২০২৪ সাল শেষে দেশের ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৪৫ শতাংশ ছাড়াবে

মেহেদী হাসান রাহাত

অভ্যন্তরীণ বিদেশী উৎস থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ বেশ বছর ধরে ক্রমেই বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে ঋণ নিচ্ছে সরকার। বর্তমানে দেশের দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪১ শতাংশেরও বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সাল শেষে এটি জিডিপির ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এক্ষেত্রে দক্ষতার সঙ্গে ঋণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ঋণের বিপরীতে যথাযথভাবে রিটার্ন নিশ্চিত করার বিষয়ে জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ট্রেজারি ডেট ম্যানেজমেন্ট উইংয়ের পক্ষ থেকে ২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য একটি মধ্যমেয়াদি ঋণ ব্যবস্থাপনা কৌশল প্রণয়ন করা হয়। তিন অর্থবছরে কোন ধরনের কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে সরকার ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারে এতে সে বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। বলা হয়েছে চার ধরনের কৌশলের কথা। প্রথম কৌশলের মধ্যে রয়েছে বিদেশী উৎসের তুলনায় স্থানীয় উৎস থেকে বেশি ঋণ নেয়া। এক্ষেত্রে বিদেশী উৎস থেকে নেয়া ঋণের মাধ্যমে সরকারের ২৬ শতাংশ ব্যয় মেটানোর কথা বলা হয়েছে। বাকিটা আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে, যার মধ্যে ১৯ দশমিক শতাংশ সঞ্চয়পত্র ২০ শতাংশ আসবে ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে। ২০২১-২২ এর পরের অর্থাৎ চলতি অর্থবছরে কৌশল নেয়ার কথা বলা হয়েছে।

দ্বিতীয় কৌশলের মধ্যে রয়েছে বিদেশী উৎস থেকে ঋণের পরিমাণ বাড়ানো। পদ্ধতি অনুসারে সরকার তার মোট অর্থায়ন চাহিদার ৩৬ শতাংশই পূরণ করবে বিদেশী ঋণের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে অর্থায়ন শতাংশ কমানোর কথা বলা হয়েছে। অন্যদিকে ছাড় আংশিক ছাড়ে বিদেশী ঋণ বাড়ানোর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। তৃতীয় কৌশলেও এসেছে বিদেশী উৎস থেকে ঋণ বাড়ানোর কথা। তবে এতে আংশিক ছাড়ে পাওয়া ঋণের পরিমাণ বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে ছাড়ের তুলনায় আংশিক ছাড়ের বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেশি হবে। দ্বিতীয় কৌশলের মতো এক্ষেত্রেও ৩৬ শতাংশ অর্থায়ন চাহিদা পূরণের কথা বলা হয়েছে বিদেশী উৎস থেকে।

চতুর্থ কৌশলের মাধ্যমে সঞ্চয়পত্রে বড় ধরনের সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মধ্যে সঞ্চয়পত্র দিয়ে সরকারের অর্থায়ন চাহিদা পূূরণের পরিমাণ দশমিক শতাংশে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমেও অর্থায়ন কমানোর সুপারিশ করা হয়েছে কৌশলে। এর বিপরীতে বাড়বে ট্রেজারি বন্ডের মাধ্যমে অর্থায়ন।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের অর্থায়ন চাহিদার ৪৯ শতাংশই আসবে এর মাধ্যমে। অন্যদিকে এক্ষেত্রে প্রথম কৌশলের মতো ২৬ শতাংশ অর্থায়ন আসবে বিদেশী ঋণ থেকে।

কোন ধরনের কৌশল অবলম্বন করা সরকারের জন্য সুবিধাজনক হবে সে বিষয়েও সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে দেখা যায়, ঝুঁকি বিবেচনায় দ্বিতীয় কৌশলটি প্রান্তিকভাবে ভালো পারফর্ম করলেও দীর্ঘমেয়াদের জন্য এটি জুতসই হবে না। বিদেশী ঋণের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে তৃতীয় কৌশলটিও সুবিধাজনক হবে না বলে মত দেয়া হয়েছে। তাই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রথম কৌশল পরিবর্তন এবং দ্বিতীয় কৌশলের সুবিধা নেয়া হয়ে গেলে চতুর্থ কৌশলটিই দীর্ঘমেয়াদে সবচেয়ে লাভজনক হবে বলে মত দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে দেশের সামষ্টিক-আর্থিক পরিস্থিতি বিবেচনা অভ্যন্তরীণ ঋণের বাজারের গভীরতা বাড়ানোর দিকেও গুরুত্ব বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে সুপারিশে।

লক্ষণীয় হচ্ছে, সব কৌশলেই দেশের ঋণের পরিমাণ ২০২৪ সাল শেষে জিডিপির ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশের জিডিপির অনুপাতে সরকারের ঋণ ছিল ৩৪ দশমিক শতাংশ। মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে ২০২০-২১ অর্থবছরে অনুপাত ৪১ দশমিক শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপি সরকারের ঋণের অনুপাত ৪২ দশমিক শতাংশে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বহুজাতিক সংস্থাটির তথ্য বলছে, গত অর্থবছর শেষে বাংলাদেশ সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল ১৪৭ দশমিক বিলিয়ন ডলার। প্রতি ডলারের মূল্য ১০০ টাকা ধরলে বাংলাদেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ১৪ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। বিপুল ঋণের ৫৮ শতাংশ দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নেয়া হয়েছে। বাকিটা এসেছে বিদেশী উৎস থেকে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর শেষে বহুজাতিক বিভিন্ন সংস্থাসহ বিদেশী উৎস থেকে সরকারের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৭ বিলিয়ন ডলার, যা দেশের জিডিপির প্রায় ১৮ শতাংশ।

রাজস্ব আয় প্রত্যাশিতভাবে না হওয়ায় অর্থায়ন চাহিদা পূরণে ঋণের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে সরকারকে। সামনের দিনগুলোয় কাঙ্ক্ষিত হারে নিজস্ব আয় বাড়াতে না পারলে সরকারের নির্ভরশীলতা আরো বাড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ যখন নিম্ন আয়ের দেশ ছিল তখন অনুদান ছাড়ে ঋণ সুবিধা পাওয়া যেত। কিন্তু যখন ২০১৫ সালে নিম্ন আয় থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়, তখন আর কেবল ছাড়ে ঋণ সুবিধা পাওয়ার যোগ্য থাকল না। ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে এখন ছাড়ের পাশাপাশি আংশিক ছাড় এবং কোনো ধরনের ছাড় ছাড়াই ঋণ নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। সামনের দিনগুলোয় কঠিন শর্তের ঋণের পরিমাণ বাড়বে, সুদহার ডেট সার্ভিসিংও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে ম্যাচুরিটি পিরিয়ড গ্রেস পিরিয়ড কমবে, ঋণ পরিশোধের সময়ও কমে আসবে। রাশিয়া চীনের মতো দেশ থেকে বর্তমানে কঠিন শর্তে দ্বিপক্ষীয় ঋণ নেয়া হচ্ছে। সামনের দিনগুলোয় এগুলো দ্রুতই ম্যাচিউরড হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তখন বাংলাদেশের ঋণ জিডিডির অনুপাত বাড়বে।

বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের মতো দেশের ঋণ নিতে হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে থেকে রিটার্ন ঠিকমতো আসছে কিনা? একদিকে আমাদের ঋণ ব্যবস্থাপনা ঠিকভাবে করতে হবে, যাতে রিটার্ন ঠিকমতো আসে। আরেকদিকে আমাদের রফতানি আয় রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে যাতে ভালো পারফর্ম করতে পারি, চ্যালেঞ্জগুলো আগামীতে নিতে হবে। কারণে যে ঋণগুলো নেয়া হচ্ছে সেগুলো ঠিক জায়গায় যাচ্ছে কিনা, অগ্রাধিকার খাতে যাচ্ছে কিনা, ইন্টারনাল রেট অব রিটার্ন, ইকোনমিক রেট অব রিটার্ন, ফাইন্যান্সিয়াল রেট অব রিটার্ন ঠিকমতো হচ্ছে কিনা, সুশাসন নিশ্চিত করা হচ্ছে কিনা, প্রকল্পের কাজ সময়মতো শেষ হচ্ছে কিনা, বিষয়গুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে বাংলাদেশের জন্য। জিডিপির ৪৫ শতাংশ ঋণ, এটি ঝুঁকি তৈরি না করলেও ডেট সার্ভিসিং যে বাড়ছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিদেশী ঋণের ক্ষেত্রে মুদ্রার বিনিময় হারের ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে। কারণ আমরা বিদেশী ঋণ নিয়ে দেশে যে খাতে বিনিয়োগ করছি সেখান থেকে স্থানীয় মুদ্রায় রিটার্ন আসছে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় মুদ্রাকে ডলারে রূপান্তর করে ঋণ শোধ করতে হয়।

অর্থনীতিবিদ আরো বলেন, বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ এখনো আইএমএফ বিশ্বব্যাংকের গ্রহণযোগ্য সীমার নিচে রয়েছে। তবে মূল বিষয় হচ্ছে ক্রমান্বয়ে আমাদের কঠিন শর্তের ঋণ বাড়ছে, ডেট সার্ভিসিংয়ের বোঝা বাড়ছে এবং সে কারণে যে টাকাটা আমরা নিচ্ছি তা ভালোভাবে ব্যয় হচ্ছে কিনা সেটা গুরুত্বপূর্ণ। কতটা দক্ষতার সঙ্গে আমরা ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছি সেটাই হচ্ছে মূল বিষয়। 

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত সরকারের মোট পরিচালন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৭ হাজার কোটি টাকায়। যেখানে এর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ব্যয় ছিল ৩৫ হাজার ৬২৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে পরিচালন ব্যয় বেড়েছে দশমিক ৮৬ শতাংশ। অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের আগস্ট পর্যন্ত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ২২ দশমিক ৫৭ শতাংশ কমে গেছে। সরকারের পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ১১ হাজার ৬৮৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সুদ পরিশোধ বাবদ, যা মোট পরিচালন ব্যয়ের ৩২ শতাংশ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে নেয়া ঋণের বিপরীতে সুদ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে ১০ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা এবং বিদেশী ঋণের সুদ বাবদ ব্যয় হয়েছে হাজার ১০ কোটি টাকা। এছাড়া সময়ে জনসেবায় ২১ শতাংশ, শিক্ষায় ১৮ শতাংশ, প্রতিরক্ষায় ১০ শতাংশ, জনশৃঙ্খলা নিরাপত্তায় শতাংশ, স্বাস্থ্যে শতাংশ, সামাজিক নিরাপত্তা কল্যাণে শতাংশ, পরিবহনে শতাংশ, কৃষিতে শতাংশ, এলজিআরডিতে শতাংশ চিত্তবিনোদন, সংস্কৃতি ধর্মীয় কার্যক্রমে শতাংশ অর্থ ব্যয় করেছে সরকার।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখনো নিরাপদ জোনের মধ্যে রয়েছে। আমরা জিডিপির ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ নিতে পারি। আমাদের ব্যয় দক্ষতা বাড়িয়ে আরো ঋণ নেয়া উচিত। কারণ আমাদের অনেক সুযোগ রয়ে গেছে ঋণ ব্যবহারের। ভারতের জিডিপির ৮৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ৮৭ শতাংশ সিঙ্গাপুরের ১১৯ শতাংশ ঋণ রয়েছে। বাংলাদেশের এক্ষেত্রে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। ঋণের অর্থ যাতে যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয় এবং এতে যে অর্থনৈতিক রিটার্ন আসবে তাতে অর্থনীতি শক্তিশালী হবে। রিটার্ন আসবে এমন প্রকল্পই আমরা নিচ্ছি। ঋণ বাড়ার পাশাপাশি সামনের দিনগুলোতে আমাদের জিডিপিও বাড়বে। উন্নত দেশ হতে চাইলে আমাদের ঋণ প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগ নেয়ার যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে।  সেই সঙ্গে আমাদের ব্যয় দক্ষতা গুণগতমান বাড়াতে হবে। যাতে করে আমরা সময়মতো রিটার্ন নিশ্চিত করতে পারি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন