খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন ও মজুদের খসড়া আইন

নওগাঁর চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ক্ষোভে ফুঁসছেন

আরমান হোসেন রুমন, নওগাঁ

খাদ্য উৎপাদন ও মজুদের সংশোধিত খসড়া আইন নিয়ে উদ্বিগ্ন চালকল মালিক ও ব্যবসায়ীরা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২২-এর খসড়ায় সম্প্রতি অংশীজনের মতামত চেয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে -মেইলে -সংক্রান্ত মতামত পাঠাবেন সারা দেশের চালকল মালিক ব্যবসায়ীরা। সংশোধিত আইনের খসড়ায় অবৈধ মজুদের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডসহ বিভিন্ন কঠোর শাস্তির প্রস্তাব দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। এতে ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন খোদ খাদ্যমন্ত্রীর এলাকা নওগাঁর চালকল মালিক ব্যবসায়ীরা। আইনটি কার্যকর হলে দেশীয় চালকল শিল্প হুমকির মুখে পড়বে এমন দাবি সংশ্লিষ্টদের।

জানা যায়, খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন নিয়ে গুঞ্জন চলে আসছিল বেশ কয়েক বছর ধরেই। সব গুঞ্জন কাটিয়ে গত বছরের ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে নীতিগতভাবে খসড়া আইনটির অনুমোদন দিয়ে যাচাইবাছাইয়ের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের বিদ্যমান দুটি আইন মিলিয়ে খসড়া আইনটি তৈরি করা হয়। সম্প্রতি গত ১৯ জানুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে আইনের সংশোধিত খসড়া প্রকাশ করা হয়। এর ওপর ২৯ জানুয়ারির মধ্যে অংশীজনের মতামত চেয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। যেখানে সারা দেশের ধান্য-চাউল কল মালিক চাল ব্যবসায়ীরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ মতামত পাঠাতে পারবেন।

প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, সরকার নির্ধারিত সীমার বাইরে খাদ্য মজুদ করা বা মজুদসংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা লঙ্ঘন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। অপরাধে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড হতে পারে এবং জরিমানাও করা হবে। তবে কেউ যদি প্রমাণ করতে পারেন যে আর্থিক সুবিধার জন্য খাদ্য সংরক্ষণ করেননি, তাহলে জরিমানাসহ সর্বোচ্চ তিন মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

আইনের অধীন শ্রমিক, কর্মচারী, ঠিকাদার, মিলমালিক, ডিলার বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন বা -সংক্রান্ত কোনো কর্মসম্পাদনে নিজে বিরত থাকিলে বা সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার কর্তব্য পালনে বিরত থাকিতে বাধ্য বা প্ররোচিত করিলে বা তাহাদের মধ্যে অসন্তোষ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিলে, উহা হইবে একটি অপরাধ। এই অপরাধে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড হতে পারে। বর্তমান আইনে অপরাধে সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড বা হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে।

সরেজমিন নওগাঁর আড়তদার পট্টি ঘুরে জানা যায়, গত ১৯ জানুয়ারি -সংক্রান্ত খসড়া মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার পর থেকেই মিলমালিক আড়তদারদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। -সংক্রান্ত মতামত পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে এরই মধ্যে জেলা চালকল মালিক গ্রুপ, অটোমেটিক রাইস মিল অনার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং ধান আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের মাঝে কয়েক দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। -সংক্রান্ত মতামত পাঠাতে একটি সংশোধিত খসড়াও প্রস্তুত করেছেন তারা। সে খসড়া নিয়ে ঢাকায় আইনজীবীদের কাছেও ছুটছেন সংগঠনের নেতারা।

মৌ এগ্রো অটোমেটিক রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, বর্তমান সময়ে প্রকৃত চালকল মালিকরা পুঁজি সংকটের কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী মজুদ করতে পারেন না। অথচ বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান চাল ব্যবসায় যুক্ত হওয়ার পর থেকেই অবৈধ মজুদের পাহাড় গড়ে তুলেছে। আজকের ধান-চালের বাজারে অস্থিরতার জন্যই এরাই দায়ী। তাই অবৈধ মজুদদারদের লাগাম টেনে ধরতে অবশ্যই মজুদ আইন দরকার। তবে মজুদের অপরাধে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের নজির বিশ্বের কোনো দেশে নেই।

সুমন কবিরাজ, আবু হাসান, মাহবুবুর রহমানসহ বিভিন্ন চালকল মালিক বলেন, বাজারদর মানের ওপর নির্ভর করে প্রতিদিন কম-বেশি ধান ক্রয় করি আমরা। সে ধান কেনাতেই বড় পরিসরে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। আবার অপরাধ করার পর সেখানে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও জেলজরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এমন অদ্ভুত আইন কার্যকর হলে মিলাররা ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এতে দেশীয় চালকল শিল্প ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশের কৃষকও ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। তাই আমাদের দাবি, সার্বিক দিক বিশ্লেষণ করে তারপর আইন কার্যকর করা হোক।

নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বণিক বার্তাকে বলেন, চালকল মালিকরা হালাল পথে ব্যবসা করতে এসেছেন। সে ব্যবসা করতে এসে যদি মৃত্যুদণ্ডের মতো কালো আইনের সম্মুখীন হতে হয়, তাহলে মিল চালানো সম্ভব নয়। এছাড়া বিভিন্ন অনভিজ্ঞ সংস্থাকে ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তা মোটেও কাম্য নয়। একমাত্র খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারাই আমাদের ব্যবসা তদারকি করতে পারেন। খসড়ায় উল্লিখিত কালো আইন প্রত্যাহার করে ব্যবসাবান্ধব আইন কার্যকর না হলে আগামীতে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে মাঠে নামব।

নওগাঁ জেলা ধান্য-চাউল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি নিরোদ বরণ সাহা চন্দন বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের মজুদসংক্রান্ত আইনের বেশির ভাগ ধারার সঙ্গেই আমরা একমত নই। এতে মজুদসংক্রান্ত অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। খাদ্যদ্রব্যের ব্যবসা একটি সেবামূলক পেশা। যেহেতু কার্যক্রম সরাসরি সেবার সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই সেখানে মৃত্যুদণ্ডের মতো শাস্তির বিধান কখনোই কাম্য নয়। শাস্তি হিসেবে বড় ধরনের জরিমানা কারাদণ্ড রাখা যেতে পারে। আইনে সরকার গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিষয়ে মতামত বা প্রতিবাদ করতে গেলে সেখানেও শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এটা আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ সাংবিধানিক স্বাধীনতা পুরোটাকেই খর্ব করে। আগেও -সংক্রান্ত আইন ছিল। তা নতুন করে যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তাই -সংক্রান্ত একটি সংশোধনী খসড়া তৈরি করে আমরা মতামত পাঠাচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন