বিশ্ব অর্থনীতি

উচ্চঋণগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উদ্ধার

ড্যানি রড্রিক, রেজা বাকির, ইশাক দিওয়ান

চলতি বছরটি উন্নয়নশীল বিশ্বের জন্য বিধ্বংসী হয়ে যেতে পারে। এর কারণ অনেক বেশি দেশ নিজেদের ঋণ সংকটে জর্জরিতদের দলে আবিষ্কার করছে। বেশক’টি দেশ (লেবানন, শ্রীলংকা, রাশিয়া, সুরিনাম ও জাম্বিয়া) এরই মধ্যে খেলাপিও হয়ে গেছে। এসব দেশে অর্থনৈতিক পতন এবং তীব্র দারিদ্র্য বৃদ্ধি থামাতে জরুরিভাবে ঋণ সহায়তা প্রয়োজন।

প্রচলিত ঋণ সংকটের জবাব হচ্ছে ঋণগ্রহীতা দেশ, আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা বা ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন (আইএফআই) এবং অন্য বাইরের ঋণদাতাদের সঙ্গে জটিল বিষয়ের প্যাকেজগুলো নিয়ে আলোচনা করা। অভ্যন্তরীণ বন্ডহোল্ডার, শ্রমিক ইউনিয়ন এবং অন্যরাও এতে নিজদের ভূমিকা পালন করে। কারণ তারাও নিজস্ব স্বার্থ রক্ষার্থে আছে। সব পক্ষের মধ্যে আলোচনার প্রক্রিয়াটি দীর্ঘ হতে পারে। ঋণগ্রহীতা দেশের অবস্থার অবনতি এমনভাবে অব্যাহত থাকলে ক্ষতির বৃহত্তর বোঝা অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে প্রাপ্ত ফলাফলকে নিয়ে খেলার জন্য অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক প্রচেষ্টাও রয়ে গেছে।

এক্ষেত্রে উদীয়মান বাজারগুলোয় সব পক্ষের মধ্যে আলোচনার প্রক্রিয়া আরো জটিল হয়েছে। প্রচলিত ঋণ নিষ্পত্তির ব্যবস্থায় চীন, ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ অন্য দেশগুলোর আগে কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। তাছাড়া এক্ষেত্রে সমন্বয়কে জটিল করার পাশাপাশি ঋণদাতাদের মধ্যে ভিন্নতা ধ্বংসাত্মক প্রক্রিয়ার দুয়ারকে আরো উন্মুক্ত করে দেবে। সেটা কেবল নিজেদের ইচ্ছা পূরণের প্রত্যাশার মাধ্যমে পরিচালিত হবে। যেমন হঠাৎ করে মূলধনপ্রবাহ বিপরীতমুখী হলে ব্যাংক খাতে সংকট দেখা দিতে পারে।

সব পক্ষের জন্য ঋণ সমঝোতাকে আরো কঠিন করার মূল চাবিকাঠি হলো সুবিন্যস্তভাবে সাজানো, যাতে প্রবৃদ্ধির সুযোগগুলো উন্মুক্ত হয়। এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত বড় মাপের লাভের সম্ভাবনা থাকলে অবশ্যই সব পক্ষকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে আসতে হবে। সেটার কারণ যাতে তারা নিজেদের মধ্যে এ ধরনের প্যাকেজ সুবিধাগুলো ভাগাভাগি করে নিতে পারে।

প্রবৃদ্ধিকে এগিয়ে নেবে এমন ঋণ নিষ্পত্তির জন্য ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা প্রয়োজন। এজন্য প্রবৃদ্ধির সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে ঋণগ্রস্ত সরকারগুলো বিনিয়োগ করতে পারে। যদি তাদের অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ করা হয়, তাহলে অনুৎপাদনশীল ও অকার্যকর ব্যয় কমিয়ে আনতে পারে। এখনকার ঋণদাতারা ঋণ ও ঋণ-পরিষেবা কমাতে সম্মত হবে যদি আইএফআই অর্থ দেয়। তবে ঋণদাতারা কেবল তখনই ঋণ সরবরাহ করবে যদি আইএফআই কার্যকর শর্ত প্রয়োগ করে ও নিশ্চয়তা দেয় যে ঋণগ্রহীতা সরকারগুলো যথাযথ প্রবৃদ্ধির নীতিগুলো বজায় রাখবে। ঋণের এ নতুন তরঙ্গের সঙ্গে, কিছু উপাদানের মধ্যে এ ধরনের বৃহৎ সমঝোতায় অবশ্যই সময়ের সঙ্গে আধুনিকীকরণ ও নতুন বৈশ্বিক বাস্তবতার বিবেচনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে।

এখানে মূল বিষয় হচ্ছে প্রবৃদ্ধির সুযোগ তার গতি-প্রকৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। সাম্প্রতিক উন্নয়নগুলো যেমন ডিগ্লোবালাইজেশন, ডিকার্বনাইজেশন প্রচেষ্টাগুলো এবং রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধির মডেলের ব্যর্থতাই সম্ভবত নিম্ন আয়ের দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কমিয়ে দিয়েছে। এটা থেকে বোঝা যায় যে ঋণ হ্রাসের দরকষাকষির আলোচনায় প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যৎ ভূমিকা নিয়ে অতিরঞ্জিত করা উচিত না। প্রবৃদ্ধির সুযোগ হারানোর জন্য যে খরচ হবে সেটাই হচ্ছে গভীরতম ঋণ হ্রাসকরণ। তবে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নতুন বিনিয়োগের অনুপস্থিতির জন্য ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি আরো কমে যাবে, সেজন্য প্রবৃদ্ধির গতিপথকে নতুন বাস্তবতার নিরিখে সামঞ্জস্য করে তৈরি করতে হবে।

নতুন প্রবৃদ্ধির সুযোগের মধ্যে যদি নতুন অর্থায়ন আসে আর সেটা যদি লাভজনক হয় তাহলে সেই দেশগুলোর ঋণ হ্রাসের প্রয়োজনীয়তা কমতে পারে, যদি সেখানে বাণিজ্য সম্পর্কিত প্রবৃদ্ধি হ্রাসের প্রভাবগুলোকে আংশিক প্রতিহত করা যায়। সবুজ রূপান্তরের জন্য এ সুযোগ ও তহবিলের প্রয়োজন স্পষ্ট ও উল্লেখযোগ্য। জলবায়ু পরিবর্তন নিম্ন আয়ের দেশগুলোয় প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এতে তাদের আংশিক ভৌগোলিক অবস্থান, জনসংখ্যার বৃহত্তর সার্বিক দুর্বলতা এবং জলবায়ু ঝুঁকি কমাতে অক্ষমতার কারণ জড়িত রয়েছে। সবুজ প্রবৃদ্ধি মূলত করা হয়েছে জনগণের নীতিকে বাস্তবায়নের মাধ্যমে নেতিবাচক শক্তিগুলোকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে বিনিয়োগের মধ্যে রয়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি রোধকরণ, বন্যার লবণাক্ততা হ্রাসকরণ, সড়ক ও সেতু অবকাঠামো জোরদার করা এবং পানি সংরক্ষণ প্রকল্প বাড়ানো। আগামী বছরগুলোয় বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম আরো ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাই এখনই মানিয়ে নেয়ার মধ্যে খাদ্য সুরক্ষার উন্নতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। বর্তমানে মনোযোগ দিতে হবে সৌর ও বায়ুপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পরিষ্কার উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে, যার জন্য বিনিয়োগের প্রয়োজন। এর জন্য আইএফআইর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। শর্তগুলোকে অবশ্যই নতুন উন্নয়ন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। এটাকে অবশ্যই নতুন প্রবৃদ্ধির এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যমাত্রার ওপর অত্যধিক জোর দেয়া থেকে সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য নীতিগুলোয় মনোনিবেশ করতে হবে যা কিনা সবুজ প্রবৃদ্ধির অপরিহার্যতাকে সমর্থন করে। প্রবৃদ্ধির থেকে প্রাপ্তি পেতে আরো বেশি সময় লেগে যেতে পারে, তাই শর্তগুলোকে অবশ্যই সে অনুযায়ী ধাপে ধাপে করা উচিত।

এছাড়া আইএফআইকে অবশ্যই আরো বৃহত্তর অর্থায়নে ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে সরাসরি ও উদ্দেশ্য সাধনের উপায়ের মাধ্যমে অতীতের চেয়েও বেশি বেসরকারি অর্থায়নকে বর্ধিত করতে হবে। প্রাথমিকভাবে আগে আইএফআইকে নতুন করে অর্থ সরবরাহ শুরু করতে হবে, যতক্ষণ পর্যন্ত ঋণগ্রহীতা দেশগুলো নিজেদের পূর্বের ক্রেডিট যোগ্যতার ট্র্যাক রেকর্ড পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে ও বাজার প্রবেশের মাধ্যমে রূপান্তরের নতুন প্রবৃদ্ধির পথে হাঁটে। সবুজ রূপান্তরের বিনিয়োগের চাহিদা ১৯৮০ দশকের পুরনো ধাঁচের সংস্কারের চেয়ে অনেক বেশি বড়। যেখানে জনগণের কাছ থেকে তখন বেসরকারি খাতে সম্পদ স্থানান্তর হয়েছিল কেবল জনগণকে ব্যয়সংকোচনে মনোনিবেশ করার জন্য।

মূল্যবান প্রবৃদ্ধির সুযোগগুলো দেয়া হলে আইএফআইয়ের ঋণের আকার এবং ঋণ হ্রাসের পরিমাণ প্রয়োজনে নেতিবাচকভাবে সম্পর্কিত হতে পারে। একটি উচ্চাভিলাষী ঋণ প্রদানের কর্মসূচি যা উচ্চাভিলাষী সংস্কার কর্মসূচির অর্থায়ন করে, তা উচ্চপ্রবৃদ্ধির হারের দিকে পরিচালিত করবে এবং সেজন্যই কম ঋণ হ্রাস প্রয়োজন। 

পরিশেষে আইএফআইকে ঋণদাতার গঠনের পরিবর্তনগুলোয় নিজেদের প্রতিক্রিয়া দিতে হবে। বেসরকারি বাজারের ঋণের বৃদ্ধি নিয়ে এবং নতুন ঋণদাতাদের বিশেষ করে চীন, ভারত, রাশিয়া এবং আরো কয়েকটি দেশের উত্থানের জন্য বোঝা ভাগাভাগি করা বর্তমানে আরো জটিল হয়েছে। যদি নতুন আনুষ্ঠানিক ঋণদাতারা তাদের দাবির ভিত্তিতে বড় ক্ষতির মুখোমুখি হয় তাহলে ঋণ পুনর্গঠনের নীতিগুলো কীভাবে বিকশিত হবে সে সম্পর্কে তারা আরো বেশি কথা বলতে পারে বলে আশা করা যায়। স্বল্পমেয়াদে অগ্রগতির সুবিধার্থে নীতিগুলো নমনীয়ভাবে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপটে আনুষ্ঠানিক ঋণদাতার উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনগুলো অবশ্যই আইএফআই  বোর্ডের গঠনে যেন প্রতিফলিত হয়।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য সফল ঋণ সমঝোতার একটি অপরিহার্য উপাদান। তবে সর্বোত্তম পরিস্থিতিতেও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি ধীর হতে পারে এবং স্থানীয় পর্যায়ে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি রয়েছে। সেজন্য গভীর ঋণ হ্রাস ও দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। এটা উপলব্ধি করতে হবে যে নতুন বিনিয়োগের সুযোগের জন্য দরকার নতুন তহবিল এবং নতুন ধরনের শর্ত। উন্নয়নশীল দেশগুলো নতুন প্রবৃদ্ধির পথে অগ্রসর না হওয়া পর্যন্ত নতুন অর্থায়ন দ্রুত ও বড় আকারের আইএফআই কাছ থেকে আসতে হবে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]


ড্যানি রড্রিক: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল

রেজা বাকির: সাবেক গভর্নর স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান এবং জ্যেষ্ঠ ফেলো হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল

ইশাক দিওয়ান: রিসার্চ পরিচালক ফাইন্যান্স ফর ডেভেলপমেন্ট ল্যাব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন