
শিল্পভুবনে বাংলার মানুষকে দেখার মাঝে একটি উল্লেখযোগ্য ছেদ এস এম সুলতান। পানা ছাওয়া ঢেউহীন পুকুরে ঢিল ছোড়া, খানিকটা আলোড়ন শেষে আবার স্থবিরতা। এ উদাহরণ বিষয়টি পুরোপুরি বোঝাতে সাহায্য করছে এমন নয়। বরং ঢেউ মিলিয়ে গেলেও তার রেশ রয়ে গেছে স্থায়ী হয়ে, যাকে আমরা সুলতানের প্রভাব বলছি। সমকালে অনেকটা ব্রাত্য হয়ে থাকলেও এখন আর তাকে ছাড়া বাংলার চিত্রকলা নিয়ে কোনো আলোচনাই সম্ভব নয়।
তার আগে ও পরে মৃত্তিকা সংলগ্ন মানুষ এতটা বলশালী ও কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে হাজির হয়নি। একইভাবে হাজির পরিপার্শ্ব। সুলতানের আদমের যে সুরত, সেখান তার কর্তাসত্তা এ পৃথিবীকে ভাবী প্রজন্মের জন্য সহজ করে তোলে, যারা প্রকৃতির ঘরের মানুষ। বাংলা বলতে যে রুগ্ণ-দুর্বল মানুষের চিত্র আমাদের সামনে ভেসে ওঠে তাকে একদম উল্টে দিয়েছেন তিনি। এ রূপান্তর শুধু শারীরিক নয়, সমাজের অন্তর্গত সাম্য চেতনার আবির্ভাব।
আমাদের চোখে দেখা মানুষ ততটাই মানুষ হয়ে ওঠে যতটা আমরা ইতিহাস-রাজনীতির ভেতর নির্মাণ করি। একজন শিল্পী একজন রাজনীতিকও। ইতিহাসের বাতেনি দিক তার হাতে নির্মিত ও ব্যাখ্যাত হওয়ার ভাণ্ডার। সুলতান অধরা এক মানুষকে হাজির করেছেন। সেই মানুষ যে নিজেকে নির্মাণ করে, নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেয়। গরিবি অহংকারের নিষ্ফল বিলাসিতা নেই।
সুলতানের পদচারণ বাংলায় আটকে ছিল না। যতটা শিল্পী, ততটা ভবঘুরে; তার ওপর একজন সাধক। তিনিই আবার বিচ্ছেদী গানের সম্রাট বিজয় সরকারের গানের দলে বাঁশিওয়ালা। তার সাধন অধরা এক মানুষকে গড়ে তোলার।
নড়াইলের মাটির এ সন্তান এক জীবনে কম মানুষ দেখেননি। কৃষক থেকে জমিদার, মহারাজা, দেশী-বিদেশী শিল্পরসিক কার সঙ্গে ছিল না তার সখ্য! এই দেখাদেখির ভেতর বাংলার মাটিমাখা মানুষকে করেছেন গন্তব্য, যাদের লাঙলের ফলায় কঠিন মাটি ভেদ করে উত্থিত হয় সোনালি ফসল। তাদের মতোই সমৃদ্ধ চারপাশের প্রাণ-প্রকৃতি। আত্মস্মৃতিতে বলেছেন, ‘নানার বাড়ির কাছের সেই বিল, শাপলা, ধান, পাটবন, পাট বাছা, পাট শুকানো, পাট নিড়ানো, শুকনার সময়ে কৃষকের চাষাবাদ-জমি নিড়ানো, ধান রোয়া, ধান কাটা, ধান মাড়াই, ধান ভানা আমি কোনোভাবেই ভুলতে পারিনি।’
এ বর্ণনা বেশ সাদামাটা, আরো অনেকের জবানে পাবেন। কিন্তু দেখা ও অনুধাবনের ভেতর বদলে গেছে এর অর্থ।
আর্ট কলেজের পাঠ না চুকিয়েই পথে নামেন সুলতান। বিচিত্র মানুষ, সংস্কৃতি-আচারের মাঝে নিজেকে গড়েছেন, নিজেকে চিনেছেন। তারপর ফিরেছেন দেশের কাছে। কেন ফিরেছেন? সুলতান বলেন, ‘সুদূর সিমলা, কাশ্মীর, লাহোর, শিয়ালকোট, করাচি, লন্ডন ও আমেরিকায় গিয়ে চাঁচুড়ী-পুরুলিয়ার মাঠ-বিলের সৌন্দর্যের রেণু ছড়িয়ে এলাম। এটা চাঁচুড়ী-পুরুলিয়া বিলেরই দৃশ্য নয়, সারা বাংলাদেশ ঘুরলে এমন দেখতে পাবেন। বাংলার প্রকৃতির মধ্যে কোনো উদাসীনতা নেই, যা আছে তা হলো মায়াবী আকর্ষণ। এ প্রকৃতির মায়া যার মনে রয়েছে তার তো কৃত্রিম কোনো কিছুর কাছে যাওয়ার দরকার নেই।’
সেই মায়াটুকুই সম্বল সুলতানের। দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য ও নিপীড়নের মাঝে অতিচর্চিত বাংলার ক্ষীণদেহী মানুষের বিপরীতে তার মানুষ খানিক ‘কৃত্রিম’ ঠেকতে পারে বটে। কিন্তু তার অন্তর্নিহিত বয়ান ও সম্ভাবনার দিক থেকে ঠিকঠাক। এটা সুলতানের রাজনৈতিক ইশতেহার বটে, যে কারণে তিনি দুনিয়ার বড় শহরের মায়ায় পড়েননি, ফিরে এসেছেন নড়াইলে। সেখানকার মানুষদের স্বপ্ন দেখাতে।
বিশেষ কোনো ইভেন্ট ধরে পেশিবহুল মানুষের ছবিগুলো আঁকেননি বলে একাধিকবার বলেছেন সুলতান। আজকাল বাংলার ইতিহাসকে যেখানে ১৯৭১-এ আটকে রাখা হয়, সুলতান আরো ওপর থেকে দেখতেন এ অঞ্চলকে। প্রথম বৃক্ষরোপণ থেকে শুরু তার ভ্রমণ। তার কৃষক সব ধরনের উপনিবেশ, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত। আর বাংলাদেশে কতটা নিজের অধীন হতে পেরেছেন তারা? মুক্তিযুদ্ধের প্রভাব প্রসঙ্গে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমি সবসময় কৃষকদের এঁকেছি, কৃষকরা যুগ যুগ ধরে অমানবিক পরিশ্রম করে চলেছে। ওদের উপজীব্য করেই সমাজটা গড়ে উঠেছে। কিন্তু ওদের চিরকালই বিট্রে করা হয়েছে। ব্রিটিশরা করেছে, পাকিস্তানিরা করেছে।’
তিনি মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধে কৃষকদের অনেক আশা দেয়া হলেও তা রাখা হয়নি। এভাবে বলছেন, ‘এই যে একটা এক্সপ্লয়েটেশন প্রসেস, আমার ছবিগুলো তার প্রতি একটা চ্যালেঞ্জ। শোষণ করো, কিন্তু কোনো মশা এদের শেষ করতে পারবে না, ব্রিটিশরা করেছে, পাকিস্তানিরা লুটেপুটে খেয়েছে, এখনো চলছে, কিন্তু ওরা অমিত শক্তিধর। কৃষককে ওরা কখনো শেষ করতে পারবে না, আমার কৃষক এ রকম।’
এমন শক্তিধর বয়ান যেসব ছবির মর্মমূলে যা স্বভাবতই আহমদ ছফার মতো সংবেদী মানুষকে আক্রান্ত করবেই। ‘নিসর্গ ও মানুষ’
চিত্রাবলি দেখে তিনি প্রভাবিত হয়ে পড়েন যে লিখে ফেলেন বিখ্যাত কবিতা ‘একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা’। ছফার মনে হয়েছিল, এ চিত্রগুলোর চেয়ে ‘সুন্দর এবং প্রাণসমৃদ্ধ কোনো বস্তু’
কোথাও দেখেননি তিনি। এ কারণে বাঙালি মুসলমানের বয়ান নির্মাতাকে বারবার সুলতানের কাছে ফিরতে হয়েছে।
ছফার কাছে ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের মাস্টারদের মতো দীপ্যমান সুলতান। অবশ্য তার ছবিকে রেনেসাঁর প্রভাব বলেও কাটাছেঁড়া হয়েছে। এও বলা হয়েছে, সুলতান অ্যানাটমি জানেন না বলে ও রকম ছবি আঁকেন। বিশেষ করে মাইকেলেঞ্জেলোর কথা আসে। প্রভাব থাকতে পারে তা অস্বীকার না করলেও সুলতান জানান, তার থিম ও উদ্দেশ্য আলাদা, যা পশ্চিমের পক্ষে আয়ত্ত সম্ভব নয়, এমনকি যারা পশ্চিম প্রভাবিত তাদের পক্ষেও নয়। কৃষকদের তিনি যেভাবে দেখেন তা বাংলার অন্য শিল্পীরা ভাবেননি। বাংলার কৃষক নিজের লড়াইয়ের গুণে বড় হয়ে ধরা দিয়েছে। যাকে সুলতান বলছেন ‘সিম্বল অব এনার্জি’,
যা একই সঙ্গে কৃষকের স্বপ্ন। তুলনায় আসা অন্য শিল্পীর চিত্রকর্ম থেকে এতই আলাদা যে কৃষক কখনো সুলতানকে এড়িয়ে যাননি। বরং তার চিত্রমালার অর্থ জানতে ব্যাকুল ছিলেন। এ ছবি তাদের অব্যক্তকে ব্যক্ত করেছে।
নিজের ‘বোধের ভিন্নতা’
প্রসঙ্গে সুলতান বলেন, ‘আমার স্কুল তো খোলা প্রান্তর, কৃষকের ছোনা ঘরের বারান্দায় হুক্কোটানা চাষী, পাশে ঘুমন্ত বিড়াল, উঠানে অবসন্ন ক্লান্ত কুকুর। লাউ গাছে ঝুলন্ত লাউ, কৃষক বধূর নিকানো চুলোর পাশে রান্নার আয়োজন, বিলের থেকে ধরে আনা মাছ বঁটি দিয়ে কাটা, বিকালে গ্রাম্য বধূদের চুলবিলি দেয়া আর সেই সাথে আয়েস করে কিছুটা গল্পবলা। প্রকৃতি, মানুষ, মানুষ-প্রকৃতির গভীরে যা কিছু আছে সবি আমার ভূমিতে এসেছে। আমার ব্রাশে কোনোভাবেই ব্রিটিশের কৃত্রিম বোহেমিয়ার প্রশ্রয় নেই।’
বিখ্যাত একটি পেইন্টিংয়ে মানুষের মতো দুটি গরু ছিল মোটাতাজা ও মাংসল। এ চিত্রকর্ম যখন গ্রামের কৃষকদের দেখানো হলো, তারা বলছিলেন, এমন গরু যদি তাদের থাকত। এই ভাব-কল্পনা যাকে ধরতে চেয়েছেন সুলতান। বলছিলেন, ‘বিশেষ করে দামড়া দুটো দেখে খুব খুশি হয়, বলে, এ রকম দুটো পাওয়া গেলে খুব কশে চষা যেত। ওদের এই খুশি, এই আশাটা আমার কাছে ইমপর্ট্যান্ট।’ খুশির মুহূর্তটা ভাগাভাগি করতে গিয়ে হাসছিলেন সুলতান।
তিনি জীবনে এঁকেছেন বিস্তর। তার বেশির ভাগই লোকচক্ষুর আড়ালে। নিজেও তেমন খবর রাখেননি। হারিয়ে গেছে দেশ-বিদেশে। দেশেও অনেকে তার চিত্রকর্ম সংরক্ষণের নামে ফেরত দেয়নি। এখনো যে কয়টি মাস্টারপিস টিকে আছে নড়াইলের সংগ্রহশালা ও অন্যান্য স্থানে তা দেখতে গিয়ে সুলতানের চিন্তা ও আত্মার মহত্ত্ব ধরা পড়ে। বড় চিন্তাকে ছোট জায়গায় আটকে রাখা তার ধাতে ছিল না। বরাবরই বড় স্পেসকে বেছে নিয়েছেন ভাব-রাজনীতি তুলে ধরতে, যাকে মন বড় রাখার বিষয় হিসেবে দেখেন। এ কারণে ফর্মের নিরীক্ষার চেয়ে মানুষের ভেতরের শক্তির উত্থানকে বড় করে দেখেছেন সুলতান। আমাদের ভেতরের শক্তিকে বাইরে টেনে এনেছেন। পরাধীনতা ও প্রাণ-প্রকৃতির শত্রুর বিরুদ্ধে যারা চিরকাল লড়েছে।
‘বিরাট ছবি না আঁকলে তাদের (শিল্পীর) মনে ইমাজিনেশন’ও ছোট হয়ে যায় বলে মনে করতেন সুলতান। বলেন, ‘আমি রিয়েলিটি থেকে সরে এসে মানুষকে সিম্বলিকভাবে রিপ্রেজেন্ট করেছি, সুররিয়ালিস্টও বলতে পারেন। আমি কৃষকের হাজার হাজার বছরের এনার্জিকে, ওদের ইনার স্ট্রেন্থকে এক্সাজারেট করে দেখিয়েছি। কাজের ফিলিংসটাকে বড় করে দেখিয়েছি। মাইকেলেঞ্জেলোর ডেভিড ৩০ ফুট উঁচু, রাশিয়ান কৃষাণ-কৃষাণীর মূর্তি বিশাল আকারের। জীবনের চেয়েও বড়। এসব কাজ লাইফের প্রতি মানুষের ইন্সপিরেশনকে বাড়িয়ে দেয়। আর্টের ক্ষেত্রে এ ইন্সপিরেশনটাই তো বড় কথা?’
তার চিত্রগুলোয় পুরুষের মতো গ্রাম্য নারীর দৈহিক গড়ন সুডৌল ও সুঠাম। নারীর মধ্যে উপস্থিত চিরাচরিত রূপলাবণ্য ও এ অঞ্চলের দার্শনিক নির্যাস নারীশক্তির সম্মিলন ঘটিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ নিজার বলেন, ‘আমাদের ইতিহাস, সমাজবিদ্যা দর্শনে প্রান্তিক নারী উপেক্ষিত। সমকালীন তত্ত্ব আলোচনায় নারীকে প্রান্তিকের মধ্যে প্রান্তিকরূপে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুলতানের নারী-পুরুষের কর্মবিভাজন করলেও লিঙ্গভেদে গুরুত্বের তারতম্য করেননি। প্রান্তিক কৃষকের মতো কৃষাণীও বলিষ্ঠ। তাই সচেতনভাবে তার নারী অবয়ব পেশিবহুল এবং এ পেশি পরিশ্রম ও টিকে থাকার শক্তিকে নির্দেশ করে।’
সুলতান শিল্পকর্মের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পর্কটা স্পষ্ট রেখেছেন সবসময়। অন্য অনেক পেইন্টিংয়ের বিষয়ে তার মত হলো, চাইলে প্রতিষ্ঠিত ফর্মনির্ভর ছবি আঁকতে পারতেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে এসব ছবি কোনো অনুভূতিই তৈরি করে না। শিল্পী হিসেবে আত্মজিজ্ঞাসা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা গুরুত্বপূর্ণ। সব মানুষের ভেতর থাকা শিল্পসত্তাকে বরাবরই গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। এ সত্তা তাকে আগামীর পথে এগিয়ে দেয়। যে শিল্পের সঙ্গে মনের কোনো সম্পর্ক নেই, সেই শিল্পের কোনো মূল্য সুলতানের কাছে নেই। মাটির কাছ থেকে বিস্মৃত বা বিচ্ছেদে ব্যথাতুর হয়ে উঠে সত্তাকে শিল্পের মাধ্যমে জোড়া দিতে চেয়েছেন তিনি। কিন্তু তা আর থাকল কই। মানুষকে বড় করে দেখা, তার সম্ভাবনার নির্যাসে তুলির ডগায় তুলে আনার সক্ষমতা বাংলায় আর তেমন দেখা যায়নি। এখন মানুষ এতই বিমূর্ত হয়ে গেছে, তার আত্মার দাবিও হয়েছে বিস্মৃত। না, এমন নয় যে সুলতানের স্কুল অব থট বা তার ফর্ম এগিয়ে নিতে হবে। বরং বাংলার মানুষকে তার সক্ষমতা, কল্পনা ও স্বপ্নের জায়গা থেকে তুলে ধরাটা আর এভাবে হয়নি। সেদিক থেকে সুলতানের মানুষ ‘অধরা’, ভবিষ্যতে হয়তো ‘হয়ে’ উঠবে। তার জন্য ভাবনার রূপান্তরও প্রয়োজন। মাটি ঘেঁষা এ দার্শনিক অভিযাত্রায় ততদিন সুলতানও আমাদের কাছে অধরা এক আদম, যাকে আমরা যতটুকু বুঝি তার চেয়ে কমই বুঝি।
সূত্র: শিল্পী সুলতানের আত্মকথা: জীবনের জলরঙ, কথা পরম্পরা: গৃহীত এবং ভাষান্তরিত সাক্ষাৎকার, ভারতশিল্পের উপনিবেশায়ন ও সুলতানের বিউপনিবেশায়ন ভাবনা, বাছ-বিচার, একটি প্রবীণ বটের কাছে প্রার্থনা।