ধানমন্ডি লেকের বাণিজ্যিকীকরণে লাভবান হচ্ছেন প্রভাবশালীরা ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ

আল ফাতাহ মামুন

ধানমন্ডি লেকের পাশে গড়ে তোলা রেস্টুরেন্ট ছবি: মাসফিকুর সোহান

যানজট আর জনাকীর্ণতায় বিপর্যস্ত রাজধানীবাসীর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার জায়গা দেশের প্রথম আরবান ডিজাইন প্রজেক্ট ধানমন্ডি লেক। তরতাজা সকাল কিংবা আনন্দমুখর সন্ধ্যা কাটাতে নগরবাসী ছুটে আসে এখানে। কিন্তু সম্প্রতি কয়েক বছরে লেকের পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়েছে আরো বেশি। দেশী-বিদেশী বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, রাজধানীর লেকগুলোর মধ্যে ধানমন্ডি লেকেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাণিজ্যিক পরিধি বৃদ্ধিই এমন ভয়াবহতার কারণ। আবার এমন অতিবাণিজ্যিকীকরণে সরকার নয়, লাভবান হচ্ছে প্রভাবশালী মহল। ধারা চলতে থাকলে অচিরেই ধানমন্ডি লেক ভ্রমণের বদলে কেনাকাটার স্পটে পরিণত হবে।

দেশের প্রথম পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থার অংশ হিসেবে ১৯৫৬ সালে লেকসহ ২৪০ দশমিক ৭৪ হেক্টর জমিতে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। ধানমন্ডি এলাকার প্রায় ১৬ শতাংশ জুড়ে রয়েছে লেক। ১৯৯৮-২০০১ সালে ধানমন্ডি লেক এলাকাটি সংস্কার করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। লেকের পুরো অংশে রয়েছে ওয়াকওয়ে, নির্দিষ্ট অংশজুড়ে রয়েছে প্লাস্টিকের প্যাডেল বোট চালানোর সুবিধা। এছাড়া রয়েছে তিনটি ছোট ছোট দ্বীপসহ পাঁচটি ব্রিজ।

কিন্তু নগর বিশ্লেষকরা বলছেন, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি বাণিজ্যিক হয়ে পড়েছে লেক এলাকা। বেড়েছে দোকানপাট পার্কিং জোন। এমন বাণিজ্যিকীকরণে দিনে দিনে লেকের সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে পরিবেশেরও। বিষয়টা নজর এড়ায়নি স্থানীয় বাসিন্দা ফারজানা কবিরেরও। তিনি বলেন, আগে লেকের পাড়ে হাঁটতে এলে মন ভালো হয়ে যেত। আর এখন চারদিকে দোকান, হকার, অব্যবস্থাপনা ইত্যাদি মিলে লেকের আগের সৌন্দর্য আর নেই।

নগরবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, একটি পরিকল্পিত লেক নির্মাণের লক্ষ্য ছিল আমাদের। এখানে আমরা কিছু দোকান রেখেছিলাম, পার্কিং এলাকা রেখেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) লেক এলাকাটিকে এত বেশি বাণিজ্যিক চোখে দেখছে যে এখন দোকান আর পার্কিং স্পেসে তা ঘিঞ্জি হয়ে পড়েছে। ফলে যে উদ্দেশ্যে লেক নির্মাণ করা হয়েছিল তা ব্যর্থ হচ্ছে। বিষয়ে আমাদের কথা কানেই তুলছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

ধানমন্ডি লেককে মোট সাতটি সেক্টরে ভাগ করে ইজারা দিচ্ছে ডিএসসিসি। ধানমন্ডি ২৭ নম্বর (নতুন ১৬) সড়ক থেকে ধানমন্ডি ৩২ (নতুন ১১) নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত এলাকাটি নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে সাম্পান নামে একটি ফুড কোর্ট আটটি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (নতুন ১১) সেতু থেকে মিরপুর রোডের শেখ রাসেল স্কয়ার হয়ে কলাবাগান মাঠের উত্তর সীমানা পর্যন্ত এলাকাটি নম্বর সেক্টর। এখানে বজরা নামে একটি ফুড কোর্ট, ৩০টি পার্কিংয়ের জায়গা, একটি গণশৌচাগার এবং শেখ রাসেল শিশু পার্ক রয়েছে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (নতুন ১১) সেতু থেকে ধানমন্ডি ১৬ (নতুন ১২/) নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত নম্বর সেক্টর। সেক্টরে একটি ফুড কোর্ট, ২০টি ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, দুটি গণশৌচাগার, একটি স্কেটিং ক্লাব রয়েছে। ধানমন্ডি ১৬ নম্বর সড়কের (নতুন ১২/) লেকের পশ্চিম দিকের সংযুক্ত সড়ক থেকে ধানমন্ডি নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত নম্বর সেক্টর। সেক্টরে ডিঙ্গি নামে একটি ফুড কোর্ট রয়েছে। রয়েছে ছয়টি পার্কিংয়ের জায়গা। নম্বর সেক্টরে পানশী নামে একটি রেস্টুরেন্টসহ ২০টি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি নম্বর সেতু থেকে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পেছনের প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত সেক্টর। ধানমন্ডি নম্বর সেতু থেকে ধানমন্ডি নম্বর সড়কের লেকের পূর্ব অংশ পর্যন্ত লেকের নম্বর সেক্টর। সেক্টরে তরী নামে একটি ফুড কোর্ট, একটি গণশৌচাগার, ১২টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি নম্বর সড়কের সেতু থেকে সাত মসজিদ সড়কের দুটি অংশ তথা সুগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারের বিপরীত পাশ পর্যন্ত এবং বিজিবি ফটক থেকে বিপরীত পাশ পর্যন্ত এলাকাটি নম্বর সেক্টর। সেক্টরের আয়তন অন্যান্য সেক্টর থেকে অনেক বড়। এখানে পাঁচটি ফুড ভ্যান, দুটি ফুড কোর্ট, ৩২টি পার্কিংয়ের জায়গা একটি গণশৌচাগার রয়েছে।

বর্তমানে এসব সেক্টরে রেস্টুরেন্ট পার্কিং জোনের পরিধি বাড়িয়ে ইজারা দিচ্ছে ডিএসসিসি। স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, আমাদের পরিকল্পনা ছিল ধানমন্ডি লেকের মাত্র শতাংশ ক্যাফেটেরিয়া রেস্টুরেন্ট হবে। কিন্তু ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ এটাকে ১২ থেকে ১৫ শতাংশে বর্ধিত করেছে। একটি পার্ক বা লেকে কখনই শতাংশের বেশি দোকান রাখার নিয়ম নেই। ডিএসসিসির বাণিজ্যিক কার্যক্রম সে শর্তও ভেঙে দিয়েছে।

ধানমন্ডি লেকের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বৃদ্ধির প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানা যায়, মূল নকশায় নম্বর সেক্টর ছিল আয়হীন। দুই সেক্টর থেকে আয় করার কোনো পরিকল্পনা রাখেননি স্থপতিরা। বাকি পাঁচটি সেক্টরের মধ্যে কেবল পানশী ছিল বড় আকারের রেস্টুরেন্ট। বাকি চারটি সেক্টরে ছিল ছোট ছোট ক্যাফেটেরিয়া। ছিল ব্যায়ামাগার স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র। সবকিছুই এখন হয়ে গেছে খাবারের বড় বড় দোকান।

নির্বিচারে পার্ক লেকের বাণিজ্যিকীকরণ গণবিরোধী কার্যক্রম মন্তব্য করে নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মাদ খান বণিক বার্তাকে বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় অসংখ্য খাবারের দোকান থাকার পরও সিটি করপোরেশনের কী প্রয়োজন পড়ল আরো খাবারের দোকান বরাদ্দ দেয়ার? কয়েক বছর আগেও রবীন্দ্রসরোবর এলাকায় মানুষজন স্বস্তিতে হাঁটতে পারত। এখন সেখানে অগণিত খাবারের দোকান। এমনকি এলাকাবাসী সিটি করপোরেশনের কাছে দাবি জানিয়েছে, যে টাকায় দোকান বরাদ্দ দিয়েছে সেটা তারা চাঁদা তুলে দিয়ে দেবে। আসলে মানুষ পার্কে যায় সবুজ, নির্মল কোলাহলমুক্ত পরিবেশের জন্য। সিটি করপোরেশনের কাজ গণপরিসরগুলোতে উদ্যান উন্মুক্ত স্থানের যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করা। কিন্তু তারা গণপরিসরের বাণিজ্যিকায়ন করছে। এটা খুবই গণবিরোধী এবং গণপরিসরের আদর্শ টেকসই ব্যবহার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পাবলিক স্পেস বা গণপরিসর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য নয়। গণপরিসর হলো সাধারণ মানুষের নিজের মতো করে সময় কাটানোর জায়গা। এটা সিনেমা হল না যে এটাকে বাণিজ্যিক বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করতে হবে। গণপরিসরের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নষ্ট করে বাণিজ্যিক ব্যবহারের কারণে ওই এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা নানা সমস্যায় পড়ে। সিটি করপোরেশনকে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।

ধানমন্ডি লেকের বাণিজ্যিক পরিধি বাড়ালেও বকেয়া ইজারার টাকা তুলতে পারছে না ডিএসসিসি। স্থানীয় সরকার বিভাগের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের হিসাবসংক্রান্ত কমপ্লায়েন্স অডিট প্রতিবেদনে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ধানমন্ডি লেকের আয় নিয়ে আপত্তি তুলেছে কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বাংলাদেশ (সিএজি) অডিট প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত লেকের সাতটি সেক্টর ইজারা দিয়ে মোট কোটি ১৮ লাখ ৩২ হাজার ৪৬৯ টাকা উঠেছে। কিন্তু পুরো টাকাটি সিটি করপোরেশনের মূল অ্যাকাউন্টে জমা করা হয়নি এবং বাজেটেও প্রদর্শন করা হয়নি। এটিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম বলে উল্লেখ করা হয়েছে নিরীক্ষা প্রতিবেদনে। বর্তমানে ইজারাদারদের তালিকায় রয়েছেন কাউন্সিলরের স্বজনসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. রাসেল সাবরিন বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে লেকের ইজারা মূল্য বাবদ ১০ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে। নিয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট মামলাও করেছি আমরা। তবে নতুন করে যাদের ইজারা দেয়া হয়েছে তাদের টাকা নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। বর্তমানে ইজারা মূল্য আগেই পরিশোধের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

বাণিজ্যিক পরিধি বৃদ্ধির ফলে ইজারাদাররা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ধানমন্ডির পরিবেশ। ঢাকার যতগুলো লেক আছে এর মধ্যে ধানমন্ডি লেকে দূষণ বেশি হচ্ছে। লেকের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতিও বেশি। ঢাকার বিভিন্ন লেকের পানির পরিবেশ নিয়ে গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের তিনজন শিক্ষক। গবেষক দলের সদস্য ফাহমিদা পারভীন বণিক বার্তাকে বলেন, ঢাকার লেকগুলোর মধ্যে ধানমন্ডি লেকের পানিতেই মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। এর অন্যতম কারণ, লোকসমাগম। তাছাড়া বেশি খাবারের দোকানের কারণেও লেকের পরিবেশ নষ্ট হয়েছে। মানুষ কিছু খাবারের উচ্ছিষ্টাংশ লেকে ফেলে দিচ্ছে। এখানে খাবারের দোকানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। এটা সিটি করপোরেশনেরই দায়িত্ব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন