দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের মডেল বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত

ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

দুর্যোগ বাংলাদেশের মানুষের নিত্যসঙ্গী। দেশের মানুষকে বন্যা-ঘূর্ণিঝড় ছাড়াও মোকাবেলা করতে হয় অপ্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ। দুর্যোগ-দুর্বিপাকে অসহায় মানুষের পাশে ত্রাণ সহায়তা নিয়ে হাজির হচ্ছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়। দুর্যোগ ঝুঁকি কমাতে ভূমিকাও  রাখছে মন্ত্রণালয়। সার্বিক বিষয় নিয়ে বণিক বার্তার মুখোমুখি হয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন

গত এক দশকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় কী কী পরিবর্তন এসেছে?

আমরা মূলত দুটি কাজ করিদুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ বিতরণ। প্রাকৃতিক বা মনুষ্যসৃষ্ট যেকোনো দুর্যোগে জনসাধারণের যেসব সহায়তার প্রয়োজন হয়, সেগুলো আমরা দিয়ে থাকি। আমরা গত এক দশকে কাজটি অত্যন্ত সফলভাবে করেছি। করোনাকালের কথা যদি বলি, ২০২০-২১ সালে প্রায় সাত কোটি মানুষকে মানবিক সহায়তা দিয়েছি। একজন মানুষও না খেয়ে থাকেনি। লকডাউনের ফলে যখন কর্মক্ষম মানুষ কাজের সুযোগ হারাল, প্রথম দিন থেকেই আমরা মানবিক সহায়তা দিয়ে আসছি। ৩৩৩ নম্বরটি চালু করা আমাদের অন্যতম বড় সফলতা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অনেকেই লজ্জায় সাহায্য চাইতে পারে না। তাদের কথা ভেবে আমরা ৩৩৩ সেবা চালু করেছিলাম। এখানে ফোন করে প্রায় ২২ লাখ পরিবার করোনাকালে মানবিক সহায়তা পেয়েছে। এছাড়া যখন ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা দেয়া হয়, তখন আমরা লাখ লাখ মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসি। বন্যার সময় আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে আসি। আশ্রয়কালে লাখ লাখ মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করি। যেকোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলে যেমন পঞ্চগড়ে নৌকাডুবিতে মৃতের পরিবারকে এক মাসের খাদ্যসহায়তা দিয়েছি। এসব ক্ষেত্রে গুদামজাত পরিবহন সুবিধায় আমরা বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছি। আগে ঢাকার গুদাম থেকে খাবার যেত। যেতে যেতে দু-তিনদিন লেগে যেত। থেকে উত্তরণের জন্য আমরা ৬৪ জেলায় ৬৬টি খাদ্যগুদাম তৈরি করেছি। এর ফলে যেকোনো দুর্যোগের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপজেলা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ত্রাণ পৌঁছাতে সময় লাগে মাত্র - ঘণ্টা। এটা আমাদের বিশাল সফলতা বলে মনে করি। দুর্যোগের সময় উদ্ধার ত্রাণসহায়তা জোরদার করার জন্য আমরা ৬০টি মাল্টিপারপাস অ্যাকসেসেবল বোট তৈরি করেছি। বন্যা উপদ্রুত জেলাগুলোয় দুটি করে বোট দেয়া হয়েছে। বোটগুলোর সর্বোচ্চ ১০০ জন মানুষ ১০ টন ত্রাণ বহন করার সক্ষমতা রয়েছে। বোট বোটের টয়লেট প্রতিবন্ধীবান্ধব। বোটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো মাত্র এক মিটার বা তিন ফুট গভীরতায়ও চলাচল করতে পারে। ফলে বন্যার সময় ত্রাণ বিতরণ অনেক দ্রুত হয়। এছাড়া গত ১০ বছরে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার এইচবিবি রাস্তা সাত হাজারের মতো ব্রিজ-কালভার্ট করেছি। মন্ত্রণালয় থেকে প্রায় ৩০ হাজার গৃহহীন পরিবারকে দুই কক্ষবিশিষ্ট ঘর দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিয়েছেন। ২২০টি সাইক্লোন শেল্টার ৪২৩টি বন্যা আশ্রয় কেন্দ্র করেছি। ৫৫০টি মুজিব কেল্লা নির্মাণের কাজ  চলছে। এরই মধ্যে ১৭০টির কাজ শেষ হয়েছে। ২০২৪ সালের মধ্যে পুরোপুরি নির্মাণকাজ শেষ হবে।

দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের সিপিপি (ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি) কার্যক্রমের মান নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা শোনা যায়। মান বৃদ্ধির জন্য কী ভাবছেন?

সিপিপির কার্যক্রম নিয়ে অসন্তুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। কাজ এখন আরো ভালোভাবে এগিয়ে চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে সিপিপি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সিপিপির সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ হাজার। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে সেই সিপিপির সদস্য এখন ৭৬ হাজারের বেশি। এর অর্ধেকই নারী। সিপিপিতে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য জাতিসংঘ আমাদের পুরস্কার দিয়েছে।ইউনাইটেড ন্যাশন পাবলিক সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড ২০২১আমরা গ্রহণ করি। এটা আমাদের জন্য বিশাল অর্জন। এর মধ্যে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো হয়েছে আম্পান, বুলবুল, ফণি, সিত্রাংএগুলো খুবই শক্তিশালী ছিল। সুপার সাইক্লোন। সময় সিপিপি ভলান্টিয়াররা খুব দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। গত কয়েক বছরে আমাদের ২৭ জন ভলান্টিয়ার পানিতে ডুবে মারা গেছেন। থেকেই বোঝা যাচ্ছে, সংগঠনের ভলান্টিয়াররা কতটা ডেডিকেশন নিয়ে কাজ করেন। আমাদের দুর্যোগ মোকাবেলার মডেল এখন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। আমার মন্ত্রণালয় শতভাগ দুর্নীতিমুক্ত করতে পেরেছি।    

দুর্যোগ মোকাবেলায় উপকূল এলাকার সবুজ বেষ্টনী বনভূমি বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। অথচ আমরা দেখছি দিন দিন এসব বেষ্টনী বনভূমি উজাড় হচ্ছে। ব্যাপারে মন্ত্রণালয় থেকে কী উদ্যোগ নিয়েছেন?

ফণি, আম্পান, বুলবুল তিনটি সুপার সাইক্লোন আমরা মোকাবেলা করেছি। তিনবারই সুন্দরবনের কারণে আমাদের দেশে গুরুতর ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। সুন্দরবন আমাদের দেশের জন্য প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ। সুন্দরবন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন পরিবেশ মন্ত্রণালয় কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও নানা সময়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড়ে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এখন কিন্তু আবার সুন্দরবন আগের জায়গায় ফিরেছে। কিছুদিন আগে আমরা শরণখোলা হয়ে সুন্দরবনের অনেক ভেতরে প্রবেশ করেছিলাম। তখন দেখেছি ম্যানগ্রোভ ট্রি বিস্তার লাভ করেছে, যেটা আগামীতে আমাদের সুরক্ষা দেবে। 

সুন্দরবন উপকূল এলাকায় মেগা প্রকল্পের কাজ করছে সরকার। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে দুর্যোগ মোকাবেলায় সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সক্ষমতা থেকে আমরা বঞ্চিত হতে পারি। নিয়ে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কীভাবে সমন্বয় করছেন?

রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না। এটা বিজ্ঞানীরাও গবেষণা করে দেখিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী অনেক জোর দিয়ে বলেছেন, আমি প্রমাণ করেছি, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি করবে না। কাজেই নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই।

দেশের দুর্যোগের তালিকায় নতুন করে যুক্ত হচ্ছেবজ্রপাত এটি মোকাবেলায় কী উদ্যোগ নিয়েছেন?

২০১৬ সালে বজ্রপাত দুর্যোগ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। দেখা গেছে, প্রতি বছরই ২০০-৩০০ লোক বজ্রপাতে মারা যায়। এটা নিয়ে আমাদের কার্যকরী কোনো উদ্যোগ ছিল না। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর অনুভব করেছি, এতগুলো সুস্থ-সক্ষম মানুষের মৃত্যু মেনে নেয়া যায় না। এটা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেছি। আমরা তিনটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রথমত, ঘূর্ণিঝড়-বন্যার মতো বজ্রপাতেরও সতর্কবার্তা দিতে হবে। এখন যন্ত্রপাতি আবিষ্কার হয়েছে। ৪০ মিনিট আগে ওয়ার্নিং দেয়া যায়। ৪০ মিনিট আগে যদি ওয়ার্নিং দেয়া হয়, যারা বাইরে থাকেন, তারা সময়ের মধ্যে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে পারেন। দ্বিতীয়ত, শেল্টার নির্মাণ। আপনারা জানেন, বজ্রপাতে সাধারণত কৃষকের মৃত্যু বেশি হয়। তাই আমরা ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মতো বজ্রপাতেরও শেল্টার নির্মাণ করেছি। হাওর-বাঁওড়-খেত-মাঠে আশ্রয় কেন্দ্র করে দেব, যাতে ওয়ার্নিং পাওয়ার পর আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে পারে। তৃতীয়ত, বজ্রনিরোধক বসানো। এরই মধ্যে আমরা ১৫টি জেলায় বসিয়েছি। এজন্য হাজার ৯০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও নিয়েছি। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাসের অপেক্ষায় আছে। আশা করছি, কাজ শুরু হলে বজ্রপাতে মৃত্যু শূন্যতে নামিয়ে আনতে পারব।   

দুর্যোগ মোকাবেলায় দেয়া সতর্কসংকেত অনেকের কাছেই দুর্বোধ্য মনে হয়। এটাকে আরো আধুনিক করার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

দীর্ঘদিন থেকেই এভাবে সতর্ক সংকেত দিয়ে আসা হচ্ছে। যেমন নম্বর সতর্ক সংকেত। অর্থাৎ দূরবর্তী সতর্ক সংকেত। , , মানে এখন এটা আঘাত হানতে পারে, সাবধান হয়ে যাও। তারপর , , যখন দেয়া হয়, সেটা বিপত্সংকেত। আঘাত হানবেই। সবাই অ্যালার্ট থাকো নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য। , , ১০ হলো মহাবিপদ সংকেত। অর্থাৎ ঘরে বসে থাকলে এখন আর বাঁচার উপায় নেই। সংকেত দেয়ার পরই কিন্তু সিপিপি ভলান্টিয়াররা মুভমেন্ট শুরু করে। ঘণ্টার মধ্যে সবাইকে আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। বহু বছর ধরে সংকেতে মানুষ মানিয়ে নিয়েছে। এখন মানুষ বোঝে। যেমন সিত্রাংয়ের সময় যতক্ষণ পর্যন্ত নং সতর্কসংকেত ছিল, মানুষ শেল্টারে আসেনি। আবার আম্পানের বেলায় ১০ নম্বর দিয়েছিলাম। মানুষ স্বেচ্ছায় শেল্টারে চলে এসেছে। ২৪ লাখ মানুষ এসেছে। তবে সতর্কসংকেত আধুনিকায়নে বিভিন্ন সেমিনারে আলোচনা হয়েছে। যেহেতু এটা আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিষয়। আমরা সংশ্লিষ্টদের চিঠি পাঠিয়েছি উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটিকে আরো আধুনিক করার জন্য।  



এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন