সময়ের ভাবনা

পাঠ্যপুস্তকে ‘বিবর্তনবাদ বিতর্ক’: প্রাসঙ্গিক ভাবনা

শানজিদ অর্ণব

সমাজ, রাষ্ট্র, পেশা, ব্যক্তিজীবন, মোবাইল ফোন—সবকিছুরই বিবর্তন আছে। আর সেটা মেনে নিতে আমাদের কারোর আপত্তিও থাকে না। আমরা চোখের সামনেই দেখেছি ফিচার ফোনের স্মার্টফোন হয়ে ওঠা। আমরা এমন সব বিবর্তনে মানিয়েও নিচ্ছি। এসবই বিজ্ঞান তথাপ্রযুক্তির বিকাশ ও বিবর্তনের ফসল। তবে জীবতাত্ত্বিক বিবর্তনের বিষয়টি এমন সহজ নয়। এ বিষয়টি মানুষের চিরায়ত বিশ্বাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে বিতর্ক কখনো এর পিছু ছাড়েনি। বর্তমানে ২০২৩ সালের জন্য দেশের ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ ও অনুশীলন বই দুটিতে বিবর্তনবাদ সংক্রান্ত আলোচনা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। 

বছরের শুরুতে মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্ক ইদানীং নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কখনো লেখকদের অন্তর্ভুক্তি কিংবা কোনো লেখক বা লেখককুলের বাদ পড়া, কখনো ভুল তথ্য, বেমানান ছবি হয়ে উঠছে বিতর্কের বিষয়। বিতর্কের তালিকায় এ বছর অবশ্য নতুন করে যুক্ত হয়েছে ইতিহাস বয়ানের উদ্দেশ্য। আরো আছে বিদেশী শিক্ষামূলক সাইট থেকে হুবহু অনুবাদের অভিযোগ। সবকিছু ছাপিয়ে এখন পুরনো একটি বিতর্ক নিয়ে উত্তাপ বাড়ছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ ও অনুশীলন বই দুটিতে বিবর্তনবাদ সংক্রান্ত আলোচনা। অবশ্য এ মতবাদ নিয়ে বিতর্ক শুধু এ দেশে নয়, দুনিয়ার অনেক দেশেই হয়েছে ও হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান ও তত্ত্বে বিবর্তনবাদ শক্তিশালীভাবে আবির্ভূত হয় উনিশ শতকে ব্রিটিশ ন্যাচারালিস্ট চার্লস ডারউইনের গবেষণালব্ধ গ্রন্থ প্রকাশের পর। 

তার পর থেকে বিবর্তনবাদ নিয়ে গবেষণা কিংবা বিতর্ক কোনোটিরই অভাব হয়নি। এর আগে আরো উপরের শ্রেণীতে বিবর্তনবাদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে বিতর্ক হয়েছে, তবে এবার ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ ও অনুশীলন বই দুটিতে যথাক্রমে ‘মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?’ এবং ‘খুঁজে দেখি মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস’ অংশটুকু দেশে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। দেশে পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘ডারউইনের বিবর্তনবাদ বাদ দিতে হবে’—এমন বক্তব্য (দাবি) এর আগে বিভিন্ন মহল থেকে জোর গলায় উত্থাপন করা হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে বিবর্তনবাদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মহলেও কঠোর সমালোচনা, নিন্দামন্দ করা হচ্ছে। 

বিবর্তনবাদ নিয়ে সমালোচনায় একটি সরল বাক্য ব্যবহৃত হতে দেখা যায় যে এ মতবাদে বলা হয়েছে ‘মানুষ এসেছে বানর থেকে’। যদিও বৈজ্ঞানিক তত্ত্বে বিষয়টি ঠিক এমন নয়। ষষ্ঠ শ্রেণীর ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ গ্রন্থের ‘মানুষ ও সমাজ এলো কোথা থেকে?’ অংশে লেখা হয়েছে—‘অনেকে বলেন, মানুষের উদ্ভব হয়েছে নাকি বানর থেকে। এ কথা ভুল।’ আরেক জায়গায় বলা হয়েছে—‘তোমাদের মনে রাখতে হবে, বানর বা শিম্পাঞ্জি থেকে মানুষের উদ্ভব হয়নি।’ এছাড়া, মানুষের বিবর্তন যে একটি রহস্যময় বিষয় সেটিও শিক্ষার্থীদের অবগত করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক শ্রেণীকরণের পরিপ্রেক্ষিত থেকে মানুষের প্রজাতি নিয়ে আলোচনা আছে যা দুনিয়ার যেকোনো প্রান্তেই একাডেমিক চর্চার স্বীকৃত পদ্ধতি। 

বিবর্তনবাদ বলতেই ‘বানর থেকে মানুষ’—এমন একটি ধারণা দুনিয়াতে বদ্ধমূল হয়ে আছে, যা সঠিক নয়। ডারউইনের ডিসেন্ট অব ম্যান গ্রন্থটি প্রকাশের পর ১৮৭১ সালে দ্য হরনেট ম্যাগাজিনে ডারউইনকে ওরাং-ওটাংয়ের আদলে এঁকে কার্টুন প্রকাশিত হয়। চার্চ-সমাজ কেউই ডারউইনকে সমালোচনা করতে পিছপা হয়নি। কিন্তু এ যুগে এসে খ্যাতনামা বিজ্ঞানীদের অনেকে বলেন, বিবর্তনবাদ ছাড়া জীববিদ্যা চর্চা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, এ মতবাদ কোনো প্রমাণিত সত্য নয়। তবে বিশ্বে বিবর্তনবাদের আলোকে গবেষণা যে থেমে নেই সেটাও সত্য। 

সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ডারউইনের মতবাদ আগে ওপরের শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো। বিশেষ করে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের। কিন্তু আপত্তিটা এবার নতুন শিক্ষাক্রমে তা ষষ্ঠ শ্রেণীতে নিয়ে আসা নিয়ে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সূত্র বণিক বার্তাকে জানিয়েছে, নতুন শিক্ষাক্রমের ভুলত্রুটি নিয়ে এরই মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে ডারউইনের মতবাদ ষষ্ঠ শ্রেণীতে রাখা, না-রাখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে অনেকে বিষয়টি পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। সূত্রটি আরো জানিয়েছে, যেহেতু ভুলত্রুটি সংশোধনে কমিটি করা হচ্ছে, তাই কোনো কিছু বাদ দেয়া হলে সেটি করা হবে কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে। 

আজকের যেকোনো বিজ্ঞান শিক্ষার্থী জীববিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে গেলে তাকে বিবর্তনবাদ নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। পাশ্চাত্যের নামি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গেলে তো অবশ্যই। আর এ ইন্টারনেটের যুগে পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ দিলেই কোনো বিষয় শিক্ষার্থীরা জানবে না এমন ধারণা নিশ্চয়ই বাস্তবসম্মত নয়। তবে কোন শ্রেণীতে শিক্ষার্থীর জন্য কোন বিষয়টি চর্চা প্রয়োজন তা নিয়ে অবশ্যই তর্ক-বিতর্ক হতে পারে। এক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের নিয়ে টিম গঠন করে মতামত নেয়া যেতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কিংবা কোনো মহল থেকে দাবি উঠলেই সে মতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে এমন চর্চা চালু হলে তা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না। শিশুদের জন্য একটি আধুনিক ও মানসম্মত পাঠ্যক্রম তৈরির গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, আমরা আজ বিশ্বায়নের যুগে বাস করি। শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক প্লাটফর্মে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর সেটা উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা ছাড়া অসম্ভব। পাঠ্যপুস্তক নিয়ে প্রতি বছরই নানা ইস্যুতে যে বিতর্ক তৈরি হচ্ছে তা শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের জন্য ক্ষতিকর, আমাদের সমাজ-রাষ্ট্রের জন্যও এ অবস্থা সুখকর কিছু নয়। এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কমিটি তৈরি করে দীর্ঘমেয়াদে উপযুক্ত পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি।   


শানজিদ অর্ণব: লেখক ও অনুবাদক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন