পূর্বাঞ্চলে বন্ধ থাকা অর্ধশতাধিক স্টেশন চালু করছে রেলওয়ে

সুজিত সাহা চট্টগ্রাম ব্যুরো

চালুর অপেক্ষায় বন্ধ থাকা চট্টগ্রামের মিরসরাই রেলস্টেশন ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চালু হচ্ছে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের অর্ধশতাধিক স্টেশন। লোকবল সংকটে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর যাত্রীসেবার মান ট্রেনের সময়ানুবর্তিতা বাড়াতে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তিন ধাপে বি-ক্যাটাগরির এসব স্টেশন চালুর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে রেলওয়ে। প্রথম পর্যায়ে ২১টি স্টেশন, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৯টি সর্বশেষ তৃতীয় ধাপে চালু করা হবে আটটি স্টেশন।

বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, লোকবল সংকটে ধুঁকতে থাকা রেলওয়ে প্রথম স্টেশন বন্ধ করে ২০০১ সালে। সেটি ছিল চট্টগ্রাম-গঙ্গাসাগর সেকশনের মস্তাননগর স্টেশন। তৎকালীন সরকার রেলওয়েকে বাণিজ্যিকীকরণের চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি নিয়োগ বন্ধ করে দিলে বি-শ্রেণীর স্টেশনগুলোতে ধারাবাহিকভাবে লোকবল সংকট শুরু হয়। স্টেশনের সঙ্গে যুক্ত লোকবল অবসরে গেলেই শূন্য পদে নিয়োগ কিংবা বদলি বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে ২০২২ সাল পর্যন্ত পূর্বাঞ্চলে একে একে ৪৭টি বি-শ্রেণীর একটি ডি-শ্রেণীর স্টেশন বন্ধ করে দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এতে যাত্রাপথে ট্রেনের সময়ক্ষেপণের পরিমাণ বেড়ে গেছে। স্থানীয়রা এসব স্টেশন ব্যবহার করতে না পারায় রেলের রাজস্ব আয়েও পড়েছে বিরূপ প্রভাব। তাছাড়া একটি দীর্ঘ রেলপথের মাঝে একাধিক স্টেশন বন্ধ থাকায় ট্রেন দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়েছে। কারণে রেলের সার্বিক সেবা কার্যক্রম বাড়াতে দুই যুগের বেশি সময় ধরে বন্ধ থাকা স্টেশনগুলো চালুর উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে।

রেলের পরিবহন বিভাগের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি স্টেশন বন্ধ করা হয়েছে ২০২২ সালে, মোট সাতটি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছয়টি করে স্টেশন বন্ধ করা হয়েছিল ২০১০ ২০১৩ সালে। এছাড়া ২০০৯ ২০১১ সালে পাঁচটি করে, ২০১৪ সালে চারটি, ২০২০ সালে তিনটি স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ২০১৮, ২০১৯ ২০২১ সালে দুটি করে এবং ২০০১, ২০০৩, ২০০৮ ২০১৭ সালে একটি করে স্টেশন বন্ধ করে দিয়েছিল রেলওয়ের পরিবহন বিভাগ। যদিও আখাউড়া-সিলেট-ছাতকবাজার সেকশনের ছাতকবাজার স্টেশন (বি-ক্লাস) লাকসাম-চাঁদপুর সেকশনের মধুরোড (ডি-ক্লাস) স্টেশন দুটি ঠিক কোন সময়ে বন্ধ করা হয়েছিল, সে বিষয়ে তথ্য দিতে পারেনি রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। 

বন্ধ হওয়া স্টেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে চট্টগ্রাম-গঙ্গাসাগর সেকশনে, ১১টি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের সেকশনের বন্ধ স্টেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে বাড়বকুণ্ড, মিরসরাই, মহুরীগঞ্জ, শর্শদী, আলীশহর, নাওটি, ময়নামতি, গঙ্গাসাগর, বারৈয়াঢালা, মস্তাননগর কালীদহ। আখাউড়া-সিলেট-ছাতকবাজার সেকশনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আটটি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। সেগুলো হলো লংলা, টিলাগাঁও, ইটাখোলা, লস্করপুর, ভাটেরাবাজার, আফজালাবাদ, খাজাঞ্চিগাঁও, ছাতকবাজার। এছাড়া ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ বাজার সেকশনেও আটটি, আখাউড়া-ঢাকা ভৈরববাজার-ময়মনসিংহ সেকশনের চারটি করে, লাকসাম-চাঁদপুর সেকশনে তিনটি, ময়মনসিংহ-ঝারিয়াঝাঞ্জাইল-মোহনগঞ্জ সেকশনের দুটি, চট্টগ্রাম-নাজিরহাট সেকশনের দুটি, লাকসাম-নোয়াখালী সেকশনের দুটি, জামালপুর টাউন জংশন-বঙ্গবন্ধু সেতুর (পূর্ব) তিনটি স্টেশন বন্ধ রয়েছে। 

সর্বশেষ ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর চট্টগ্রাম-নাজিরহাট সেকশনের ঝাউতলা স্টেশনটি বন্ধ করে দিয়েছিল রেলওয়ের পরিবহন বিভাগ। তীব্র লোকবল সংকটের কারণে চট্টগ্রাম-চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম-নাজিরহাট রুটের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বলে জানিয়েছে রেলওয়ে-সংশ্লিষ্টরা। 

পরিবহন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, একটি বি-ক্লাস স্টেশনে ন্যূনতম তিনজন স্টেশনমাস্টার থাকা বাধ্যতামূলক। যদিও রেলের এখন পর্যন্ত বিভিন্ন স্টেশনে শুধু একজন মাত্র মাস্টার দিয়ে স্টেশন চালাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে একটি স্টেশন পরিচালনায় ন্যূনতম তিনজন স্টেশনমাস্টারের পাশাপাশি তিনজন পয়েন্টসম্যান (পি-ম্যান), একজন পোর্টার, একজন বুকিং সহকারী, তিনজন গেটকিপার (কম গুরুত্বপূর্ণ গেট হলে তিনজনের কমও হতে পারে) থাকা অত্যাবশ্যকীয়। শুধু একজন বুকিং সহকারী কিংবা একজন সহকারী স্টেশন থাকলে ডি-ক্লাস স্টেশনটি চালু বলে গণ্য হবে। 

রেলওয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবহন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, লোকবল সংকটের কারণে রেলওয়ের স্টেশন বন্ধ থাকায় যাত্রীসেবার মান কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে স্টেশন বন্ধ থাকার কারণে ট্রেন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ছাড়াও স্টেশনে থাকা রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ চুরির ঘটনা বাড়ছে। তাই রেলওয়েকে ঝুঁকিমুক্ত যাত্রীবান্ধব করতে যেকোনো উপায়ে দ্রুত বন্ধ স্টেশন চালু করা উচিত বলে মনে করেন তিনি। 

এদিকে প্রধান প্রকৌশলীর পক্ষ থেকে বন্ধ স্টেশন চালুর বিষয়ে সর্বশেষ ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর চিঠি দেয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই গত ১২ ডিসেম্বর রেলওয়ের পরিবহন বিভাগের পক্ষ থেকে গুরুত্ব বিবেচনায় তিন ধাপে ৪৮টি স্টেশন চালু করার প্রস্তাব দেয়া হয়।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে ৫৫৭ জন সহকারী স্টেশনমাস্টার নিয়োগ দেয়া হয়েছে। শূন্য পদ পূরণে শিগগিরই আরো বিপুল পরিমাণ সহকারী পর্যায়ের স্টেশনমাস্টার নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করছে রেলওয়ে। তাছাড়া পূর্বাঞ্চল রেলের বিভিন্ন সেকশনে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে অনেক স্টেশনের কার্যক্রম পুরোপুরি চালু করতে না পারলেও সাম্প্রতিক সময়ে এসব প্রকল্পের কাজও শেষ পর্যায়ে। তাই ওই স্টেশনগুলো চালু নতুন নতুন ট্রেনের মাধ্যমে রেলের প্রান্তিক পর্যায়ের যাত্রীসেবা শুরু করতে চাইছে পরিবহন বিভাগ। 

বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, লোকবল সংকটের কারণে রেলের বিভিন্ন স্টেশন দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে সরকার রেলের উন্নয়নে নানামুখী প্রকল্প বাস্তবায়নের পাশাপাশি লোকবল নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করেছে। পূর্বাঞ্চলে রেলপথের একাধিক প্রকল্পের কাজ শেষ পর্যায়ে চলে আসায় বন্ধ স্টেশনগুলো চালু করা হবে। আর সেগুলো চালু হলে সেবার মান বৃদ্ধির পাশাপাশি রেলের রাজস্ব আয়ও বাড়বে বলে আশা করা যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন