, প্রবৃদ্ধি হার কত হবে এসব বিষয়ে আলোচনা হয়। একই সময়ে এগুলো অ্যাড্রেস করার জন্য কী কী ব্যবস্থা নেয়া হবে সে বিষয়গুলো আলোচিত হওয়া দরকার। শুধু লক্ষ্য নির্ধারণের জন্য দুই পক্ষ বসলেই হবে না, একই সঙ্গে বিষয়গুলো কীভাবে সমাধান হবে, কোথায় কোথায় মুদ্রানীতির ভূমিকা আছে, কোথায় রাজস্বনীতির ভূমিকা আছে, সেগুলো সঠিকভাবে নেয়া হচ্ছে কিনা, বিষয়গুলো আলোচনা হওয়া দরকার।

মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন একটা জটিল ইস্যু। সুদহার বাড়ানো হলে অর্থপ্রবাহ কমবে, কর্মসংস্থান কমবে, আয়ও কমবে। আবার মূল্যস্ফীতি না থাকলে উদ্যোক্তারা প্রণোদনাও পাবেন না। জটিল প্রক্রিয়ায় মুদ্রানীতি কীভাবে সমাধান দেয়?

আমাদের দেশে সমস্যা হলো সুদহারটা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আর্থিক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করাও জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদেরও গবেষণা আছে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের সঙ্গে সুদহারের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ যোগসূত্র নেই। বাংলাদেশে এটা না থাকার একটা কারণ হচ্ছে এখানে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া। একজন যদি মনেই করে আমি টাকাটা নিয়ে আর দেব না। তাহলে তার জন্য সুদহার কোনো বিষয়ই না। আবার একই সময়ে যখন খেলাপি ঋণ বেড়ে যায়, তখন তার প্রভাবটা ভালো ঋণগ্রহীতাদের ওপর পড়ে। তখন সুদহার বাড়ে। ফলে বিনিয়োগকারীরা খুব প্রফিট মেকিং বিজনেস করতে পারে না। এটার কারণে দেখা গেছে যে বাংলাদেশে ঋণের সুদহার এমন একটা পর্যায়ে চলে যায়, যেটা দিয়ে বিনিয়োগ খুব একটা লাভজনক হয় না। এজন্যই আর্থিক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। অর্থনৈতিকভাবে পর্যন্ত আমরা যা অর্জন করেছি, সেগুলো ধরে রাখার জন্য আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরো শক্তিশালী করা উচিত, তাদের যেসব দায়িত্ব রয়েছে সেগুলো পালনের জন্য তাদের সুযোগ দেয়া দরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেদেরও যেসব জায়গায় দুর্বলতা রয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে তার দ্রুত সমাধান করা দরকার।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর রঘুরাম রাজন বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা এখন আর মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। এটা বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়া উচিত, বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন, সবুজ অর্থায়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তিএগুলো নিয়ে কাজ করা উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংকেরও কি এদিকে দৃষ্টি দেয়ার সময় হয়েছে?

আমি ব্যক্তিগতভাবে এখনো মনে করি বাংলাদেশের মতো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব মুদ্রানীতি প্রণয়ন, ব্যাংক তদারকি, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনের সহায়ক ভূমিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। যদিও নিকট অতীতে আমাদের দেশেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজ কিছুটা বৈচিত্র্যময় করার চেষ্টা হয়েছে। এতে অন্যদিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে তাদের মৌলিক কাজ অবহেলিত হয়েছে। আমাদের আর্থিক খাত পুরোপুরি বাংলাদেশ ব্যাংকের আয়ত্তে নেই, অথবা তারা ক্ষমতার পুরোপুরি চর্চা করতে পারছে না। আর্থিক বাজার এখনো প্রতিযোগিতামূলক হয়নি। যে কারণে সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে দিতে হচ্ছে। জায়গাগুলো নিয়ে কাজ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি জলবায়ু পরিবর্তন বা সবুজ অর্থায়ন বা অন্য কিছু নিয়ে কাজ করে, তবে কাঙ্ক্ষিত সুফল পাওয়া যাবে না, মুদ্রানীতিও কার্যকর হবে না। মুদ্রানীতির কার্যকারিতার জন্য প্রথম এবং প্রধান শর্তই হচ্ছে আর্থিক খাতকে দক্ষ হতে হবে। ১৯৮০ ১৯৯০-এর দশকে সরকার আর্থিক খাত সংস্কার করেছে। সে সময়ে সংস্কারের বড় একটা কাজ ছিল সুদহারটা বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া। সেটা করাও হয়েছে, কিন্তু সেটা ভালো কাজ করেনি। অনেক সময় ব্যক্তি ব্যবসায়ীদের সুবিধার জন্য ব্যাংকিং আইনকে পরিবর্তন করা হয়েছে। যেটা অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংক খাতের উন্নয়নের পক্ষে না গিয়ে বরং তাদের সুবিধাভোগীদের পক্ষে গেছে। এসব কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা ডিউ লেভেলে থাকতে পারেনি।

মুদ্রানীতি কার্যকর হতে হলে অবশ্যই আর্থিক খাত উন্নত হতে হবে। এর জন্য অবশ্যই আর্থিক খাতের পরিপূর্ণ তদারকি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংককে দিতে হবে। তাহলেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে সম্ভব অন্যান্য জায়গায় যথাযথ দৃষ্টি দেয়া। এটি না হলে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, খেলাপি ঋণ বাড়বে, ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে চলে যাবে, আর্থিক খাতের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে। এগুলো অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর। [শেষ]

 

. মনজুর হোসেন: গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন