নাগরিক জীবন আমাদের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে

জাভেদ আখতার ছবি: জাভেদ আখতারের ফেসবুক

হিন্দি সিনেমায় আপনি ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করছেন। এর মধ্যে হিন্দি সিনেমায় বিভিন্ন পরিবর্তন এসেছে। আপনার নজরে আসা উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো কী?

আপনি বলতে পারেন যে আমরা সামন্ততান্ত্রিক যুগ পেরিয়ে করপোরেট ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল যুগে প্রবেশ করেছি। যদি আপনি ষাট ও সত্তরের দশক কিংবা তারও আগের পরিচালক ও প্রযোজকদের দিকে তাকান, দেখবেন তারা ভারতীয় সংস্কৃতি ও ভাষাকে মননের গভীরে লালন করত। আমি পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের শুরুর দিকের সাদা-কালো ক্ল্যাসিক সময়ের কথা বলছি, যখন সিনেমাগুলোর একটি স্বাতন্ত্র্য ছিল। পৃথিবীকে পর্যবেক্ষণের দিক থেকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল ‘দেশী’। বর্তমান প্রজন্মের ব্যাপক বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে। এটি ভালো দিক। 

তবে খারাপ দিকটি হলো তাদের শেকড় আর ততটা গভীর নয়। গড়পড়তা হিন্দি সিনেমার কথা বাদ দিন। এগুলো তখনো খারাপ ছিল, আর এখন তো বলাই বাহুল্য। যদি আপনি সাম্প্রতিক কিছু সিনেমা দেখে থাকেন, লক্ষ করবেন আমরা আঙ্গিকের দিক থেকে উন্নত হয়েছি কিন্তু সূত্রটা হারিয়ে গেছে। 

সংলাপে নাটকীয়তার পরিমাণ কমে গেছে এবং কথ্য ভাষার কাছাকাছি হয়ে উঠেছে। সংলাপের এ পরিবর্তন সম্পর্কে আপনি কী বলবেন? 

আপনি লক্ষ করবেন সিনেমা থেকে অতিরঞ্জিত সংলাপ অনেকাংশে হারিয়ে গেছে। অর্থবহ সিনেমা নির্মিত হচ্ছে। যেমন অনুভব সিনহার আর্টিকেল ফিফটিন ও থাপ্পড়। আমি মনে করি থাপ্পড় একটি উৎকৃষ্ট সিনেমা। পুরো সিনেমায় ন্যূনতম অতিরঞ্জন নেই। কোনো রেটরিকের ব্যবহার ছাড়াই তারা প্রতিটি অভিব্যক্তিকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। ভালো সংলাপের ক্ষেত্রে বলতে হয়, এটি নির্ভর করে যে চরিত্র সে বাক্যগুলো বলছে তার শক্তিমত্তার ওপর। পুরনো হিন্দি সিনেমার চরিত্রগুলো ছিল সরল। এখন চরিত্রগুলো বৈচিত্র্যময়। প্রাপ্তমনস্কতার দিকে এটি বড় একটি পদক্ষেপ। 

গান প্রায় হারিয়ে গেছে। পূর্বে আমাদের গভীর অর্থপূর্ণ গানও ছিল। সিনেমায় গানের ব্যবহার যেভাবে পরিবর্তিত হয়েছে, তা কি অনুতাপের নয়? 

গানের এই যে অবমূল্যায়ন, এর কারণটি আমিও বুঝি না। আপনি যথার্থ বলেছেন। এখন প্রায়ই গানগুলো একটি দৃশ্যের ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়। লিপ-সিঙ্ক গানগুলো এখন দেখা যায় না। আমি বলছি না যে সব সিনেমায় গান থাকতে হবে। কিন্তু কিছু সিনেমায় থাকতে পারে। কখনো একটি গান একটি দৃশ্যের চেয়ে অধিক প্রকাশ করতে পারে। ‘‌ওয়ো সুবাহ কাভি তো আয়েগি’র মতো গানের আবেদন সংলাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। কথাটা শুনতে বেমানান লাগবে। কিন্তু এ ধরনের গান সমাজে প্রয়োজন। রোমান্টিক গান ‘‌আভি না যাও ছোড় কর’ সম্পর্কে আপনি কী বলবেন কিংবা বিষণ্নতার কলি ‘‌জানে ভো ক্যায়সে লোগ থে জিনকে পেয়ার কো পেয়ার মিলা’ প্রকৃতি বন্দনা হারিয়ে গেছে। বাদল, আসমান, নদী, হাওয়া, সিতারা ও সুরায—এ ধরনের শব্দগুলো তেমন শোনা যায় না। আমার মনে হয় চাঁদ নিয়ে এখন আর কল্পনা করে না। এর কারণ আমার জানা নেই। পুরনো গানগুলোয় চাঁদ ও পূর্ণিমার চিত্র বারবার উঠে আসত। গান থেকে ফুল, কলি, ভানওয়ারি, তিতলি, পাঁচি—এ শব্দগুলোও হারিয়ে গেছে। নাগরিক জীবন আমাদের প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

আপনি সিনেমার জন্য প্রচুর গান লিখেছেন। গান লেখার ক্ষেত্রে আপনার পাওয়া সবচেয়ে খারাপ উপদেশটি কী?

(হাসি) প্রায়ই আমাকে প্রাত্যহিক জীবনে ব্যবহৃত ভাষায় গান লিখতে বলা হয়। তাদের কে বোঝাবে যে গদ্য ও পদ্যের মধ্যে পার্থক্য আছে। আর কবিতা যতই সরল হোক না কেন, এটি তো কবিতাই। এটি কথ্য ভাষা নয়। 

যখন কেউ আপনাকে এমন উপদেশ দেয়, আপনি কী বলেন?

আমি তাদের বলি, আপনাদের ব্যবহৃত শব্দ দিয়ে গান লেখা সম্ভব নয়, টেলিগ্রাম লেখা যেতে পারে। কিন্তু এখন সেটাও সম্ভব নয়, কারণ টেলিগ্রামের যুগ শেষ হয়ে গেছে।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখক নাসরিন মুন্নী কবিরের ‘‌টকিং লাইফ—জাভেদ আখতার ইন কনভারসেশন উইথ নাসরিন মুন্নী কবির’ বই থেকে ভারতের বিশিষ্ট কবি ও গীতিকার জাভেদ আখতারের সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন নিজাম আশ শামস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন