ক্রাউড ফান্ডিং-অর্থনৈতিক সংকটে বিকল্প অর্থায়ন পদ্ধতি

এমএম খালেকুজ্জামান

বাজ ওয়ার্ড সব যে পরিণতি পায় তা হলফ করে বলা যায় না। কিছু কিছু মিলিয়ে যায় বাতাসে। আর কিছু প্রাণ পায় বাস্তবের মাটিতে। ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে রায় দেয়ার সময় আসেনি এখনো। বরং মনে পড়ে, একবার ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ১৭ শতকের ত্রিশের দশকে বেশ তারল্য সংকটে পড়ে। এক্সচেকার কোনো সাহায্য করতে না পারায় ১৭৩০ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড গণতহবিল গঠন করে তারল্য সংকট থেকে রক্ষা পেয়েছিল! এমনকি ১৮৮৫ সালে আমেরিকা সরকার স্ট্যাচু অব লিবার্টির ব্যয় জোগাড় করতে পারছিল না তখন নাগরিক অর্থায়নে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। ইতিহাসের নানা কালপর্বে দেশে দেশে এমন সম্মিলিত নাগরিক প্রয়াসে অনেক কঠিন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা গেছে যা প্রাথমিকভাবে অসাধ্য মনে হয়েছিল। 

ক্রাউড ফান্ডিং পাশ্চাত্যে একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি। হালে জনপ্রিয় অর্থায়ন পদ্ধতি। বাংলায় আমরা একে গণতহবিল বা গণ-অর্থায়ন বলতে পারি। এর মূল বিষয় হলো, কোনো প্রকল্পে বা কোনো কাজে বহু মানুষের কাছ থেকে অল্প অল্প করে তহবিল সংগ্রহ করে প্রকল্প সম্পন্ন করা। হাল আমলে মূলত ইন্টারনেটের বিভিন্ন মাধ্যমে এ অর্থ সংগ্রহ করা হয়। ক্রাউড ফান্ডিং পদ্ধতিতে ২০১৫ সালে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সংগ্রহ করা হয়েছিল বিশ্বে।

ক্রাউড ফান্ডিং ব্যাপারটি বাংলাদেশের বিনিয়োগ অধিক্ষেত্রে নতুন বলা যায়। জনপ্রিয় সাইট ইনভেস্টোপিডিয়া বলছে ক্রাউড ফান্ডিং হচ্ছে, অনলাইন ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগের প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আগ্রহীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহ করার উদ্যোগ। বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে বড় কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করাই হলো এর প্রধান উদ্দেশ্য। 

ক্রাউড ফান্ডিং এখনো নতুন নতুন ধরন নিয়ে ক্রমবর্ধনশীল একটি খাত। বিশ্বব্যাপী নানা ধরনের ক্রাউড ফান্ডিং আছে যা নির্ভর করে সেবা বা ব্যবসার ধরন, সার্ভিসের ধরন এবং লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের ওপরে। মোটা দাগে তিন ধরনের ক্রাউড ফান্ডিং আছে। ডোনেশন বেইজড বা অনুদানভিত্তিক। রিওয়ার্ড বেইজড বা পুরস্কারভিত্তিক। ইকুইটি ক্রাউড ফান্ডিং (এই ক্রাউড ফান্ডিং বিনিয়োগকারীকে ব্যবসার মালিকানায় অংশীদার করা হয়। ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে বিনিয়োগকারী ইকুইটি মালিকানা লাভ করে। এবং ইকুইটি ওনার হিসাবে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ওপর আর্থিক লাভ ও লোকসানের অংশীদার হয়)।

ক্রাউড ফান্ডে অংশগ্রহণ করে যারা অর্থ দেবেন তারা নানাভাবে লাভবান হতে পারেন। এ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এতে নতুন উদ্যোক্তার একদিকে যেমন অর্থের জোগান হয়, তেমনি বিজ্ঞাপন খরচ ছাড়াই উদ্যোক্তার একটা প্রচারণা হয়ে যায়, ফলে সাধারণ মানুষ এ সম্পর্কে জানতে পারে প্রস্তুতির পর্যায়েই।

কিন্তু চ্যালেঞ্জ হলো, এ প্লাটফর্ম দারুণ রকম প্রতিযোগিতাপূর্ণ। তাই যথেষ্ট ভালো ‘বিজনেস আইডিয়া’ অনেক সময় যথাযথ গবেষণা সহয়তা না থাকায় চূড়ান্ত পরিণতি পায় না। উপযুক্ত অনুশীলনের পর সাসটেইনেবল প্রজেক্ট করে ক্রাউড ফান্ডিং নিশ্চিত বেশ কঠিন। এমএলএম কোম্পানি কিংবা ই-কমার্স বিষয়ে দেশে যথাযথ নীতিমালা ছিল না। তার খেসারত দিতে হয়েছে কেবল প্রতিষ্ঠান কিংবা বিনিয়োগকারীকেই নয় গোটা শিল্পই আস্থার সংকটে পড়েছে। ক্রাউড ফান্ডিং খাতে যেন এমন কিছু না হয় তার জন্য নীতিনির্ধারকদের সচেতনতা জরুরি।

বিগত কয়েক বছরে দক্ষিণ এশীয় ক্রাউড ফান্ড চর্চা উল্লেখযোগ্য ব্যাপকতা অর্জন করেছে আর বৈশ্বিক বিদ্যায়তনে টেক্সট হিসেবে পড়ানো হলেও বাংলাদেশ বিজনেস একাডেমিয়ায় অনেকটাই অনুচ্চারিত থেকেছে।

নরওয়ের ইউনিভার্সিটি অব আগদার অধ্যাপক ড. রোথাম স্নেয়র বলেন, ক্রাউড ফান্ডিং (গণ-অর্থায়ন) বিশ্বের অনেক দেশে এখন জনপ্রিয় ধারণা। দেশগুলোর অর্থনীতিতেও পড়ছে এর প্রভাব। উন্নত বিশ্বে গণ-অর্থায়নের জন্য সংস্থা গড়ে উঠছে, যারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এর মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলোর। অর্থনীতিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে গণ-অর্থায়ন।

চট্টগ্রামের ইস্ট ডেল্টা ইউনিভার্সিটিতে (ইডিইউ) ‘ফার্স্ট ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন ক্রাউড ফান্ডিং ফর ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রিজ’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। (সূত্র বাংলা ট্রিবিউন)  আর এ পুরো বিষয়টি ফ্যাসিলিটেট করছেন ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ইস্টার্ন নরওয়ের অ্যাসোসিয়েট অধ্যাপক জিয়াউল হক মুনিম।

গত তিন বছর নানা রকম পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে বিনিয়োগের বিশ্ববাজারে। করোনাকালের অভিঘাত যতটা মনে হয়েছিল, পরিস্থিতি আসলে তার থেকে অনেক বেশি খারাপ দেখা যাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, বিশ্বজুড়ে অস্বাভাবিক তেলের মূল্যবৃদ্ধি, তাকে সামাল দিতে ঋণে সুদ বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে শেয়ার বাজারেও সুখবর নাই। রিজার্ভ আশঙ্কাজনক কমে যাচ্ছে অনেক দেশেই, আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। এ অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বড় লগ্নিকারীরাই ভয়ে আছে সেখানে ছোট কিংবা স্টার্টআপদের অবস্থা সহজে অনুমান করা যায়। 

ক্রাউড ফান্ডিং করে মন্দা কাটানো যেতে পারে। এমনকি ইউক্রেনের অনেকে ক্রাউড ফান্ডিং করে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয়ে নেমেছে। সেরহি প্রিটুলা যিনি ইউক্রেনিয়ান টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিবিদ। তার দেয়া অনুদানে সম্প্রতি কেনা হয়েছে তুর্কির উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ড্রোন। যেটি রাশিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে ব্যবহার হচ্ছে। যুদ্ধের সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে দেশের বাইরে থেকেও প্রচুর অনুদান জমা হচ্ছে তহবিলে। নাগরিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ক্রয় করা হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবীদের তত্ত্বাবধানে। সাধারণ মানুষের অনুদানে সামরিক সরঞ্জাম কেনা হচ্ছে ইউক্রেনে। যুদ্ধ সুরক্ষা পোশাক থেকে গোলাবারুদ ইত্যাদি কেনা হচ্ছে দেশটির ‘ক্রাউড ফান্ড’ প্রকল্পের অর্থে।

নিবন্ধকারের সঙ্গে চট্টগ্রামে ব্যক্তিগত আলাপে অধ্যাপক ড. রোথাম স্নেয়র বলছিলেন, ক্রাউড ফান্ডিং (গণ-অর্থায়ন) বাংলাদেশে এখনো নতুন। আর তার সহকর্মীরা এ অঞ্চলে এর প্রায়োগিকতা বোঝার জন্য এসেছেন। ক্রাউড ফান্ডিং নিয়ে ধারণার ঘাটতিই বাংলাদেশে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মূল সমস্যা সাধারণ মানুষের মধ্যে এখনো পরিচিত নয়। সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন দাতব্য কাজে অনুদান স্বাভাবিক হলেও নতুন ব্যবসা ধারণা নিয়ে কোনো তরুণ বিনিয়োগপ্রত্যাশী হলেও আস্থা সংকটে কোনো সাহায্য পান না। ক্রেডিট অথবা বিনিয়োগসংক্রান্ত ক্রাউড ফান্ডিং ধারণা এখনো ভ্রূণ পর্যায়ে আছে। ধারণাগত ঘাটতির  কারণে সাধারণ মানুষ স্টার্টআপ কিংবা নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযুক্ত হতে চান না। নীতিসহায়তা দিয়ে ক্রাউড ফান্ডিং ধারণাকে মূলধারার ব্যবসার কাছাকাছি নিয়ে আসা যেতে পারে।

বাংলাদেশ হতে পারে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের উর্বর ক্ষেত্র। সম্মিলিত চেষ্টায় গ্রামের সাঁকো তৈরিতে কেউ বাঁশ কেউ কাঠ কেউ অর্থ বা শ্রম দিয়ে যোগাযোগ সুনিশ্চিতকরণের নজির এখনো অবিরল এ দেশে। বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশনের হিসাব বলছে (২০১৯) পর্যন্ত, ৯১ দশমিক ৮১৮ মিলিয়ন মানুষ অর্থাত্ বাংলাদেশের লোকসংখ্যার প্রায় ৫৬ শতাংশ ইন্টারনেট সেবা নিয়ে থাকেন। তথাপি এদের সিংহভাগই স্মার্ট ফোনের সাধারণ ব্যবহারকারী। এদের অধিকাংশই এখনো সোশ্যাল ক্রাউড ফান্ডিং ধারণা বিষয়ে প্রাথমিকভাবেও অবহিত নয়। এ বিপুল ইন্টারনেট  সেবা গ্রহণকারী জনগণ ক্রাউড ফান্ডিংয়ের বিনিয়োগকারী হতে পারে যদি ক্রাউড ফান্ডিং লিটারেসির বিস্তার লাভ করে। হতে পারে অর্থনৈতিক  সংকটে বিকল্প অর্থায়ন পদ্ধতি।

এমএম খালেকুজ্জামান: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন