ফ্রিদা কাহলো

পরাবাস্তব ক্যানভাসে বিষণ্ন বয়ান...

আহমেদ দীন রুমি

সেলফ পোর্ট্রেট উইথ থর্নি নেকলেস ছবি: ফ্রিদা কাহলোডটওআরজি

(পূর্ব প্রকাশের পর)

রিভেরার ম্যুরালে ক্যানভাস সারা দেয়াল, ফ্রিদার ক্যানভাসের দৈর্ঘ্য দুই ফুটের কম। স্থূল স্বাস্থ্যের রিভেরা উচ্চতায় ছয় ফুট ওজনে ৩০০ পাউন্ড। অন্যদিকে ফুট ইঞ্চি ফ্রিদার ওজন ১০০ পাউন্ড। তার পরও সম্পর্ক বিয়েতে গড়ায় ১৯২৯ সালে। ফ্রিদার মা প্রায়ই মজা করে বলতেন হাতি ঘুঘুর সংসার তবে শুরুটা দুর্দান্তই ছিল হাতি আর ঘুঘুর জন্য। শিল্পের দুনিয়ায় রিভেরাকে ওস্তাদ মানতেন ফ্রিদা। রিভেরার আগমনের ছাপ মেলে তার আঁকাআঁকিতে। বিয়ের পর দুজন দুজনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন। বছর কয়েক পর রিভেরাকে নিয়ে আমেরিকা সফর করেন ফ্রিদা। রিভেরার শিল্প প্রদর্শনী ম্যুরাল নির্মাণের কাজ সেখানে। অবশ্য সময়টা ভালো কাটেনি ফ্রিদার জন্য। ১৯৩২ সালে দীর্ঘ ১৩ দিন হেনরি ফোর্ড হাসপাতালে থাকতে হয় গর্ভপাতজনিত কারণে। সন্তানদানে ব্যর্থ হওয়ার দুঃসহ অভিজ্ঞতা থেকে জন্ম দিলেন দুটি মাস্টারপিস চিত্রকর্ম হেনরি ফোর্ড হসপিটাল মাই বার্থ আর্টের ইতিহাসে এমন অদ্ভুত নজির আগে দেখেনি দুনিয়া। যেন প্রাতিষ্ঠানিক কোনো ঘরানার তোয়াক্কা করেন না ফ্রিদা আঁকতে বসে। যেন তৈরি করতে চান স্বতন্ত্র বলয়। রিভেরার তখন ব্যস্ততা ডেট্রয়েট ইনস্টিটিউট অব আর্টসে ম্যুরাল নিয়ে। নিঃসঙ্গ ফ্রিদা আশ্রয় নিলেন মেক্সিকোর আদি ঐতিহ্যে। তার প্রমাণ সেলফ পোর্ট্রেট অন দ্য বর্ডার বিটুইন মেক্সিকো অ্যান্ড দি ইউনাইটেড স্টেটস চিত্রকর্মে ফ্রক পরা ফ্রিদার এক পাশে কলকারখানার ধোঁয়া, বৈদ্যুতিক আলো হর্ন। অন্য পাশে আদি ইন্ডিয়ানদের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা, চন্দ্র, সূর্য ফুল। এক পাশে আমেরিকা অন্য পাশে মেক্সিকো। সীমান্তের ওপর দাঁড়ানো ফ্রিদা কিছুটা মেক্সিকো অভিমুখী। যেন ফ্রিদার শিল্পসত্তায় মেক্সিকোর পরিচয়ই মুখ্য হয়ে উঠেছে।

আমেরিকায় অবস্থানকালে উপনিবেশবিরোধী চেতনা তীব্রতর হয় ফ্রিদার মধ্যে। রিভেরার সঙ্গে সরব থাকেন সেখানকার কমিউনিস্ট তত্পরতায়। কমিউনিস্ট পার্টি তখন স্তালিনিস্ট ট্রটস্কিয়ান নামে দুটি শিবিরে বিভাজিত। স্তালিন ক্ষমতা পেয়েই নির্বাসনে পাঠিয়েছেন প্রধান নেতা ট্রটস্কিকে। রিভেরা ফ্রিদা আমেরিকায় থাকাকালেই স্তালিনবিরোধী অবস্থান নিলেন। সমর্থন দিলেন ট্রটস্কিকে। আমেরিকান শিল্পবোদ্ধা মহলে সমাদৃত হন দম্পতি। সেখানকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ফ্রিদা হাজির হতেন আদি আমেরিকান জনগোষ্ঠীর পোশাক সাজে। সময়েরই একটা চিত্রকর্ম মাই ড্রেস হ্যাংস দেয়ার আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যায় মেক্সিকান পোশাক তিহুয়ানা। ১৯৩৪ সালে ফ্রিদা রিভেরা ফিরে আসেন মেক্সিকোয়। সবকিছু হয়তো ভালো চলতে পারত, কিন্তু নিয়তি সেটা চায়নি। একটা দুঃসংবাদ স্তব্ধ করে দেয় ফ্রিদাকে। তারই ছোট বোন ক্রিস্টিনার সঙ্গে রিভেরার সম্পর্ক। প্রচণ্ড ব্যথার পাহাড় নিয়ে ফ্রিদা নির্মাণ করলেন বিখ্যাত চিত্রকর্ম ফিউ লিটল প্রিকস রিভেরা ক্রিস্টিনার সম্পর্ক জড়িয়ে চাপা অভিমান ভরা আরো কিছু চিত্রকর্ম আছে তার। তাদের একটি মেমোরি ১৯৩৭। সারা জীবনে পেইন্টিং, ড্রয়িং স্কেচ মিলিয়ে প্রায় ২০০ ছোঁবে ফ্রিদার নির্মাণ। ১৪৩টি পেইন্টিংয়ের মধ্যে ৫৫টিই আত্মপ্রতিকৃতি। যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় নিঃসঙ্গ জীবন। স্থানীয় মেক্সিকান সংস্কৃতির পাশাপাশি খ্রিস্ট ধর্মের নানা রূপক খুঁজে পাওয়া যায় তার আঁকায়। তীরের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হরিণ, হামিংবার্ড, কালো বানর, কাঁটার নেকলেস, ভার্জিন মেরি কিংবা লাস্ট সাপারের অনুষঙ্গ তার চিন্তাশক্তিতে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। কেবল সেল্ফ পোর্ট্রেট উইথ থর্নি নেকলেস চিত্রকর্মের কথাই বিবেচনা করা যাক। গলায় ঝুলে থাকা হামিংবার্ড স্থানীয় মেক্সিকান সংস্কৃতিতে সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। পেছনে বানর প্রতীকায়িত করে দুর্ভাগ্যকে। রিভেরা ফ্রিদাকে একটা বানর উপহার দিয়েছিলেন। সে অর্থেও আসতে পারে। চিত্রকর্মে বানরটি কাঁটাযুক্ত নেকলেস ধরে টানছে, যার ফলে রক্তাক্ত হচ্ছেন ফ্রিদা। যেন প্রতিনিধিত্ব করছে রিভেরার থেকে পাওয়া কষ্টের। গলার নেকলেসটা ক্রুশবিদ্ধ যিশুর কথা মনে করিয়ে দেয়। (চলবে)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন