আমন কর্তন শতভাগ

৬৭ দিনেও লক্ষ্যমাত্রার শূন্য শতাংশের ঘরে ধান সংগ্রহ

শাহাদাত বিপ্লব

চলতি বছর অনাবৃষ্টির কারণে আমন মৌসুমে কিছুটা দেরিতে আবাদ হয়। কারণে ফলন কর্তনও হয় দেরিতে। এরই মধ্যে শতভাগ জমির আমন ধান কর্তন হয়েছে। অতিরিক্ত সূর্যালোক অনুকূল আবহাওয়ায় এবার ফলন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় শতাংশেরও বেশি। তার পরও থমকে রয়েছে সরকারিভাবে ধান চাল-সংগ্রহ অভিযান। প্রায় ৬৭ দিনে ধান সংগ্রহ হয়েছে মাত্র হাজার ২২১ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার মাত্র দশমিক ৭৪ শতাংশ।

খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, চলতি আমন মৌসুমে সরকারিভাবে তিন লাখ টন ধান পাঁচ লাখ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়। গত ১৭ নভেম্বর ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়। চলবে আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরই মধ্যে চাল সংগ্রহ হয়েছে লাখ ৫৭ হাজার ৫৯৩ টন। চাল সংগ্রহ প্রায় অর্ধেক হলেও ধান সংগ্রহ একেবারেই তলানিতে। বছর সরকারিভাবে ধানের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি কেজি ২৮ টাকা। আর চালের ক্রয়মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রতি কেজি ৪২ টাকা।

কিন্তু খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বেঁধে দেয়া দামের চেয়ে কৃষকের উৎপাদন খরচ বেশি হওয়ায় কৃষকরা খোলাবাজারেই ধান বিক্রি করছেন। সরকার নির্ধারিত মূল্যে এক মণ ধানের দাম আসে হাজার ১২০ টাকা। কিন্তু এবার দেশের বিভিন্ন জেলায় খোলাবাজারে কৃষকরা আমন মৌসুমের ধান হাজার ২০০ থেকে হাজার ৪০০ টাকায় বিক্রি করেছেন। এছাড়া সরকারি গুদামে ধান বিক্রিতে বাড়তি পরিবহন খরচ, বিক্রয়ে অনিশ্চয়তা এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ নানা প্রক্রিয়াগত জটিলতায় পড়তে হয় বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।

নওগাঁ সদর উপজেলার চণ্ডীপুর ইউনিয়নের চুনিয়াগাড়ী গ্রামের কৃষক তোফাজ্জল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, গত ডিসেম্বরে ধান কেটে ত্রি-মোহনী হাটে হাজার ২৫০ টাকা মণ দরে বিক্রি করতে পেরেছি। ধান সরকারি গুদামে নিয়ে গেলে মিটার পাস করতে প্রতি মণে অন্তত তিন কেজি ওজন কমে যেত। স্থানীয় বাজারের চেয়ে গুদামে কম দাম থাকলে সেখানে ধান দিয়ে সরকারকে সহযোগিতা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না।

একই কথা জানালেন লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার কৃষক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা এবার জমি থেকেই ধান বিক্রি করে দিয়েছি। প্রতি মণ হাজার ২০০- হাজার ৩০০ টাকায় বিক্রি করেছি। গুদাম পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার খরচ, ব্যাংক হিসাব নানা নিয়মতান্ত্রিক জটিলতা তো আছেই।

এদিকে কৃষকদের কাছ থেকে ধান কিনলেও সাধারণত চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য মিলগুলোর সঙ্গে চুক্তি করে সরকার। শুরুতে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত মিলগুলোর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পাওয়ায় ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়সীমা বাড়ানো হয়। তবু নির্ধারিত সময়সীমা শেষে চুক্তি হয়েছে মাত্র লাখ ৬৪ হাজার ৯২৪ টনের। চুক্তিবদ্ধ হয়েছে হাজার ৮৯৫টি মিল। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মিলগুলোর সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রার ৮৬ শতাংশ চালের চুক্তি হয়েছে।

মিল মালিকরা জানিয়েছেন, চালের যে উৎপাদন খরচ তা দিয়ে সরকারি মূল্যে সরকারকে চাল দিতে গেলে লোকসানে পড়তে হয়। কিন্তু কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়েই মিলগুলোকে সরকারের চাল সংগ্রহ চুক্তি অনুযায়ী চাল সরবরাহ করতে হচ্ছে।

দেশের চালের বৃহৎ মোকামগুলোর মধ্যে অন্যতম নওগাঁ জেলা। সেখানকার আড়তদারপট্টির চাল ব্যবসায়ী সুকুমার বলেন, কয়েক বছর যাবত সাহা চাউল কল নামে একটি মিল ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করে আসছি। সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যেক মিলারের চাল দিতে বড় অংকের লোকসান গুনতে হচ্ছে। মুহূর্তে ইনসেনটিভ দেয়া না হলে আগামী বোরো মৌসুমে মিলাররা চুক্তিবদ্ধ হওয়া নিয়ে শঙ্কায় থাকবেন।

যদিও বছর আমন মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় সাত লাখ টন বেশি চাল উৎপাদন হয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, চলতি বছর বোনা রোপা আমন মিলিয়ে মোট ৫৮ লাখ ৯৯ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়। এসব জমিতে এবার কোটি ৭০ লাখ ২৯ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। যদিও উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল কোটি ৬৩ লাখ ৪৫ হাজার টন। গড় ফলন হয়েছে প্রতি হেক্টরে দশমিক ৮৮ টন। গড় ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল দশমিক ৭৬ টন।

এর আগে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণায় বলা হয়, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত রয়েছে। তার পরও সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সরকারের ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থতা, পর্যাপ্ত মজুদ নিশ্চিত করা এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাল আমদানি করতে হয়।

গবেষক দলের প্রধান ব্রির জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা . মোহাম্মদ সিদ্দিকুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, উদ্বৃত্ত থাকার পরও চাল আমদানির একটি কারণ ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়া। এছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং যেকোনো দুর্যোগের প্রস্তুতি হিসেবে মজুদ নিশ্চিত করতে চাল আমদানি করতে হয়। সরকারের যেসব সুরক্ষা কর্মসূচি রয়েছে যেমন ওএমএস বিভিন্ন সহায়তা কর্মসূচি, সেজন্যও সরকারের কাছে চালের মজুদ থাকতে হয়। কিন্তু যখন ধান-চাল লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী সংগ্রহ না হয় তখন এর প্রভাব মজুদের ওপর পড়ে। যদিও ধান-চাল সংগ্রহে ব্যর্থতাই চাল আমদানির একমাত্র কারণ নয়।

চলতি বছরের বোরো মৌসুমেও সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা লাখ ৫০ হাজার টন নির্ধারণ করা হলেও এর ৫৯ ভাগই পূরণ হয়নি। যদিও চালের ১১ লাখ টন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়েছে। ব্রির প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে শুধু শতভাগ ধান-চাল সংগ্রহ করতে পেরেছে সরকার। এছাড়া ২০১৯ সালে ২১ শতাংশ, ২০২০ সালে ৩৩ ২০২১ সালে ৫৪ শতাংশ ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়।

ধান সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করতে হবে জানিয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান . রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, সাধারণত দুটো কারণে চাল আমদানি করতে হয়চাহিদার চেয়ে জোগান কম হলে এবং বাজার ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল রাখতে। ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হওয়ার অন্যতম কারণ কঠিন শর্তযুক্ত থাকা। কৃষককে ধান পরিবহন করে নিয়ে এসে আবার সেটার আর্দ্রতা ঠিক আছে কিনা তা নিয়ে হয়রানির শিকার হতে হয়। ধান সংগ্রহের প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে। নইলে কখনই ধান সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব নয়।

তবে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ধান-চাল সংগ্রহে কোনো ব্যর্থতা নেই। চালের লক্ষ্যমাত্রা পাঁচ লাখ টন নির্ধারণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় লাখ ৭০ হাজার টন সংগ্রহ হয়ে গেছে। বাকিটাও হয়ে যাবে। আমন উৎপাদনও অনেক ভালো হয়েছে। তিন মাস আগে চাল আমদানির জোর তত্পরতা থাকলেও এখন তেমনটা নেই। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে এক লাখ টন আসছে। চালের পর্যাপ্ত মজুদ আছে।

 

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন নওগাঁ, লক্ষ্মীপুর ফেনী প্রতিনিধি)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন