মুদ্রানীতিতে সমস্যা চিহ্নিত করা হয়েছে, কিন্তু সমাধান সঠিকভাবে দিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক

ড. মনজুর হোসেন গবেষণা পরিচালক, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। জাপানের ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ থেকে আন্তর্জাতিক অর্থনীতিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তার আগ্রহ ও গবেষণার বিষয় মুদ্রানীতি, সামষ্টিক অর্থনীতি, আর্থিক খাত, শিল্প ও আইটি। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নালে তারা বহু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘‌ম্যাক্রো ইকোনমিক পলিসি’ ও ‘‌ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন’ শীর্ষক তার দুটি বই সাম্প্রতিককালে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা পেলগ্রেভ ম্যাকমিলান থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় ষাণ্মাসিক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। সদ্য ঘোষিত মুদ্রানীতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে আলাপ করেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা


কেমন হলো এবারের মুদ্রানীতি?

এবারের মুদ্রানীতিটি তেমন খারাপ হয়নি। কিন্তু এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু সীমাবদ্ধতা খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তারা মুদ্রানীতিকে মোটামুটি যৌক্তিক করার চেষ্টা করেছে। তবে কিছু সীমাবদ্ধতার কারণে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে মুদ্রানীতিটি প্রণয়ন করা যায়নি বলে আমার মনে হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের চ্যালেঞ্জ হলো একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এগিয়ে নেয়া। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ২০২৩ সালকে মন্দার বছর হিসেবে সতর্ক করছে। মন্দা থেকে বাঁচার জন্য একদিকে যেমন বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার, অন্যদিকে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য ঋণপ্রবৃদ্ধিও কমানো দরকার। দুটো ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে ঋণের (ভোগ্যঋণ বাদে) সুদহারের সর্বোচ্চ সীমা বাংলাদেশ ব্যাংক ওঠাতে পারেনি। ঋণের সুদহারের সীমা না তুলে নেয়ার বিষয়টি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেরই অংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু ভোক্তা ঋণের ওপর থেকে সুদহারের সীমা উঠিয়েছে। এটি কিছুটা বৈষম্যমূলকও বটে। মোট ঋণের বাজারে ভোক্তা ঋণের অংশ - শতাংশের বেশি হবে না। এতে মূল্যস্ফীতির ওপর খুব একটা প্রভাব পড়বে বলে আমার মনে হয় না। অন্যদিকে আমানতের সুদের ওপর যে সীমা ছিল ( শতাংশ), সেটা তুলে দেয়া হয়েছে। ঋণের সুদহারের সীমা না তুলে আমানতের হারের সীমা তুলে খুব একটা সুবিধা হবে না। এতে ব্যাংকগুলো অন্য ধরনের সুবিধা নিতে পারে। ব্যাংক চাইলে আমানতের সুদের হার আরো কমিয়েও দিতে পারবে। সে ঝুঁকিটা থেকে যাচ্ছে।

ঋণের বড় অংশই শিল্পভিত্তিক টার্মলোন বা ট্রেড লোন। ঋণের সুদের হার না বাড়িয়ে রেপো রেট বাড়ানো হয়েছে। সে জায়গায় বাংলাদেশ ব্যাংক খুব ভালো পদক্ষেপ নিতে পারেনি। মুদ্রানীতি প্রণয়নের আগে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের নিয়ে যে সভা আয়োজন করেছিল সেখানেও আমি বলেছিলাম, রেপো রেটের পরিবর্তনের দরকার নেই। কারণ আর্থিক বাজারে এরই মধ্যে তারল্য সংকট আছে। রেপো রেট পরিবর্তন করলে সংকট আরো বেড়ে যেতে পারে। দশমিক ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়ানো বা কমানোয় কিছুই হবে না, তার পরও বাজারে একটি বার্তা যাবে যে সরকার অর্থপ্রবাহ কমাতে চাইছে। এতেই তারল্য সংকট আরো বাড়বে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপগুলো নেয়া জরুরি ছিল সেটা আংশিকভাবে নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু এতে খুব একটা লাভ হবে বলে মনে হয় না। অন্যদিকে ঋণপ্রবাহ কিছুটা সংকুচিত করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক সঠিক বার্তা দিতে পারেনি। ঋণের সুদহার পরিবর্তন না করতে পারলেও মন্দা এলে বিনিয়োগ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যাতে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। আমি আশা করব, বাংলাদেশ ব্যাংক অচিরেই ঋণের সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টি বাজারের ওপর ছেড়ে দেবে এবং তা একটি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে মুদ্রানীতিকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করবে।

ব্যাংকে আমানত সঞ্চয়ের প্রবদ্ধি কমছে। এর কারণ মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি শতাংশ আর ব্যাংক যদি আমানতের ওপর - শতাংশ সুদ দেয় তাহলে মানুষ - শতাংশ অর্থ হারাচ্ছে। এমন অবস্থায় ভবিষ্যতে সঞ্চয়ের চেয়ে মানুষ এখনই ভোগ করতে চাইবে বেশি। হয়েছেও তাই। তাছাড়া উচ্চমূল্যস্ফীতিতে টিকে থাকতে মানুষ সঞ্চয় ভাঙছে। ফলে ব্যাংকে আমানত প্রবৃদ্ধি কমেছে। তারই ফলে তারল্য সংকট দেখা যাচ্ছে। আমানত কমার আরো একটি কারণ হচ্ছে ইসলামী ব্যাংকগুলো সম্পর্কে যে স্ক্যান্ডাল শোনা যাচ্ছে, তাতে ব্যাংকের ওপর আমানতকারীদের আস্থা কমে যাচ্ছে। যে কারণে ব্যাংকগুলো থেকে মানুষ টাকা তুলে ফেলছে। টাকা তুলে ফেলার পর অনিরাপদ জায়গাগুলোয় মানুষ হয়তো টাকা আমানত হিসেবে রাখছে। এমন প্রবণতা আর্থিক খাতের জন্য ইতিবাচক নয়। সার্বিকভাবে বর্তমান মুদ্রানীতিতে সমস্যাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে কিন্তু সমাধানগুলো সঠিকভাবে দিতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক।


মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এবারের মুদ্রানীতি কতটা সহায়ক হবে?

মূল্যস্ফীতির প্রকৃতিটা যদি দেখি তাহলে দেখব, খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি অপেক্ষাকৃত বেশি। মূল্যস্ফীতির অনেকটাই আবার আমদানি করা মূল্যস্ফীতি, যেটা ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় টাকার অবমূল্যায়নের কারণে হয়েছে। আন্তর্জাতিক সরবরাহ চেইনে বিঘ্ন ঘটায় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। কভিড, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, কভিড-পরবর্তী অবস্থা এবং বর্তমানে চীনে যে কভিড চলছে তার কারণে সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব পড়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের খুব বেশি করণীয় কিছু নেই। কিন্তু তার পরও যেটা বলা হয় যে স্থানীয় চাহিদা বেড়েছে। কভিড-পরবর্তী সময়ে চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। সেটাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মুদ্রানীতিতে অর্থের সরবরাহ কিছুটা কমিয়ে দেয়াটাই যৌক্তিক। এখানেও ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার আছে। প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমিয়ে মূল্যস্ফীতির হারকে কিছুটা সহনীয় পর্যায়ে রাখাটাই যৌক্তিক। আমাদের প্রত্যাশা ছিল এবং বাজারও ডিমান্ড করছে যে আমানতের সুদের হার বাড়ুক। সেদিক থেকে শতাংশ আমানতের সুদহার এবং ঋণের সুদহার ১২ শতাংশ সীমা নির্ধারণ করা হলে ভালো হতো। যেটা দিয়ে বাজারে অন্তত একটা সংকেত দেয়া যেত যে মূল্যস্ফীতি হার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। এখানে একটি বিষয় আমি বলতে চাই, বাংলাদেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সুদহার একমাত্র প্রতিবন্ধক নয়। তাই সুদহার যদি ১২ শতাংশ হয়, তা ঋণের প্রবৃদ্ধিতে তেমন প্রভাব ফেলবে বলে আমার মনে হয় না। বরং খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ বেশি জরুরি। শুধু রেপো রেট বাড়ানো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে খুব একটি কার্যকর নীতি হতে পারে না। সরকারকেও কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থ সাপোর্ট দিয়েছে, সেটিও মূল্যস্ফীতিতে কতটুকু ভূমিকা রেখেছে, তাও বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। জায়গাগুলোয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দিক থেকে আরো প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা পালনের সুযোগ রয়েছে।


সরকারের রাজস্ব আহরণে গতি আশানুরূপ নয়। বাজেট বাস্তবায়নে সরকার ব্যাংক থেকে অর্থ নিচ্ছে। মুদ্রানীতি বাস্তবায়নে এটি কি কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে?

সরকার কেন অতিরিক্ত ঋণ নিচ্ছে, সেটা অবশ্যই দেখার বিষয়। সরকারের রাজস্ব আয় কমে গেছে। যার কারণে সরকারকে ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সরকার যখন বেশি ঋণ নেবে তখন স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি খাত কম ঋণ পাবে। কিন্তু গত ছয় মাসের ফলাফল তা বলে না। বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবৃদ্ধি বেশ ভালোই হয়েছে। এটা আগের স্বাভাবিক সময়ের মতোই রয়েছে। সরকারের জন্য ঋণের যে লক্ষ্য ছিল সেটি কিছুটা এদিক-ওদিক হতে পারে, তবে আমি সেটাকে দোষের বলে মনে করি না। কারণ ১০০ শতাংশ অনুমান তো করা যায় না যে সরকারি ঋণ প্রবৃদ্ধি কত শতাংশ হবে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্রড মানি সরবরাহটা যেন নির্দিষ্ট পর্যায়ে থাকে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। সেটা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এক্ষেত্রে সরকারকে যদি অর্থ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাধা নাও দিতে পারে তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধিটা কিছুটা কমানো যেতে পারে। সরকারের ঋণ বিনিয়োগ, বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য জায়গায় যায় আর বেসরকারি খাতের ঋণ কিছুটা ভোগে ব্যয় হয়, কিছুটা বিনিয়োগে ব্যবহার হয়। বিনিয়োগ থেকে আবার ভোগে যায়। চক্রের কারণেও বেসরকারি ঋণ মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখে। তাই সময়ে বেসরকারি খাতের ঋণ কিছুটা কমানোর জন্য আমরা সবসময় বলে আসছি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ঋণের প্রবৃদ্ধি কিছুটা কমানো দরকার। এবারের মুদ্রানীতিতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা আগের জায়গায় রাখা হয়েছে। বর্তমান মন্দার পূর্বাভাসের পরিপ্রেক্ষিতে সেটাকে খারাপ মনে করি না। কিন্তু নীতিহার এবং সুদহারের সঙ্গে ইন্টার লিংকেজ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের কথা থেকেও বোঝা যায় যে ঋণের সুদহারের বিষয়টা তাদের হাতেও পুরোটা নেই। সেখানেও প্রশ্ন আসে দায়িত্ব পালনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কতটা স্বাধীন। আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাজের স্বাধীনতা থাকাটা খুবই জরুরি। সে জায়গাটায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের দিক থেকেও কিছুটা হস্তক্ষেপ থাকে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপও থাকে। অনেক সময় ব্যবসায়ীরাও হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককে এসব সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। তবে তাদের যে দায়িত্বটুকু আছে সেটা যথাযথভাবে পালন করে দেশের অর্থনীতিকে সঠিক ট্র্যাকে নিয়ে আসা, বিশেষ করে মুদ্রানীতির দিক থেকে যতটুকু করা যায়, সেটাকে চর্চা করার ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা থাকতে হবে।


বাংলাদেশের আর্থিক খাতে বিভিন্ন ধরনের কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটছে, মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এগুলো কোনো সমস্যা তৈরি করবে কি?

মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আর্থিক খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ মুদ্রানীতির মানি ট্রান্সমিশন চ্যানেল হলো আর্থিক খাত। খাত যদি দক্ষ সক্ষম এবং উন্নত না হয়, তাহলে মুদ্রানীতি কাজ করে না। রেপো রেট বা পলিসি রেট বাড়ানো-কমানোর প্রভাব যদি আর্থিক খাতে না পড়ে, তাহলে সে মুদ্রানীতি কার্যকর হয় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা- ঘটছে এবং তা ঘটার একটা বড় কারণ আমাদের আর্থিক খাত পুরোপুরি কম্পিটিটিভ দক্ষ নয়। এখানে অনেক ধরনের অদক্ষতা রয়েছে। অনেক ধরনের পক্ষ আছে, যারা বিভিন্নভাবে তাদের ব্যবসার জন্য আর্থিক খাতকে ব্যবহার করছে। যার ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চাইলেও সবকিছু সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারছে না। মুদ্রানীতির ভূমিকা এজন্যই বাংলাদেশে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশে বরং রাজস্বনীতির ভূমিকা মুদ্রানীতির চেয়ে বেশি শক্তিশালী। সে জায়গা থেকে আর্থিক খাতের তদারকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এটা তাদের চার্টারেই লেখা আছে। জাপানে ফাইন্যান্সিয়াল সেক্টর সুপারভাইজরি ইউনিটকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আলাদা এবং স্বাধীনভাবে গঠন করা হয়েছে। আমাদের দেশে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। এখানেও নানা ভাগ রয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ দেখভাল করে। এটি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখার কথা। জায়গায় দ্রুত সংস্কার না করা হলে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আসবে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিও খুব একটা কার্যকর হবে না। আর্থিক খাতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যবস্থা নেয়, কিন্তু প্রতিরোধে তাদের ভূমিকা খুবই কম। অথচ প্রতিরোধেই সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া উচিত ছিল। এটি খুব বেশি স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নয়। বাংলাদেশের আর্থিক খাতের যে অবস্থা, বিশেষ করে নন-পারফর্মিং লোন যেভাবে দিন দিন বেড়ে চলেছে, সেগুলো কমানো এবং আর্থিক খাতের ওপর পূর্ণ সুপারভাইজরি নিয়ন্ত্রণ যেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর থাকে সেদিকে সরকারের মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।


বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে বিদ্যমান অস্থিরতা নিরসনে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

চার-পাঁচ বছর বা আরো বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারকে ম্যানেজ করে আসছে, তা সঠিক ছিল না। টাকার মূল্যকে বাংলাদেশ ব্যাংক কৃত্রিমভাবে একটি জায়গায় ধরে রেখেছিল। অনেক ক্ষেত্রেই মুদ্রা অতিমূল্যায়িত হয়েছিল। যখন সংকট দেখা দিল তখন তারা আর ডলারের বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। আমাদের মতো দেশের জন্য মুদ্রা বিনিময় হার পুরোপুরি ভাসমান করা যথার্থ বলে মনে করি না। এটা ম্যানেজড ফ্লোটিংয়ে থাকা উচিত। আমি সবসময়ই বলি যে আমাদের মুদ্রা বিনিময় হার নীতির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত দীর্ঘমেয়াদে ফ্লেক্সিবিলিটি এবং স্বল্পমেয়াদে স্থিতিশীলতা অর্জন করা। বাংলাদেশ ব্যাংক পুরোটা সময়ই টাকার মান স্থিতিশীল করে রেখেছে। যে কারণে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট অতিমূল্যায়িত হয়েছে এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অনেকটা হারিয়েছে। ফলে সংকটের সময় সেটাকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি। অদক্ষ আর্থিক খাতও এর সুযোগ নিয়েছে। ব্যাংকগুলোর স্পেকুলেটিভ আচরণ দেখা গেছে, যার ফলে টাকা অনেক বেশি অবমূল্যায়িত হয়েছে। বর্তমান গভর্নর ব্যাংকগুলোর সহায়তায় ডলারের চারটা দর নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তাতে কিছুটা শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে বটে, কিন্তু চারটা দর গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বাজারে বিভিন্নভাবে বৈষম্য তৈরি করে। চারটা দরকে অবশ্যই ইউনিফায়েড করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে তারা সহসাই মুদ্রা বিনিময় হার একীভূত করবে এবং এর বাজার ব্যবস্থাপনায় আরো মনোযোগ দেবে। আমি এখনো বলব, বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে এক্সচেঞ্জ রেট ম্যানেজ করছে, সেখানে তাদের আরো সক্ষমতা দেখানোর সুযোগ রয়েছে। মুদ্রার বিনিময় হার পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দেয়ার জন্য যারা বলে আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। আর্থিক খাত উন্নত না হলে ফ্রিলি ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট অ্যাডপ্ট করার কোনো সুযোগ থাকে না। আমি নিজে পিএইচডি গবেষণা করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের মুদ্রার সংকট বিশ্লেষণ করেছি। সেখানে একটা বিষয় দেখেছি, যেসব দেশের আর্থিক খাত ভঙ্গুর সেসব দেশ কখনই ফ্রিলি ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট মেইনটেইন করতে পারেনি। এটা করতে গিয়ে উল্টো সংকট তৈরি হয়েছে। বিনিময় হারের ক্ষেত্রে আইএমএফ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে যে স্ট্যাবিলাইজেশন নীতিগুলো নিয়েছে, তার অধিকাংশই ব্যর্থ হয়েছে। সুতরাং, এখানে হোম গ্রোন নীতিটা গুরুত্বপূর্ণ। ম্যানেজড ফ্লোটিং অবশ্যই করতে হবে এবং মার্কেটের সঙ্গে অ্যালাইনড করার জন্য ধীরে ধীরে এগোতে হবে। আজ বাংলাদেশে যদি মুদ্রার বিনিময় হার পরিপূর্ণভাবে বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে ডলারের দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। যেটা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে হয়েছে। সেদিক থেকে আমরা ভালোই ম্যানেজ করছি বলব। তবে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে দুটি বিষয়ে: বিনিময় হার ম্যানেজ করতে গিয়ে আমাদের যেমন একদিকে রিজার্ভকে ধরে রাখতে হবে, তেমনি অন্যদিকে বিনিময় হার যেন অ্যাকসেসিভ ভোলাটিলিটি শো না করে তাও খেয়াল রাখতে হবে। দুটোর মাঝামাঝি থেকে বিনিময় হার ম্যানেজ করতে হবে। এজন্য বিনিময় হার ম্যানেজ করার টেকনিক্যাল যেসব বিষয় রয়েছে তার যথাযথ প্রয়োগ প্রয়োজন।

এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ভূমিকা আছে, সরকারেরও ভূমিকা আছে। যেমন হুন্ডিটা বন্ধ করতে হবে। কালোবাজারে ডলার বিক্রি বন্ধ করতে মানি এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো বন্ধ করে দেয়া দরকার। এগুলোই হচ্ছে বাজারে মেজর সোর্স অব ইনস্ট্যাবিলিটি। সেক্ষেত্রে বর্তমান গভর্নর বলেছেন সব ব্যাংককে ডলার বিক্রি করার সুযোগ দেয়া হবে। সে পদক্ষেপ তারা নিতে পারেন, তাতে ভালোই হবে। কারণ মানি এক্সচেঞ্জের ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ খুব কম থাকে। কালোবাজারের সঙ্গে তারাই জড়িত। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করা, বাজারের অবকাঠামো উন্নত তদারকি বাড়াতে হবে। আইএমএফ ইকুইলিব্রিয়াম মার্কেট এক্সচেঞ্জ রেট নির্ধারণের ক্ষেত্রে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট ব্যালেন্সিং অ্যাপ্রোচ অ্যাপ্লাই করে। বাংলাদেশের জন্য এটা সঠিক পদ্ধতি না বলে আমি মনে করি, বিশেষ করে সংকটের সময়। আমাদের আমদানি অনেক বেশি, রফতানি কম, রেমিট্যান্স দোদুল্যমান। আইএমএফের নীতি অনুসরণ করতে গেলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অনেক অস্থিরতা দেখা দেবে। বরং আমাদের বিহেভিয়ারাল ইকুইলিব্রিয়াম এক্সচেঞ্জ রেটকে দেখা উচিত। যেটা দেখে অন্যান্য ইকোনমিক ফান্ডামেন্টালসের সঙ্গে অ্যালাইনড করে এক্সচেঞ্জ রেটটাকে ডিটারমাইন করা যায়। সেটা যদি ব্যাংকগুলো অনুসরণ করতে পারে, তবে সুফল মিলবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংককে তদারকির দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে দিতে হবে।


বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণে মুদ্রানীতি কি কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে?

মুদ্রানীতির কিছুটা ভূমিকা আছে। বিনিময় হার যদি ইকুলিব্রিয়াম রেটের কাছাকাছি রাখা যায় তাহলে কিছুটা উপকার পাওয়া যেতে পারে। যদিও আমি মনে করি না বাংলাদেশের মতো দেশে শুধু বিনিময় হার দিয়ে ব্যালান্স অব পেমেন্টকে খুব বেশি নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ আছে বা এটাকে ভায়েবল করার সুযোগ আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণপত্র খোলায় তদারকি বাড়িয়েছে। তারা ওভার ইনভয়েসিং, আন্ডার ইনভয়েসিং নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, বিলাসপণ্যের আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে- এগুলো প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এতে আমদানি কমে এসেছে। এখন একটা সংকটকালীন মুহূর্ত চলছে, সংকটের সময় যেকোনো ধরনের ব্যবস্থাই গ্রহণযোগ্য। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে আমদানি আরো কমানো যেতে পারে। আমাদের খুব উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হবে, তা নয়। গড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারাটাই সময়ের জন্য যথেষ্ট। অর্থনীতির কাঠামো শক্তিশালী রাখার দিকে মনোযোগ দিতে হবে বেশি। ডলার রিজার্ভ ধরে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে সেগুলো ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি সরকারকে সাশ্রয়ীমূলক পদক্ষেপ নিতে হবে। [বাকি অংশ আগামীকাল]

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন