অভিমত

ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট

নিজাম আশ শামস

প্রবাদ আছে, কর এবং মৃত্যুকে এড়ানো যায় না। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি অর্ধসত্য। এখানকার করদাতারা মৃত্যুকে এড়াতে পারেন না, কিন্তু নানা কৌশলে কর ফাঁকি দেয়ার ক্ষেত্রে তারা অনন্য। কর আইনের নানা ফাঁকফোকর দিয়ে তারা খুব সহজে কেটে পড়েন। এ কারণে বাংলাদেশে কর আইনজীবীদের বাজার রমরমা। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর বেতন দিয়ে তাদের রাখে। আছে বিভিন্ন কনসালট্যান্সি ফার্ম। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও দুর্নীতি। ফলে বাংলাদেশে করদাতা নিবন্ধনের সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দেয়ার সংখ্যা বাড়েনি।

একটি দেশের মোট জিডিপিতে রাজস্ব খাতের অবদানকে প্রকাশ করা হয় রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত আকারে। আবার রাজস্ব আয়ের বড় একটি অংশ আসে ট্যাক্স থেকে। তাই এটি ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত নামেও পরিচিত। এ অনুপাতের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন। বাংলাদেশে বর্তমানে রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ৮ শতাংশের নিচে। অথচ নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। এ দেশে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার (টিআইএন) আছে এমন ব্যক্তির সংখ্যা প্রায় সাড়ে সাত মিলিয়ন। তবে কর প্রদানের ক্ষেত্রে তা প্রতিফলিত হচ্ছে না। 

ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক নামে ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ডের (আইএমএফ) একটি প্রকাশনা আছে। আইএমএফের অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ এতে প্রকাশ হয়। ২০২১ সালের এপ্রিলে এতে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, ২০১৬-২০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত ছিল গড়ে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। একই সময়ে এ অনুপাত ভারতে ১৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ, নেপালে ২১ দশমিক ৫০, পাকিস্তানে ১৪ দশমিক ৮৮ ও শ্রীলংকায় ১২ দশমিক ৭৪ শতাংশ ছিল। 

একটি দেশের প্রাণ হলো সে দেশের রাজস্ব আয়। সে কারণে ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এ চিত্র একই সঙ্গে হতাশার ও আতঙ্কের। এনবিআর তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। ফলে বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। এ ঘাটতি পূরণে সরকার দেশী-বিদেশী উৎস থেকে বিপুল পরিমাণে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। কেবল অভ্যন্তরীণ উৎস থেকেই পাঁচ বছরে সরকারের ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরের মতে, রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০-২২ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে সংকটের কোনো সমাধান হবে না। (সূত্র: বণিক বার্তা, ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩)

করদাতারা কেন কর ফাঁকি দেন? এক কথায় বলতে গেলে, কর ফাঁকি দেয়ার সুযোগ আছে বলে দেন। ‘ট্যাক্স ইভেশন ইন বাংলাদেশ: কজেস, কনসিকুয়েন্সেস অ্যান্ড রেমেডিজ’ শিরোনামে ২০১৮ সালে ড. সামস উদ্দিন আহমেদের একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়। সে সময় তিনি ঢাকার ট্যাক্স জোন ২-এর কমিশনার ছিলেন। বর্তমানে তিনি এনবিআরের সদস্য (করনীতি)। সেখানে বিশেষজ্ঞদের বরাতে কর ফাঁকি দেয়ার কয়েকটি কারণ তিনি উল্লেখ করেন। পাশাপাশি এর সমাধানও প্রস্তাব করেন। তার গবেষণালব্ধ তথ্য অনুসারে, বাংলাদেশে কর ফাঁকির প্রবণতার প্রথম কারণ হলো উচ্চকরহার। অন্যান্য দেশের তুলনায় এ দেশে করপোরেট করহার বেশি। সর্বোচ্চ ৪০ এবং সর্বনিম্ন ২৫ শতাংশ। গবেষণায় দেখা যায়, করহার বৃদ্ধি এবং কর ফাঁকির প্রবণতা সমানুপাতিক। তাই কর ফাঁকি প্রতিরোধে করহারের পুনর্মূল্যায়ন জরুরি। দ্বিতীয়ত, দুর্নীতির কারণে কর ফাঁকির পরিমাণ বেড়ে যায়। সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির কারণে কর কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। করদাতারা অনৈতিক কাজে উৎসাহিত হয়। তারা বিশ্বাস করে যে কর কর্মকর্তারা দুর্নীতিগ্রস্ত। তাই ব্যক্তিস্বার্থে তাদের কাজে লাগিয়ে তারা ফায়দা লোটে। তৃতীয় কারণ হলো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় রাজনীতিবিদরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কর প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করেন। বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের আমলে করনীতিকে প্রভাবিত করার উদাহরণ আছে। এর মাধ্যমে তারা সমাজের প্রভাবশালী ও বিত্তবান ব্যক্তিদের বিশেষ সুবিধা দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বিনিময়ে আদায় করে নেন তাদের রাজনৈতিক সমর্থন। চতুর্থ কারণটি হলো পর্যাপ্ত তথ্যের অভাব। কর ফাঁকি চিহ্নিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। করখেলাপিদের সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য কর প্রশাসনের হাতে থাকে না। প্রায়ই দেখা যায়, কর কর্তৃপক্ষ করদাতার সরবরাহকৃত তথ্যের ভিত্তিতে তাদের আয় সম্পর্কে অবগত হয়। একইভাবে, করদাতার আর্থিক লেনদেন সম্পর্কেও তাদের স্বচ্ছ কোনো ধারণা থাকে না। ফলে তথ্য গোপন করে কিংবা আয় কম দেখিয়ে করের বোঝা কমানোর অবাধ সুযোগ থাকে করদাতাদের। অকার্যকর কর প্রশাসনকে কর ফাঁকির পঞ্চম কারণ মনে করেন সামস উদ্দিন আহমেদ। কর সংস্কারক নিকোলাস ক্যালডরের ‘দ্য রোল অব ট্যাক্সেশন ইন ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট’ বইয়ের সূত্র উল্লেখ করে তিনি বলেন, কর ব্যবস্থা কেবল যথাযথ কর আইনের ওপর নির্ভর করে না। এর জন্য প্রয়োজন কর প্রশাসনের কার্যকর দক্ষতা। ক্যালডর লক্ষ করেন যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কর প্রশাসন সাধারণত অদক্ষ ও অকার্যকর। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এর উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যতিক্রম নেই। গবেষণায় দেখা যায়, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং কর কর্মকর্তাদের অদক্ষতা এ দেশে কর ফাঁকির অন্যতম কারণ। ষষ্ঠ কারণ হলো বিদ্যমান কর আইনে অপর্যাপ্ততা ও জটিলতা। এ দুই কারণে সৎ করদাতারা অনুৎসাহিত হন। অন্যদিকে কর উপদেষ্টা ও ল ফার্মের সহায়তায় অসাধু করদাতারা কর ফাঁকি দেয়ার নব নব কৌশল উদ্ভাবন করেন। কর বিশেষজ্ঞ শওকত আলী ওয়ারেসির বরাতে ড. সামস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশে বিদ্যমান কর আইন কর হ্রাস এবং কর অব্যাহতির সুবিধায় পরিপূর্ণ। এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে অসাধু করদাতারা।’ সর্বশেষ তিনি উল্লেখ করেন, করদাতাদের অজ্ঞতা বাংলাদেশে কর ফাঁকির অন্যতম কারণ। কর আইন সম্পর্কে তাদের স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। আবার কর বিভাগও তাদের যথেষ্ট তথ্য সরবরাহ করতে পারে না। এ কারণে তারা কর প্রদানে উৎসাহ দেখান না। 

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের শিক্ষক জাহানজেব ইবনে খালেদ ২০২১ সালে ‘কমপারেটিভলি লোয়ার ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ইন বাংলাদেশ: দ্য সাইকোলজিক্যাল ইমপ্যাক্ট অব হিস্টোরিক্যালি লং কলোনিয়াল রুল’ শিরোনামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। মার্চ, ২০২০ থেকে মার্চ, ২০২১ পর্যন্ত সময়ে এ গবেষণা পরিচালিত হয়। সেখানে তিনি কর ফাঁকির পেছনে করদাতাদের মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো বিশ্লেষণ করেন। তার মতে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল আছে যে সরকার যে রাজস্ব আয় করছে তা অন্যত্র পাচার হয়ে যাচ্ছে। তাই সাধারণ করদাতারা কর ফাঁকি দিতে চান। তাদের কষ্টোপার্জিত অর্থ কোথায় ব্যয় হচ্ছে, এ বিষয়ে তারা কোনো জবাবদিহিতা পান না। তারা মনে করেন, মানুষের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ অর্থ ব্যবহার করা হবে না। ফলে তারা কর আহরণে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। কিছু করদাতা মনে করেন যে যেহেতু তারা সম্পদের ওপর জাকাত দিচ্ছেন, তাই তারা আয়কর দেবেন না। আয়কর ও জাকাত যে এক বিষয় নয় এবং একটা দিলে যে আরেকটা খারিজ হয়ে যায় না, এ ধারণা তাদের পর্যন্ত পৌঁছাতে যথাযথ উদ্যোগ নেয়া হয়নি। কিছু করদাতা আছেন, যারা মনে করেন যে কর দিলে তাদের সম্পদ কমে যাবে। তাই তারা কর দেন না।

বিশেষজ্ঞ মতামতের ভিত্তিতে এ লেখায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোয় কর ফাঁকির কারণগুলো তুলে ধরা হলো। তবে বাংলাদেশ যেহেতু স্বল্পোন্নত দেশের মর্যাদায় নিজেকে উন্নীত করতে চায়, তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ভিন্ন অন্য কোনো পথ তার সামনে খোলা নেই। সে লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে বর্তমান সরকার। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত দুই অংকে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয়েছে। আর ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মধ্যে তা ১০ দশমিক ৬ শতাংশে উন্নীত করতে চায় সরকার। এরই মধ্যে আয়কর আইন ২০২২ নামে একটি খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডও মানুষের মধ্যে করসচেতনতা তৈরিতে গ্রহণ করছে নানা উদ্যোগ। কর মেলা এর অন্যতম উদাহরণ। অনলাইনে সহজে রিটার্ন দাখিল করার নিয়মও চালু করা হয়েছে। তবে তা যথেষ্ট নয়। পাশাপাশি সম্পূর্ণ কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। 

মানুষ আশায় বাঁচে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে অনেক দৃষ্টান্ত তৈরি হয়েছে। সরকারের সদিচ্ছাও আছে। এখন সময় তা কাজে বাস্তবায়ন করার। আমরা আশা করি, কর ফাঁকির কারণগুলো যথাযথ চিহ্নিত করার মাধ্যমে আশু প্রতিকারের ব্যবস্থা নেবে সরকার। এর মাধ্যমে স্থাপন করবে নতুন দৃষ্টান্ত। হাঁটবে প্রগতির পথে। নচেৎ পতন অনিবার্য।


নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন